(সর্বভারতীয় পত্রিকা, দৈনিক ভাস্করের ২০/১১/২০১৪ তারিখের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা সংবাদ অবলম্বনে লেখা গল্প)
মধ্যপ্রদেশের মণ্ডলা জেলার কানহা এক টাইগার প্রজেক্ট। বাঘের জন্যে নির্দিষ্ট জঙ্গল তো আছে, তবে এমন বাধা নিষেধ আছে কি জঙ্গলের বাইরে বাঘ বেরোতে পারবে না ? রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে অঞ্জনিয়া গাঁও। সেখান থেকে আর দু কিলোমিটার দূরে সিরিংটোলা গাঁও। এখানকার পঞ্চাশ বছর বয়সের প্রৌঢ় সারদা মারকাম। তাকে নিয়েই এই ঘটনা।
মারকামের কেউ ছিল না। গাঁয়ের এক কোনে তার ঘর। স্ত্রী মারা গেছে। স্ত্রীর চিকিৎসায় সে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছিল। অনন্যোপায় হয়ে সে বেঁচে থাকা একটুকরো জমি চাষবাস করে আর কিছু ছাগল পালে। মারকামের পালা ছাগলের ওপরে বেশ মায়া ধরে গেছে। বাচ্চাগুলি নিয়ে ও আদর করে। সময়ে ওদের সঙ্গে ও কথা বলে, খেলা করে।
প্রতিদিনের মত সেদিনও সে দু এক ঘণ্টার জন্যে ঘুরতে গিয়েছিল। ঘুরতে গিয়েছিল গ্রামের দু এক ঘরে। গ্রামের লোকদের মুখেই মারকাম শুনল, আশপাশের গাঁয়ে নাকি বাঘ ঘুরছে ! অঞ্জনিয়া গায়ে নাকি বাঘে বাছুর মেরেছে। রাতবিরেতে কেউ আর ঘরের বাইরে বেরয় না। গায়ের বৃদ্ধ, নস্কর খুড়ো বলেছিল, দেহ শারদ, বাঘের উৎপাত কিন্তু ধারে কাছে শুরু হইসে, পাশের গ্রামের মন্টুর ছেলেরে নাকি বাঘে দৌড়াইসে।
--হ্যাঁ, মৌসা জী, আমাগো সাবধান হইতে হইব।
--তুমি গাঁয়ের শেষে থাহ, তার উপরে, তোমার ঘরে ছাগলের পাল আছে ! সব সময় নজরে নজরে থাকবা !
সে দিন ছিল মঙ্গলবার। মারকামের কোন বাড়িতে রাতে নেমন্তন্ন ছিল। রাতের শেষ পাতের খাওয়া সেরে অনেক দেরী হয়ে গেল। ধীর পায়ে সে ঘরের দিকে হাঁটছিল। চলতে চলতে তার নাকে বিশ্রী একটা পচা গন্ধ ঠেক ছিল। ঘর থেকে তখন বেশ অনেকটা দুরে সে, তার কানে এলো দাপাদাপির শব্দ সে সঙ্গে ছাগলের ভ্যাঁ ভ্যাঁ চীৎকার ! ভয়ে তার শরীর শিউরে উঠলো, তবে কি তার ঘরে সত্যি সত্যি বাঘ ঢুকে গেছে ! ঊর্ধ্বশ্বাসে সে ছুটতে লাগলো ঘরের দিকে। ছাগলের ভীত সন্ত্রস্ত ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘরে তিনটে বাচ্চা ছাগল, আর বড় ছাগলও তিনটে। মারকামের চোখে পড়লো, ঘরের দরজা হাট হয়ে খোলা, এক দিকের দরজার পাল্লা খুলে ঝুলে পড়েছে। তবে টেমির আলোটা বরাবরের মতই আলো দিচ্ছে।
--আমার ছাগল! মারকামের মুখ থেকে অজান্তেই কথাগুলি বেরিয়ে এলো ! ও চীৎকার করে উঠলো, বাঘ, বাঘ, আমার ঘরে বাঘ পড়ছে...
মারকামের নিজের জানের ভয় নাই, তার আদরের ছাগলের বাচ্চাগুলি যদি খাইয়া যায়, তবে ? আর সে চিন্তা করতে পার ছিল না। দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে সে নিজের প্রাণের কথা ভুলে ঘরের দরজার কাছে এলো। প্রথমটায় কিছুই সে ঠায়র করতে পারল না, দেখল ওর ওই কালু লালু দুই বাচ্চাকে বাঘে মেরে ফেলেছে। ওদের আধ খাওয়া শরীরটা ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে। বাঘ তখন একটা বড় ছাগলকে মাটিতে ফেলে তার টুটি কামড়ে ধরে আছে। মারকাম মনে ভীষণ ব্যথা পেল। সে জ্ঞানহীন হয়ে ছুটে গেল বাঘের দিকে। ছাগলকে বাঁচাতে সে বাঘের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পঞ্চাশ বছরের মারকাম নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাঘের মোকাবেলা করতে লাগলো। একবার বাঘ গর্জে উঠছে, একবার মারকাম বাঘকে ভয় দেখাবার জন্যে চীৎকার করে উঠছে। বাঘ থাবার পর থাবা বসিয়ে যাচ্ছে মারকামের গায়ে। মারকাম বাঘের চোখে মুখে গায়ে চর, ঘুসি, থাপ্পড় মেরে চলেছে। তখন বাঘে মানুষে চলছে ভীষণ লড়াই--এ যেন আখড়াতে চলছে আমরণ দুই মল্ল যোদ্ধার কুস্তি !
গ্রামের লোকেরা দুরে দাঁড়িয়ে শুধু আন্দাজ করছে বাঘ নিশ্চয় মারকামকে এত সময় মেরে ফেলছে। ওরা কেউ ভয়ে এগোতে পারছে না। মারকাম অন্ধের মত সমস্ত শক্তি দিয়ে বাঘকে জড়িয়ে ধরেছে। বাঘ নিজেকে ছাড়াতে সমানে থাবা মেরে চলেছে মারকামকে। এমনি আধা ঘণ্টা চলল বাঘে মানুষের লড়াই। অবশেষে এক সময় বাঘ হার মানল। মারকামের কবল থেকে ছুটে পালিয়ে সে ক্ষান্ত দিল লড়াই। মারকাম তখনও হিংস্র জন্তুর মত গজরাচ্ছে। সমস্ত শরীর তার রক্তাক্ত। মানুষের এ ধরণের ব্যবহার, চরম হিংস্রতার ছবি বাঘ কখনও দেখেনি হবে। সে তাই হয়ত রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেল !
এতক্ষণ পরে গ্রামের লোকরা হই হই রই রই করে মারকামের ঘরে গিয়ে ঢুকল। মারকাম তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। সে অসম্ভব শব্দ করে জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। সমস্ত শরীর তার রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এক সময় জ্ঞান হারাল মারকাম। গ্রামের লোকরা তাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দিল। একদিন পরে মারকামের জ্ঞান ফিরল। ওর কালু লালু ভলুকে বাঘে মেরে ফেলেছিল।একটা বড় ছাগলও মারা পড়েছিল। ওদের বাঁচাতেই তো ছিল তার এই জীবন মরণ লড়াই!
তাপসকিরণ রায়
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন