
গল্পকার, প্রকাশক, ঔপন্যাসিক এবং সম্পাদক শীর্ষেন্দু দত্তর জীবনটাও শুনেছি খুব বর্ণময় ... আপনার জন্ম , স্কুলিং এবং প্যারেনটেজ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন ...

আমার জন্ম জামসেদপুরে , ১৯৬৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর , ওখানকার টাটা মেন হসপিটালে ,স্বাভাবিক ভাবেই আমার পড়াশুনো শুরু হয় ওখানকার প্রাইমারি স্কুলেই , বাবা ছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার , ওখানকার এমপ্লয়ি , আমার চার বছর বয়সে বাবা মারা যান , মা তখন আমাকে নিয়ে কলকাতার বিধান সরণিতে , ঠনঠনের কালীবাড়ির পাশে একটা ফ্ল্যাটে চলে আসেন , আমরা দুজনে আর সকলের থেকে আলাদা হয়ে বেড়ে উঠি । এখানে এসে স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল নামে একটা মিশনারি স্কুলে আমি ভর্তি হই । আমার বাবা মারা গেছেন শুনে স্যাররা আমাকে বিনে পয়সায় পড়াতেন । এটা আমার খুব সৌভাগ্য । নইলে তখন আমাদের যা অবস্থা , এই স্কুলে আমি পড়তে পারতাম না । একদা বিখ্যাত কবি অভীক মজুমদার ছিলেন এখানে আমার সহপাঠী । তার বাবা , আশিস মজুমদার , বাংলার স্যার ছিলেন আমার বাংলা নিয়ে নাড়াচাড়া করার , লেখা লেখির জগতে আসার প্রেরণা । ওনার সাথেই তখন আমার বেশি দোস্তি ছিল । আমার প্রথম লেখা ক্লাস টেনে , ছেড়ে যেতে মন খারাপ গোছের একটা কবিতা লিখে স্কুল ম্যাগাজিনের ড্রপ বক্সে পোস্ট করেছিলাম । তারপর ভুলেও যাই । ক্লাস ইলেভেনে আশিস বাবুর কাছে পড়তে গেছি । উত্তর কোলকাতায় তাঁর বাড়ির ছাদে প্রায় শপাঁচেক টব ছিল । সেরকম গাছে ঘেরা একটা ছাদে পড়ানোর সময় একদিন বললেন , ‘আজ আমি তোমাদের একটা কবিতা শোনাবো ।‘ এখানে জানিয়ে রাখি , প্রচণ্ড মারকুটে বলে আমার একটা ইমেজ ছিল , মোটামুটি পাড়ার এক নম্বর মস্তান , মাঝে মাঝেই কোচিংএ মারপিট হোতো , স্যারকে গিয়ে অনেকসময় ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হোতো । স্যার আমায় প্রচণ্ড ভালোবাসতেন । বছরে তিনবার আমার জন্মদিন হোতো , আর স্যার আমায় মিষ্টি কিনে খাওয়াতেন । আমি বলতাম , ‘স্যার , আজ আমার জন্মদিন’। স্যার বলতেন , ‘এই না দু মাস আগে তোর জন্মদিন গেল’। আমি বলতাম , ‘না , ওটা দেবজিতের’। এরকম হোতো আর কি । তো স্যার কবিতাটা পড়ার পর বললেন , ‘তোমরা কি জানো , কবিতাটা কার লেখা’? তারপর বেশ নাটকীয় ভাবে পাইপে পাঁচবার টান দিয়ে বললেন , ‘সেই লেখকের নাম হচ্ছে শীর্ষেন্দু দত্ত , তোমরা শুনে নিশ্চয় খুব অবাক হয়েছ , আমিও অবাক হয়েছিলাম , কিন্তু নাম রোল সেকশন সবই তো মিলে যাচ্ছে , ওটা ও ছাড়া আর কেউ হতে পারে না । ও কেবল মারামারিই করে না , কবিতাও লেখে ! ও খালি পকেটে ক্ষুর নিয়েই ঘোরে না , কলম নিয়েও ঘোরে!’ তো সেই আমার প্রথম লেখা । শুনে মেয়েরা দেখি হেসে এ ওর ঘাড়ে গড়িয়ে পড়ছে , কোচিং এ মেয়ের সংখ্যাই বেশি ছিল । আমি এমনিতেই কোণার দিকে বসতাম , যাতে স্যারের চোখে না পড়ি , আরও নিচু হয়ে মিশে যেতে লাগলাম । পরে কলেজ ম্যাগাজিনে লিখি । স্যার , লেখা আর স্কুলের একটা সংযোগ রয়েই গেল । পরে স্যার প্রতুলের ক্যাসেট ‘বাংলায় গান গাই’ তখন প্রথম বেরিয়েছে , সেটা নিজে হাতে লিখে , ‘শীর্ষেন্দুকে স্যার’, বলে গিফট করেন । ওটা আমার কাছে এখনও আছে ।
অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম আড্ডা দেব । এতদিনে সম্ভব হোল । আপনার সাথে আলাপ হবার পরও আপনার একটা বই বেরিয়েছে , শুরু করেছিলাম আপনার ‘বৃত্তের মধ্যে’ দিয়ে , যেটা একটা উপন্যাস , সম্প্রতি বেরিয়েছে , ‘আমার নাম আইরিন’, একটি গল্প গ্রন্থ । কোথাও কি একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হোল ? নাকি এটা একটা বৃত্তের ‘জ্যা’ মাত্র ?
হ্যাঁ , একটা বৃত্ত তো বটেই । প্রসঙ্গক্রমে বলি , আমি মূলত গল্পকার । কিন্তু আমার মধ্যে এমন কিছু জিনিস আছে যা গল্প নিরপেক্ষতাকে পোক করে বা বাধা দেয় । আমার মূল কাজ আমি মনে করি গল্প লেখা । কিন্তু কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছিলো নিরপেক্ষ থাকতে । আমার মনে হোল , এগুলো উগরে দেওয়া দরকার । কেউ একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে , আমি গল্প যেভাবে বলি , উপন্যাস সেভাবে বলি না । উপন্যাস গুলোতে সেই বৃত্তের কনসেপ্টটাই যেন পূর্ণতা পায় । ‘বৃত্তের মধ্যে’, উপন্যাসটি অনেকটাই আত্মজৈবনিক । বৃত্ত সম্পর্কে আমার কনসেপ্ট একটু অন্যরকম । একটা বিন্দু থেকে শুরু করে আবার সেই জায়গাতেই ফেরত আসতে হবে এমন নয় । সেটা অর্ধেকও হতে পারে , কিন্তু সেটা একটা বৃত্ত । আমার একটা গল্প আছে । ‘হাফলাইফের গল্প’। একটা মানুষ দুটো অর্ধে বাঁচে । একেকজনের কাছে সময়টা একেকরকম । ধরা যাক , একটা মানুষ যদি আশি বছর বাঁচে , তার ষাট বছর একরকম , আবার আফটার রিটায়ারমেনট সে হয়তো অন্যরকম বাঁচল । আমি সেরকম মনে করি না , আমি মনে করি একদম অর্ধেক করে কাটা উচিত । আমার জীবনের একটা অংশ ধরুন আমি পড়াশুনো করলাম , সাংসারিক দায় দায়িত্ব পালন করলাম , আমার সমস্ত ডিউটিস অ্যান্ড রেস্পন্সিবিলিটিজ পালন করার পর একটা সময় আমাদের নিজের জন্য বাঁচা উচিত । এটা একটা কনসেপ্ট , আমি এটা করতে চাই । কিন্তু সবসময় এটা এমন ভাবে হবেই তা নয় । আবার ধরুন , এমনও বলা হয় যে , জীবনটা একটা চাকা , তুমি যদি এখন ভালো থাকো পরে কষ্টে থাকবে , আবার এখন যদি কষ্টে থাক , পরে ভালো সময় আসবে । আমি আমার এই ‘হাফলাইফের গল্প’ টা খানিকটা বদমায়েশি করেই ‘দেশ’, এ পাঠিয়েছিলাম , সেটা ছাপাও হয়েছিল । এটা একেবারেই লিটিল ম্যাগাজিনের গল্প । আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে , ওরা ওটা ছাপবে না , পরে আমি ওটা নিয়ে ক্রিটিসাইজ করবো । এটা আসলে একটা গুরুত্বপূর্ণ থিয়োরি । একটা মানুষ চাকরি করছে , ছেলেপুলে মানুষ করছে , টাকা জমাচ্ছে , ভবিষ্যতে ভালো থাকবে বলে বা ছেলেপুলে তার পাশে দাঁড়াবে বলে । সে জীবনের একটা সময় সাক্রিফাইস করছে পরবর্তী সময় ভালো থাকার জন্য । সাধারন মানুষ এভাবেই ভাবে । এবার এমন কি কেউ ভাবে , যে এখনতো নিজের ইচ্ছে মতো বেঁচে নি , পরে যা হবার হবে ? আসলে , জীবনের এই দুটো ভাগের কোনটা আমি আগে করবো বা পরে সেটা আমার ব্যাপার । এছাড়া আমার একটা মৃত্যুভাবনা আছে , প্রায় পঁচিশ তিরিশটা গল্প আছে এই বিষয়ক । ব্যাপারটা আমি খুব সিরিয়াসলি ভাবি ।
আমি একা থাকতে পছন্দ করি না । নিঃসঙ্গতা আমি ঘোরতর অপছন্দ করি । ভয় নয় কষ্ট পাই একা থাকতে । এজন্য কোথাও কিছু করার না থাকলে আমি ফেসবুক অন করি । নির্দিষ্ট কেউ নেই কিন্তু এতগুলো লোক ইন্টারলিঙ্কড রয়েছে ভাবতে ভালো লাগে । আমি মানুষের মধ্যে থাকতে ভালোবাসি । বলবেন , যে সৃষ্টিশীলতার জন্য নির্জনতা জরুরি , এটাও সত্যি , আমিও নির্জনে সৃষ্টি করি , কিন্তু আমি একা থাকতে পারি না কখনও ।
ভবিতব্য ঠিক নয় , আসলে সবাই যেমন ভাবে আসে আর কি , আমরাও কিছু স্বপ্ন দেখতাম । বিবেকানন্দ যেমন বলে গেছেন , ‘একটা দাগ রেখে যাবি’,আমিও তেমনি দাগ রাখতে চেয়েছিলাম । আসলে মনে হয়েছিল অন্য সমাজ সেবার একটা লিমিটেশন আছে , কোথাও গিয়ে আটকে যেতে হয় । সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল মানুষের সাথে মিশে মানুষের জন্য কিছু করা উচিৎ , আর এটা এমন একটা জায়গা যার মাল্টিডাইমেনশনাল স্কোপ আছে । আমার খুব সায়েন্টিফিকালি মনে হয়েছিল জা লেফট রাজনীতিটাই করা উচিৎ । করেওছিলাম তাই । এবার আমার একটা বদনাম আছে । এই যে আমার নানা রকম পেশা বদল , নানান রকম কাজকর্ম , লোকে বলে , ‘শীর্ষেন্দু লেখার জন্য এসব করে । এটা কিছুদিন , ওটা কিছুদিন , আসলে এটা ওর একটা মিশন , কয়েকটা লেখা নামিয়ে দেবে , এটা ছেড়ে দেবে অন্য কিছু করবে ‘। আমি এ নিয়ে কিছু বলব না, হয়তো আমার অজ্ঞাতসারেই এটা হয় ।
এভাবে বছর ধরে বোঝানো মুস্কিল । অথচ বদলের অনেক উপাদান ছিল । কিন্তু তার এফেক্ট তেমন কিছু দেখি নি । উপাদান মানে চারবছরে কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে নির্মাণের ক্ষেত্রে বদলের কিছু স্কোপ ছিল । আমি নিজে সেটা চেষ্টা করেছি এটুকু বলতে পারি । চার বছরে অনেক মানুষের অনেক রোল বদলেছে । কিন্তু একজন মানুষের মূল যেটা কাজ , যেমন একজন ফিল্ম মেকার বিশেষ একটা ফিল্মের কথা ভাবছেন , একজন লেখক বিশেষ একটা লেখার কথা ভাবছেন , একজন কবি বিশেষ একটা কবিতার কথা ভাবছেন , চার বছরে এটা আমার মনে হয় নি ।
না, লবিবাজি ছাড়া সেভাবে নাম করা যায় না , এটা বলা যায় । বা বলা যায় , জীবিতাবস্থায় নাম থাকে না । তবে লেখা তো আর গান না , যে ক্যাসেট সিডি নষ্ট হয়ে গেলে নেক্সট জেনারেশান লতা মঙ্গেশকরকে আর পাবে না । লেখাগুলো থেকেই যায় । জীবনানন্দের কথা ধরুন , কিম্বা মানিক , স্বীকৃতি বলতে পাঠকের স্বীকৃতি সেটা ঠেকিয়ে রাখা যায় না , সাময়িক ভাবে ব্লক করা যায় হয়তো , আবার ধরুন , এই মুহূর্তে যারা প্রতিভাবান , ভালো কাজ করছে , মাস তাদের কথা জানে না ।এটা পুরো কর্পোরেট সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ব্যাবসায়িক স্বার্থে ।
আপনি তো ছোটগল্প লিখিয়ে মূলত । ছোটগল্প লেখার বেসিক ফানডা টা কি ? বিশ্বসাহিত্য পড়তে হবে চুটিয়ে নাকি চোখ কান খোলা রাখা আর অনুভূতি ?
সবকটাই করতে হবে। আমাদের লেখালেখির যে ফর্ম গুলো আছে , সেখানে দুটো খুব পাওয়ারফুল। এক তো কবিতা , আর এক ছোটগল্প। ছোটোগল্প বলতে যা বোঝায় , সাইজ দিয়ে তো ছোটগল্প বিচার হয় না, সংজ্ঞা দিয়ে হয় ।
কিছুটা তো বানাতে হয় । আসলে আমাদের চোখের সামনে সবই আছে । আপনি তো কবিতা লেখেন । আপনি কি করেন , কতোগুলো বিবৃতি জড় করেন । কবিতা আমরা লিপির আকারে পড়ি । গল্প আমরা লিপির আকারে পড়ি । আমার গল্পের লাইন বা আপনার কবিতার লাইন আপনি নির্মাণ তো করছেন না । সেটা ছড়িয়ে আছে । এই মাঠ ঘাট পথ থেকেই তা কুড়িয়ে নিচ্ছেন । সেটা ভিসুয়াল ছিল , আপনি সেটাকে লিপির আকার দিচ্ছেন । গান যেমন , স্বরলিপি থাকে । সেভাবেই আপনি এটাকে সেট করছেন । কবিতা গল্পও তাই ।
আমরা ‘নতুন শতক’ যখন করছিলাম , একটা লেখক গোষ্ঠী তৈরি হয় । আরও অন্য অনেক পত্রিকা আসে , যেমন , ‘মনকলম’। আমরা একটা সময় ফিল করি , যে বই প্রকাশ করা দরকার , বিশেষ করে যারা কবিতা লেখেন , যারা ছোটগল্প লেখেন , তাদের ক্ষেত্রে সংকলন থাকাটা জরুরি । কোন একটা ম্যগাজিনে একটা কবিতা পড়ে , বা একটা গল্প পড়ে আমার সম্পর্কে খুব বেশিদূর ধারণা করতে পারবেন না । একটা লেখা হয়তো ভালো দেখা যাবে , নিরানব্বই টাই বাজে । কবিতার ক্ষেত্রেও ইনি কি ধরণের লেখেন বুঝতে হলে মিনিমাম দশ পনেরোটা লেখা পড়তে হবে , দশটা লেখা একটা ম্যগাজিন ছাপবে না , তাহলে একটা বই করতে হবে । আরও নানা কারণে হয়তো বই করতে চায় । ধরে নিচ্ছি শুধু শিল্পের প্রয়োজনেই কেউ একটি বই করতে চান । এবার নতুন যারা বই করতে আসেন প্রথমেই কলেজস্ট্রীট পাড়ায় গিয়ে ঠকেন । টেকনিক্যালি তার কোন নলেজ না থাকায় খরচা করার পরও তার প্রডাকশান খুব বাজে হয় । এবার পত্রিকা করতে গিয়ে আমাদের প্রডাকশান , প্রিন্টিং টেকনোলোজির সম্পর্কে একটা ধারণা হয়েছে । আমাদের মনে হয়েছে সম্মিলিত একটা উদ্যোগ নেওয়া দরকার । ধরুন , আপনি খরচা করে বই করবেন , তাহলে আমাদের কাছে আসুন , আমরা ঠিকঠাক জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছি । আপনি ঠকবেন না । আপনার তিনশো কপি বই নিয়ে আপনি বাড়ি চলে যান । এই ধারণা থেকেই প্রকাশনাটা আমরা শুরু করি । জীবনানন্দ সভাঘরে এর সূচনা হয় । সেই অর্থে কমার্শিয়াল প্রকাশক আমরা নই আর কি । গত চার পাঁচ বছরে বারোটা চোদ্দটা বই হয়েছে , আমাদের কাছে যারা এসেছে তাদের ভেতর থেকেই করেছি । আমরা সেভাবে কাউকে বলতে যাই নি ।
আপনার রাজনৈতিক বক্তব্য তো দেখি বেশ জোরালো । তো পুরস্কার টুরস্কার ফস্কে যাবে না ? শুভানুধ্যায়ীরা বলে না , ‘পথে এসো বাবা ‘?
পুরস্কার বলতে , আমার অনেক জুনিয়র লেখকের বাড়ি গিয়ে দেখেছি তাদের ঘর কাপ শিল্ডে ভর্তি । আর রাখার জায়গা নেই । মানে ফুটবল প্লেয়ার বা স্পোর্টসম্যানদের মত । আমার বাড়িতে এখনও অব্ধি একটা বোধহয় আছে । বইমেলায় একটা গল্পলেখার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম এবং ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম , পাঁচ হাজার টাকা । আজ অবধি আর কোন পুরস্কার পাই নি এবং পুরস্কার পাওয়াটা আল্টিমেট লক্ষ্যও নয় । কতলোক কত পুরস্কার পাচ্ছে , আমি মনে করি তাদের থেকে বেশী লোক আমাকে চেনে এবং আমার পাঠক বেশী আছে । পুরস্কার পেলে একটু আধটু ভালোই লাগবে , কিন্তু আমি নিজেকে কখনও পুরস্কারের কথা ভেবে গ্রুমিং করি নি , এম্নিতে আমি চেষ্টা করি যে যে কথাটা অপছন্দ করে তাকে সে কথাটাই বলার চেষ্টা করি ।
না , নেই । আমি মূলত লিটিল ম্যাগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েও কমার্শিয়াল ম্যাগ এও লিখি । ধরুন , ‘দেশ’ । আমি ‘দেশ’ কে গালাগাল করতে পারি তখনই , যখন লোকে দেখে লোকটার ‘দেশে’ তিনটে গল্প লেখার ক্ষমতা আছে । আমার যদি আড়াইশো টা গল্প লিখি তার মধ্যে তিনটে তো ‘দেশ’ এ । নাহলে বলবে যে , আঙ্গুরফল টক । পারে না । অক্ষমতা থেকে এটা হয় । ‘দেশ’ এই মুহূর্তে কমার্শিয়াল কাগজ গুলোর মধ্যে অগ্রগন্য । এখন আমি যখন ‘দেশ’ এর সমালোচনা করি বা এর কোন একটা দিক নিয়ে বলি , লোকে বলতে পারে না যে , পারে না তাই বলছে । আমি হয়তো পঁচিশটা লিটিল ম্যাগে লিখি । সাথে ‘দেশ’ এও । এই পঁচিশটা গল্প প্রমাণ করে যে , লোকটার লেখার ক্ষমতা আছে । এটা আমাদের লিটিল ম্যাগ আন্দোলনকে জোরদার ই করে । এটা তো ঠিকই ‘দেশ’ এর মত কমার্শিয়াল কাগজের পাঠক সংখ্যা বেশী । এখানে একটা পচা লেখার জন্যও লোকের ফোন বেশী আসে । এটা পাঠকের দুর্ভাগ্য । অস্বীকার করি না । এই দুর্দশাগ্রস্ত পাঠক সমাজের মধ্যেই তো আমি কাজ করছি ।
প্রকাশক হিসেবে তো খানিকটা তো দায়িত্ব পালন করছেন ই। সেটা কি আপনার লেখক স্বত্বাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না ?
উত্তরঃ আমাদের প্রকাশনায় গত এক বছরে কোন বই বের হয় নি । খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ কিছু করি নি প্রকাশনার । কেউ এলে আমরা করি। না এলে করি না ।
উত্তর ঃ সৃষ্টি তো থেমে থাকে না । এটা চলছেই । আমি বিশ্বাস করি আরেকটা নবারুণের জন্ম হবে। সে হয়তো আরও একশো বছর পর ।
সে আমি জানি না , এটা হয়তো পঞ্চাশ বছর পরও হতে পারে । লেখক হিসেবে শুধু নয় , ওনার সাথে আমার কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে । খুব কম লেখকের সাথেই লেখার সূত্রে এরকম থাকে । ওনার শেষ সংখ্যাটা যখন বের হয় ওনার তখন ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে । বাইরে যেদিন যাবেন তার আগের দিনের কথা । যাদবপুর স্টেশন চত্বরে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন একটা পায়জামা পরে । আমি আর সায়ন্তনি গেছিলাম। আমি জানতাম না ।ওনার পাড়াতেই ওনার বাড়ির খুব কাছেই থাকি । পাঁচ মিনিটের মধ্যেই । আমি বললাম , ‘কি ব্যাপার ? আপনি এরকম ঘুরে বেড়াচ্ছেন ?’ ওনাকে কখনো দেখিনি পায়জামা পরে বাড়ি থেকে অতদূর যেতে । বললেন , ‘শোন , তোর সাথে আমার দরকার আছে । আমি থাকবনা , আমার খুব শরীর খারাপ । কালকেই আমি দিল্লী চলে যাচ্ছি । তুই একটা গল্প আমার অফিসে পৌঁছে দিস।‘এমনিতে নবারুণদার সাথে আমার প্রচুর ঝগড়া প্রচুর ভাব হয়েছে । রাগ করে ওনার কাগজে অনেকদিন লিখি নি । আমি বলতাম , ‘আপনি কমার্শিয়াল কাগজ করেন , আমাকে পয়সা দিতে হবে’। উনি বলতেন , ‘না , আমি করি না । পয়সা দিতে পারবো না ।‘ আমি বলতাম , ‘তাহলে দশ কপি বই দিতে হবে’। এরকম আর কি । রাত্রিবেলা কতদিন ড্রিঙ্ক করে আমি এস এম এস করে নবারুণদা কে গালাগালি দিয়েছি । উনি পরদিন এসে চমকেছেন । মাঝে তিন বছর মুখ দর্শন করতাম না । হঠাৎ একদিন পাঁচ জায়গা থেকে ফোন এলো , ‘তোমাকে নবারুণদা খুঁজছে । তুমি দেখা কর । উনি তোমার নাম্বার হারিয়ে ফেলেছেন’। করতে করতে কোথা থেকে আমার নাম্বার পেয়ে কল করেছেন । আমি লেখা কেন দিই না , যে নবারুণদা কমার্শিয়াল কাগজ চালান , লেখার জন্য টাকা দিতে হবে । পাঁচটা লোক রেখে আপনি ম্যাগাজিন চালান , পাব্লিকেশান করেন , আপনাকে আমি বিনা পয়সায় দেব না । যাইহোক, এর পর দি এবং পরপর লাস্ট ক’বার লিখলাম । তারপর আর দি নি কারণ , আমার মনে হয়েছে , নবারুণদা না থাকলে আর যারা আছে, তাদের কাছে আমি নিজে হাতে করে লেখা নিয়ে যাবো না, এক নম্বর কথা , আর দুই হোল , আমার মনে হয়েছে যে , তারা আমার লেখার মূল্যায়ন করতে পারবে না , আমি তাদের যতটুকু চিনি । এই লেখাটাই ‘আমার নাম আইরিন’। লেখাটা আর দেওয়া হয় নি । নবারুণদা তখন খুব অসুস্থ , ভিতরে চলে গেছেন । পরে গল্পটা ‘দেখা’ বলে একটা পত্রিকায় বের হয় । প্রায় সাথে সাথেই সঙ্কলন হয় । নবারুণদার আমার সাথে শেষ কথা ছিল যে একটা লেখা দিস । এটা খুব মনে পড়ে । এটা আমার একটা খুব কষ্টের জায়গা রয়ে গেছে ।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কি নবারুণ স্কোয়াডের ফ্যাশান ? আপনি তো নিজেকে নবারুণ স্কোয়াডের সদস্য মনে করেন ... কি মনে করেন , ‘এই পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে ‘?
দেখুন আজ অব্ধি পৃথিবীর মুক্তি হয় নি , প্যারি কমিয়ুন বা ধর্মগুরুরা জা বলেন হ্যান ত্যান , আজ অব্ধি পৃথিবীর মুক্তি হয় নি । যুগে যুগে মানুষের সামনে একটা গাজর ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং সচেতন ভাবে সেই গাজরটার পেছনে আমরা ছুটে যাই । আসলে মুক্তি কোনদিন আসে না বা ঐ অর্থে মুক্তি বলে কিছু নেই । আমি যেদিন থেকে এই সিস্টেমের মধ্যে কাজ করছি , আমি অ্যারেস্ট হয়ে গেছি । মুক্তি টুকটি কিছু হয় না। কিন্তু কতগুলো কাজ আমাদের ভালো লাগে এবং মনে হয় যে এগুলো সঠিক কাজ , সাক্সেসফুল হোক না হোক আমি সেই কাজটা করবো । এই জায়গাথেকেই বামপন্থার কথা আসে। অনেকে বলে যে , সমাজতন্ত্র আমি মৃত্যুর আগে দেখে যাবো , বা অনেকে বলে আমার মৃত্যুর পর হবে । আমি বিশ্বাস করি না । আমি মনে করি এটা একটা সায়েন্স , এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দর্শন , এই দর্শন মেজর মানুষের কথা ভাবে , অতএব এর জন্য আমার কিছু করা উচিৎ । কোন লাভের আশা থেকে , বা কোন ফলের আশা থেকে করি না । অনেকে এটা বিশ্বাস করে যে এটা হবে , তাই করি । এই দিক থেকে আমি গীতা মেনে চলি , যে কর্ম কর , যে কর্ম মানুষের কম ক্ষতি করে , সব কর্মই কারো না কারো ক্ষতি করছে , তো সেই দিক থেকে সবচেয়ে যেটা কম ক্ষতি করছে , সেটার মধ্যে আমার থাকা উচিৎ এই বিশ্বাস করি । আমি জামন অন্য অনেক দিকে যেতে পারতাম , গ্রাফিক্স , বা ব্যাবসা , কিন্তু আমার মনে হয়েছে আমার কাজ হোল লেখা , এটাই আমি সবচেয়ে ভালো পারি । সাক্সেস নিয়ে ভাবি না , আমার মনে হয় আমার কলম খুলে বসা উচিৎ এবং আমার এটা করা উচিৎ । সাক্সেস আস্তেই পারে । এমনও হতে পারে আশি বছর বয়সে আমি নোবেল পেয়ে যেতে পারি , কিন্তু তারজন্য কমবেশি কিছু আমার হবে না । অনেকে খুব সচেতন ভাবে নির্মাণ করে , শব্দ ভাষা ইত্যাদি , তারা এটা ভাবে যে , এমন লেখা লিখবো যে ক্যালকাটা ইউনিভারসিটিতে এটা পড়ানো হবে , আমি সেসব কিছু ভাবি না । আমি ভাষায় স্ল্যাং নিয়ে ভাবি না । আমি মনে করি , এভাবে আমি বেঁচে আছি , আমি সেটাই লিখি । সেগুলোই দেখি অনেকের ভালো লাগে ।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে , ‘আত্মার সান্নিধ্য’ কে আপনার মহামূল্যবান সময় দেবার জন্য । ভবিষ্যতে আরও বড় করে আড্ডা দেওয়া যাবে , আরও অনেক কিছু জানার বাকি রয়ে গেল , এই স্বল্প পরিসরে তা সম্ভব ছিল না । যাইহোক আপনার লেখক জীবনের উত্তরোত্তর শ্রী বৃদ্ধি কামনা করি । ভালো থাকুন , সুস্থ থাকুন । আমরা অনেক পড়তে চাই আপনাকে ।
|
|
শীর্ষেন্দু দত্ত
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন