রিয়া চক্রবর্তী



ছোটো গল্প আর রবীন্দ্রনাথ আজ প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। বাংলা ছোটগল্পের শুরু এবং ও একি সঙ্গে পরিণতিও রবীন্দ্রনাথেই। এই সাক্ষাৎকারটিতে তাঁর ছোটো গল্প আর তাঁর পটভূমি  সম্পর্কের কথা বলেছেন। ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ৪ জন হিন্দিভাষী লেখক শ্রী চন্দ্র গুপ্ত, শ্রী সুদর্শন, শ্রীমতী সত্যবতী দেবী, শ্রী বনারসী দাস চতুর্বেদী শান্তিনিকেতনে কবির সাথে দেখা করতে আসেন। ভারতের ‘ফরোয়ার্ড’ পত্রিকায় সেই সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয় ২৩ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৩৬ সালে। ইংরেজি সাক্ষাৎকারটির বাংলা তর্জমা এটি।

সুদর্শন : আপনার গল্পের পটভূমি এবং উৎস সম্পর্কে আমাদের অনুগ্রহ করে কিছু বলুন।

কবি রবীন্দ্রনাথ : “ছোটো গল্প আমি লিখতে শুরু করেছিলুম একেবারে যৌবনে। জমিদার হওয়ার কারনে আমাকে নানান গ্রামে জেতে হতো এর ফলে আমি গ্রামের মানুষের আর তাদের সাধারণ জীবন- যাপনের সংস্পর্শে আসতে পেরেছি। উপভোগ করতুম গ্রামবাংলার আপন সৌন্দর্য আর আশেপাশের দৃশ্য। এই প্রদেশের শ্রেষ্ঠ অংশ নদীমাতৃক বাংলাদেশ আমাকে মুগ্ধ করেছে। এবং এই নদীগুলো আমি ভাল করেই চিনি। যে সব মানুষের জীবন আমি দেখেছি তা আমাকে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করেছে। আমার প্রথম দিককার গল্পগুলোয় এই পটভূমি রয়েছে আর সেগুলতে গ্রামের মানুষের আমার যোগাযোগের কথা আছে, তাদের মধ্যে যৌবনের একটা সজীবতা রয়েছে। সন্দেহ নেই যে এর আগে বঙ্কিমচন্দ্র কিছু লিখে গেছেন কিন্তু সে গুলো রোমান্টিক ধাঁচের আর আমার গুলোয় আছে গ্রামের মানুষের জীবনাচরণ। ফলে আমার গল্পগুলো যখন আবার পড়ি তখন প্রথম দিককার গল্পগুলোর যে সুন্দর আবহ তা আমার কাছে ফিরে আসে। এর অনেক গুলোই আমি বিস্মৃত হয়েছি – দুর্ভাগ্য, আমার স্মৃতিশক্তি তেমন ভালো নয় এমন ও হয় আমি আমার একদিন আগের লেখাও ভুলে যাই। আমার শেষের দিককার গল্পগুলোয় কিন্তু প্রথমদিককার অই সজীবতা, কোমলতা নেই।

চন্দ্রগুপ্ত : আপনি আপনার কোন গল্পটিকে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচনা করেন ?

কবি সহাস্যে জবাব দিলেন : না, আমি তা বলতে পারি নে। এগুলোর মধ্যে অনেক বৈচিত্র্য আছে। কবি বললেন তাঁর অন্য একটি গল্পের উৎস ও গ্রামীন জীবন। গল্পে বর্ণিত ওই রকম একটি মেয়ে আসলে আমি এক গ্রামে দেখেছিলুম। মেয়েটি ছিল অত্যন্ত দুরন্ত স্বভাবের, অসাধারণ এক মেয়ে। তার দুরন্তপনার বাঁধা দেওয়ার কেউ ছিলো না, সে আমাকে প্রতিদিনই দূর থেকে দেখত আর মাঝে মাঝে অল্প বয়সী একটি বাচ্চা নিয়ে আসতো আর বাচ্চাটাকে আঙুল দিয়ে আমাকে দেখাত। দিনের পর দিন সে আসত, পরে একদিন সে আর এল না। গ্রামের যে মহিলারা নদী থেকে জল নিয়ে আসতো ওই দিন তাদের কথা শুনেছিলুম। তারা ওই মেয়েটির ভাগ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আলাপ করছিল। কারন মেয়েটির তখন শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তারা বলল “ও যারপরনাই দস্যি মেয়ে। কিভাবে চলাফেরা করতে হয় তাও জানেনা। অর যে কি হবে”। পরের দিন আমি নদীতে একটি ছোট্ট নৌকা দেখতে পেলুম হতভাগ্য মেয়েটিকে জোর করে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। পুর দৃশ্যটাই ছিল বিষাদ আর বেদনাঘন। অন্যরা যখন অভয় দেওয়ার জন্য উৎসাহ যোগাচ্ছিল তখন অর মেয়ে সঙ্গী সাথীরা গোপনে চোখের জল ফেলছিল। নৌকাটি অদৃশ্য হয়ে গেল। এটাই ছিল আমার ‘সমাপ্তি’ গল্পের পটভূমি। এক পোস্টমাস্টার ছিল সে প্রায়ই আমার কাছে আসত। দীর্ঘদিন তাকে তার এলাকা থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল। সে আবার তার সেই পুরন এলাকায় ফেরার অপেক্ষায় ছিল। কর্মস্থল তার পছন্দ ছিল না। তার মনে হয়েছিল বর্বরদের মাঝে তাকে বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে। এ জায়গা ত্যাগ করার ইচ্ছা তার এতই প্রবল ছিল যে সে পদত্যাগ করার কথাও চিন্তা করল। সে প্রায়ই আমাকে তার গ্রামজীবনের ঘটনাবলীর কথা জানাত। এইভাবেই ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের একটি চরিত্রের জন্য রসদ জুগিয়েছে।

চতুর্বেদী জিজ্ঞেস করলেন : ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে কি বোঝাতে চেয়েছেন?

কবি : এই গল্পটি কল্পনা করে লেখা। কাবুলিওয়ালা নিশ্চয়ই ছিল।আমাদের বাড়িতে এক কাবুলিওয়ালা আসত এবং সে আমাদের এখানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। আমি ভাবলাম অর ও নিশ্চয়ই দেশে একটা মেয়ে আছে আর তার কথা অর মনে পড়ে।

চতুর্বেদী : কাবুলিওয়ালা গল্পের সেই অংশটা আমার বিশেষ করে ভালো লেগেছিল যেখানে মেয়েটিকে বলছে যে সে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে।

কবি : আমাদের এখানে জেল খানাকে শ্বশুরবাড়ি হিসাবেও উল্লেখ করা হয়। আপনাদের ওখানেও কি তাই? একসাথে সবাই হেসে উঠলে তার মধ্যে একজন বললেন, ‘আমাদের ওখানেও একে শ্বশুরালয় বলা হয়’।

চন্দ্রগুপ্ত : আপনার শেষের গল্পগুলোতে নতুন শৈলী নিয়ে এসেছেন। আপনার প্রথমদিককার গল্পগুলোকে আপনি এখন কিভাবে দেখবেন ?

কবি : “আমার শেষের গল্পগুলোতে সেই সজীবতা নেই। যদিও এদের একটা বড় ধরনের মনস্তাত্ত্বিক মূল্য আছে এবং গল্পগুলো বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে লেখা। যৌবনে আমি যা কিছু দেখতাম তা-ই আমার কাছে বেশ গভীর বেদনা নিয়ে হাজির হতো আর তাই আমার প্রথম দিককার গল্পগুলোর স্বতঃস্ফূর্ততার কারনে একটা বড় ধরনের সাহিত্যমূল্য রয়েছে। আমার জীবনের কতগুলো পর্যায় আছে আর আমার সব লেখাগুলোকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে। এগুলো বিভিন্ন পরবের ভিন্ন ভিন্ন সেন্টিমেন্ট প্রকাশ করেছে। আমরা সবাই এই জীবনেই নানা ধরনের জীবন পেয়ে থাকি। আমরা এই জীবনেই বারবার জন্মাই। জীবনের একটি পর্ব থেকে বেড়িয়ে আসার পর মনে হয় আমরা যেন আবার জন্ম গ্রহন করলাম। এই ভাবে আমাদের সাহিত্যিক জন্মও বারবার হয়। আমার ক্ষেত্রে পার্থক্য এত বেশি যে আমার প্রথমদিককার জন্মগুলোর কথা আমি ভুলেই গেছি এবং শেষবার আমি যখন আমার প্রথম পর্বের গল্পগুলোর প্রুফ দেখছিলাম, মনে হচ্ছিল এগুলোর মধ্যে একটা সজীবতা ছিল। মনে হল এরা যেন ছায়াময় কোনো অতীত থেকে আসা। তাদের মধ্যে একটা অস্পষ্টতা ছিল এবং দিল্লীতে একটা মেয়ে যে রকম তার অতীত জীবনকে স্মরণ করে আমার প্রথম পর্বটিও সে রকম মনে হয়”।






রিয়া চক্রবর্তী রিয়া চক্রবর্তী Reviewed by Pd on মে ০৯, ২০১৫ Rating: 5

1 টি মন্তব্য:

  1. সুন্দর তর্জমা। ভালো লাগলো। বেশকিছু বানান ভুল রয়েছে। সংশোধন করে নিলে আরোও ভালো হবে। শুভেচ্ছা।

    উত্তরমুছুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.