আজকের সকাল টা তিন ভাইয়ের কাছে একদম অন্যরকম । কেউ কারোর মুখের দিকে তাকাতে পারছেনা । তিন ভাইয়ের তিন টি ছোটো ছেলে মেয়েও একদম চুপ । বড়দার মেয়ে পিয়ালি শুধু কেঁদেই চলেছে । বাড়ির রান্নার মাসি একটা বাটি আর ভাতের ছোটো হাঁড়িটা সামনে দিয়ে নিয়ে গেল ধোবার জায়গায় । বড়দা ওটা দেখেই ফুঁপিয়ে উঠলো , পিন্টুর রান্না কড়া কালকের খাবার ওর । কাজের মাসি শুধু বললো - " সবটাই তো আছে , কিছুই খায় নি ।' বিনয় স্বপ্নার দিকে শুধু তাকালো , শুধু স্বপ্নাই ক দিন ধরে বলছিল -' জানো পিন্টু বোধহয় ঠিকমত খেতে পারছেনা । খেলেই বমি করছে ।' বিনয় রেগে গিয়ে বলেছিল - " ওর তো আর আমাদের সাধারন রান্না পছন্দ হয় না । ঝাল - মশলা - তেল সব একেবারে বেশী বেশী না দিলে উনি খেতে পারেন না । যত সব! নিজেই রান্না করে খাবে । বড় বৌদি - ই তো সবাই কে বললো -" তবুও তো খাবে "। আমাদের রান্না হয়ে গেলে ও রান্না নিজেই করুক ।'সেই শুরু মাস দুয়েক হল ও নিজেই রান্না করে নিতো । কোন কোন দিন পিয়ালি কে ডেকে বলতো - ' ডায়না , দারুণ হয়েছে চলে আয় , মাংস টা যা হয়েছে না !' পিয়ালি মুখে দিয়েই চিৎকার করে উঠত - জল - উঃ জ্বলে গেলো ইত্যাদি । বিনয়ের ছেলে তিতির কে ডাকতো গোগল বলে যেহেতু ওর গোলগাল চেহারা । আর সুমনের ছেলে জিষ্ণু কে ডাকতো স্টিফেন বলে । আর ওরাও পিন্টু কে ডাকতো টিকাই বলে । সবাইয়ের কাছে টিকাই ।
ছোটবেলা থেকেই চার ভাইয়ের মধ্যে দারুণ মিল। বাবা সামান্য একটা প্রেস করেছিলেন - কোনওরকমে চলত । তা দিয়েই সংসার টা জোড়াতালি দিয়ে চালাতেন । তখন ওরা পড়াশুনা করছে । বড় চন্দন তখন B.A. পড়ছে , মেজ বিনয় তখন সবে হায়ার সেকন্ডারী পরীক্ষা দিয়েছে , সেজ সুমন তখন ক্লাস নাইনে আর পিন্টু এইটে । বাবা হিরন্ময় বাবু বলতেন আমার চারটি ঘোড়া যখন দৌড় শুরু করবে তখন আমার আরে কোনও কষ্ট থাকবে না । পিন্টু সত্যিই পড়াশুনায় দুর্দান্ত , ক্লাসে সব সময় সেকেন্ড হত । হিরিন্ময় বাবু বলতেন - পিন্টু কে সি .এ . পড়াবো , চন্দন ওর পড়াশুনার খরচ দেবে । মা'ও পিন্টু কে একটু বেশী'ই ভালোবাসতেন , হয়তো ছোটো ছেলে বলেই । বিনয় সুমনের দিকে তাকাতেই সুমনের চোখে জল দেখতে পেলো । বিনয় ভাবছিলো অন্য কথা - মা যদি ওকে পশ্রয় না দিতেন তবে এই দিনটি কখনই আসতো না । এই তো সেদিনের কথা - রাত বারোটা নাগাদ মদ খেয়ে এসে পিন্টু - কপালে একটা বড় কাটা , রক্তে ভিজে যাচ্ছে জামা - সে অবস্থাতেই ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়েছিল । ভাগ্যিস বড় বৌদি কাকলি দেখেছিল । তিন ভাই মিলে একটা ভ্যান ডেকে ওকে তোলবার চেষ্টা করাতে পিন্টু বারবার বাধা দিচ্ছিল । শেষে সুমন আর বিনয় একটা দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে হাসপাতালে যায় ।সেলাই করে ওষুধপত্র নিয়ে বাড়ি ফেরে অনেক রাতে । এর আগে একবার হাসপাতালে ভর্তি হবার পর পালিয়ে এসেছিলো বাড়িতে , অথচ পিন্টু কতটা দায়িত্বশীল ছেলে সবাই জানে সে কথা । কি থেকে কি হয়ে গেলো ছেলেটা । হঠাৎ বাবা মারা গেলেন , তখন দাদা এম.এ ফাইনাল ইয়ার । মেজ বিনয় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে , সুমন হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করে কলেজে । নিজের পড়াশুনা বাদ দিয়ে বাবার ব্যাবসাটা কে শক্ত হাতে ধরলো পিন্টু । সব দাদাদের বলে দিল -' তোরা কেউ যেন পড়াশুনা বন্ধ করিস না । বড়দা ও মেজদার পড়াশুনাটা যেন কোনভাবে বন্ধ না হয়। সুমন দিনের বেলায় ওকে হেল্প করত - রাতে কলেজ যেত ।দুজনেই দিন রাত খেটে প্রেস টা কে একটা জায়গায় দাঁড় করাতে পেরেছিলো । বিভিন্ন অফিস কোম্পানির অর্ডারগুলো নিয়ে আস্তে শুরু করলো পিন্টু । অবস্থাটাও ফিরলো , সেই পিন্টু এখন শহরের নাম কড়া পিন্টু মাতাল ।
বড়দা অস্ফুটে বললো সব কিছুর জন্য মা দায়ী - মা । কি দরকার ছিলো পিন্টুর জন্য রাত বারোটা পর্যন্ত জেগে খাবার দিতে বসে থাকার ।প্রথম প্রথম মদ খেয়ে বাড়িতে ঢুকতো রাত বারোটায় যাতে কেউ টের না পায়। তার পর সবাই তো ব্যাপার টা জেনে গেলো । সব ভাইয়েরা ওকে বকা ঝকা করতো এতে মা যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হতেন । একদিন সেটাও বন্ধ হল । শুরু হল পিন্টুর এক নতুন জীবন । চন্দনের বিয়েতে ও খুব আনন্দ করেছিলো । বড় বৌদিকে যথেষ্ট সম্মান করতো। তারপর মেজদার বিয়েতেও । তখন ও সকাল থেকে রাত অব্ধি মদ খাওয়া শুরু করলো । প্রেসে আর যেতো না । জামা কাপড় , হাত খরচের টাকা সবই ভাইয়েরা দিতো । কিন্তু পরে ভাইয়েরা চাইলেও আর নগদ টাকা দিতে চাইত না । বৌদিরাও প্রথমে দিয়ে পরে বন্ধ করতে বাধ্য হয় ।
তখন থেকেই ও কেমন যেন পাল্টে যেতে থাকে । এক মুখ দাড়ি , চোখগুলি অপ্রকৃতিস্থ - বেশী কথা বলে । দাড়ি কাঁটার কথা বৌদিরা বললে বলে তোমরাই ঠিক করে নাও কোন দাদা স্পনসর করবে । টাকা পয়সা না পাবার জন্য একটা ক্ষোভ ওর বোধহয় তৈরী হয়েছিলো মনে । তখন থেকেই দাদাদের ও নাম ধরে বাবু বলতে শুরু করেছিলো - চন্দনবাবু , বিনয়বাবু , সুমন বাবু - অবশ্য অপ্রকৃতিস্থ থাকলেই ।
বিনয় সবাই কে শুনিয়ে নিজের মনেই বললো - যাক তোমাদের অশান্তি তো শেষ হয়েছে । পিন্টু এই করেছে , পিন্টু ওই করেছে এসব তো আর নালিশ করতে হবে না । একদিনের কথা বিনয়ের মনে পড়ে - পিন্টু রাতে এসে আর খেলো না । বড়দা ওকে ডাকতে নীচতলায় ওর ঘরে এলো বড়দা ডাকতেই ও বেড়িয়ে এসে বললো - তোরা যা খেয়ে নে , আমার কথা ভাবতে হবে না । সাধারনতঃ নেশা কড়া অবস্থায় ও বড়দার সামনে যেতো না কিন্তু সেদিন গেলো । বড়দা যতই ওকে সাধাসাধি করে ও ততই মেজাজ গরম করে বড়দাকে বললো তোর হেডমাস্টারী টা বৌদির ওপর দেখা । আমাকে দেখাতে আসিস না । বড় বৌদি বড়দাকে ডাকে ওপরে আস্তে - ব্যাস! পিন্টু এবার বৌদিকে যাচ্ছে তাই বলতে শুরু করলো । বৌদি বললো - তোমার মায়ের পাপ এখন আমাদের ঘারে এসে পরেছে । এখন বিদায় হলেই বাঁচি ।
সুমন বড় বৌদির ওপর রাগ করে বললো - মানে ? তুমি কি চাও ? ওকে আমরা বাড়ি থেকে তারিয়ে দিই ? শোনো একটা সময় কিন্তু আমাদের লেখাপড়ার খরচ কিন্তু পিন্টুই চালিয়েছে । আজ বড়দা মেজদা আর আমার কিন্তু দাঁড়ানোর জায়গা থাকতো না ও না থাকলে । বড় বৌদি শুধু বললো - কবে ঘি খেয়েছে আজও গন্ধ গেলো না হাত থেকে । বিনয় শুধু শুনছিল - এবার সব বউ- দের উদ্দেশ্যে বললো সুমনের ব্যাবসাটা কিন্তু ও একাই দাঁড় করিয়েছে বৌদি , সুমন অফিস সাম্লেছে আর ও একা হাতে অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যাপারটা সামলাতো । এই কৃতজ্ঞতা তোমাদের না থাকতে পারে - আমাদের আছে । সুমন বললো সত্যিই তো - ব্যাবসা থেকে ও তো কোন দাবি কোনোদিনও করেনি । শুধু চেয়েছে সব ভাই একসাথে থাকতে ।
সুমনের বাবার কথা মনে পড়লো - বাবা প্রায়ই বলতেন আমি একহাতে ব্যাবসা সামলেছি । আমার চার ছেলে যখন ব্যাবসা ধরবে তখন আর চিন্তা নেই । চাকরি বাকরি না হলেও ব্যাবসা টা করে খেতে পারবে , যদি একসাথে থাকে । বাবা আরও বলতেন যা আছে আজকের কষ্ট দেখবি তা কাল হয়ে যাবে। যে কষ্ট ছিল কাল - সেটা আজ আনন্দে পরিনত হবে । যদি দুঃখ কষ্ট ভাগ করে নিস । শুধু পিন্টুর কষ্ট টাই জানা হল না - কেন এভাবে নিজেকে শেষ করে দেবার অঙ্গীকার করলো তিলতিল করে । এমন তো ও ছিল না ? একটা মাতালের এতো বড় হৃদয় থাকে ? সব বাচ্চাগুলোকে অসম্ভব ভালোবাসে ও - আর ওরাও টিকাই বলতে পাগল । মদ খেয়ে কোনোদিন ওদের কাছে ডাকতো না । ওরা ঘুমনোর পর ও বাড়ি ঢুকতো । কদিন আগেও সুমন বলেছিলো - তুই খেতে পারছিস না ডাক্তার দেখা । চল আমি তোকে নিয়ে যাই । ও বলেছিল - না দরকার নেই , আমার মুখের অরুচির জন্য খেতে পারছিনা , ঠিক হয়ে যাবে । আসলে ও ডাক্তারের কাছে যেতে চাইতো না , গেলে ডাক্তারবাবু ওকে বকাবকি করতো । সেটা ওর সম্মানে লেগেছিলো । সোমা মানে বিনয়ের স্ত্রী ওকে বলল - তুমি তো আসলে জমিদার , জমিদারের মেজাজ কেন ডাক্তার ঘোষ সহ্য করবেন ? পিন্টু তখন বলেছিল হ্যাঁ আমি জমিদার । আমি আমার ইচ্ছাধীন ।তুই ছাইপাঁশ গিলে তো লিভারটার বারোটা বাজিয়ে ছাড়লি - অসুস্থ হইলে কে দেখবে রে ? তখন তো আমাদের ঘাড়ে এসে পড়বি । পিন্টু ও উত্তর দিয়েছিলো না তোমাদের ঘাড়ে পরতে আমার বয়েই গেছে , পরলে দাদাদের ঘাড়ে পড়বো ।
সত্যিই তো ও কথা রেখেছে , পড়লো না বিছানায় । এতো যে ঘৃণা কুড়িয়েছে তবুও পিন্টু যে কোন লোকের প্রশংসা করতো । বলতো নিন্দা করতে করতে আর দোষ দেখতে দেখতে তোদের চোখে শুধু দোষের দিকটাই ধরা পড়ে , গুণ টা দেখতে পাস না । অথচ সবার সাথে ওর সখ্যতা, ভালোবাসতো সবাই । মদ খেয়ে কোনোদিন বাইরে ঝামেলা করেছে বলে কেউ জানে না । দাদাদের প্রশংসা করতো সবসময় । ডায়না - স্টিফেন রা সবে ঘুম থেকে উঠেছে । বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হয়েছে এ বাড়িতে , সব চুপচাপ ।
বড়দা বাইরে গিয়েছিলো , একটা গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে । বড়দা ইন্সপেক্টর কে নিয়ে ভেতরে এলেন । ইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় হ্যাং হয়েছে ? চলুন দেখি । এই প্রথম বৌদিরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো - আর কাঁদলো ওর প্রিয় ডায়না , স্টিফেন , গোগলরা । পিন্টু লাশ হয়ে গেলো । একটা চিরকুট পাওয়া গেলো পকেটে , তাতে লেখা -" হ্যাঁ আমি জমিদারের মতই বাঁচলাম । চলে গেলাম জমিদারের মতই । তোরা এই অপদার্থটাকে ভুলে যাস। তোদের সব কথা বুঝেও আমার নেশাটাকে ছাড়তে পারিনি। গোগল বড় হচ্ছে তো - তাই আমার থাকা টা আর ঠিক না মনে করেছিলাম । চললাম ।
যখন ওকে বের করা হচ্ছিলো পোস্ট মর্টেমের জন্য তখন ওর প্রিয় কুকুর জ্যাকিও কেঁদে উঠলো ।
কমল দাস
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন