শৌনক দত্ত



১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের ধারে পিষ্ট সেইকালো মানুষগুলো তাদের ভাষা সংগ্রামে কি দিয়েছিলআর কি পেয়েছিল তা আমাদের অনেকেরই অজানা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আন্দোলনরত ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিল এবং ভঙ্গ করেছিল ১৪৪ ধারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। যার ফলাফল ছিল ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং সালাম, রফিক, বরকতের মতো ভাষাসৈনিকের শাহাদাত বরণ। অনেকটা তেমনভাবেই দক্ষিণ আফ্রিকার সয়েটো হাইস্কুলের কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করেছিল। ১৯৭৬ সালে সরকার আফ্রিকান ভাষাকে বাধ্যতামূলক করে স্ট্যান্ডার ও ফাইভ থেকে সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনার জন্য। সে সময় বলা হয় ওই শ্রেণীর অংক ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহƒত হবে আফ্রিকান ভাষা এবং ইংরেজি ব্যবহƒত হবে সাধারণ বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে। তখন সরকারের এ সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করে আফ্রিকান অভিভাবক, স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে সাংবাদিকরা পর্যন্ত। সবাই এ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট
ছিল এবং অনেক শিক্ষক আফ্রিকান ভাষায় শিক্ষকতা করতে পারবেন না বলে চাকরি ছেড়ে দেন।

অবস্থার অবনতি ঘটে ওই বছরেরই মাঝামাঝি সময়ে। পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরও ভয়াবহ যখন ছেলেমেয়েরা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল এ ব্যবস্থায় লেখাপড়া করতে। সে সময় দি ওয়ার্ল্ড নিউজ নামক সংবাদপত্রে একটি ছাত্রের বরাত দিয়ে লেখা হয়েছিলÑ ‘আমাদের অভিভাবকরা প্রস্তুত আছেন শ্বেতাঙ্গদের এ অত্যাচার সহ্য করতে। তারা তাদের জীবনের অনেকটা সময়ই পার করে এসেছেন এ আইনকে মেনে নিয়ে এবং তারা আর এখন এ শাসকগোষ্ঠীর কোন কিছুতেই ভীত নন। আমরা দৃঢ়ভাবে এই রায় প্রত্যাখ্যান করে বলছি যে এ শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা মেনে নেব না। এটির উদ্দেশ্যই হবে আমাদের নিজ জš§ভূমিতে ক্রীতদাস হিসেবে তৈরি করার।’ এছাড়াও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিটি বাচ্চার পড়াশোনার পাঠ্যবই, স্টেশনারি এবং স্কুলের ভবন তৈরিবাবদ তাদের মায়েদের বাৎসরিক বেতনের অর্ধেকটাই কেটে রাখা হতো সেখানে শেতাঙ্গ বাচ্চাদের জন্য কোনও খরচই ছিল না।

ওই বছরেরই ১৩ জুন তিশীতিশ মাসিনিনি নামক ১৯ বছরের এক যুবক একটি মিটিংয়ের আহ্বান করেন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। সেখানে তিনি এ শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সকলকে একসঙ্গে আন্দোলন করার আহ্বান জানান এবং তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, তাদের পরিবারকে এ পরিকল্পনার কথা জানাবে না।

অতঃপর ১৬ জুন, সওটনের স্কুলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর কুয়াশাকে উপেক্ষা করে সবাই উপস্থিত হল পূর্ব নির্ধারিত সময়ে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় ভিলাকাজি স্ট্রিটের অরল্যান্ডো ওয়েস্ট সেকেন্ডারি স্কুল থেকে তারা অরল্যান্ডো স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করবে। সেসময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সূত্রে জানা যায়, সেদিন প্রায় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজারের মতো স্কুলের পোশাক পরা ছাত্রছাত্রী ছিল। 

এ অবস্থা দেখামাত্র সেখানে পাঠানো হল একটি পুলিশ স্কোয়াড। তারা প্রথমে ছাত্রছাত্রীদের বাধা দেয়। তারা তা না শুনলে পুলিশ কিছু কুকুর ছেড়ে দেয় এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। ছাত্রছাত্রীরাও তার জবাব দেয় পুলিশের দিকে পাথর ও বোতল ছুড়ে। পরবর্তী সময়ে একজন সাংবাদিকের করা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সে দেখেছে একজন পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের মাঝে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাচ্ছে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আর একজনও শুরু করল যার ফলাফল ২৩টি শিশুর মৃত্যু এবং ২০০-এরও বেশি আহত। বারো বছর বয়সী হেকটো পিটারসন গোলমালের মধ্যে মারাÍক আহত হয়ে পড়ে আছে রাস্তায় আর তার পাশে কাঁদছে তার ছোটবোন। রাস্তার অপর পাশ থেকে ছুটে এসে পিটারসনেরই আর এক সহপাঠী তুলে নিয়ে গেল তাকে। আর এ দৃশ্যগুলো ক্যামেরা বন্দি করেছিল দি ওয়ার্ল্ডের ফটোগ্রাফার সাম নজিমা। পিটারসনের শেষ সময়কার সে ছবিগুলো ঘুরে বেড়িয়েছিল সারাবিশ্ব আর প্রতীক হয়েছিল জাতিগত বৈষম্যের নিষ্ঠুরতার। দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়লে সয়েটো এর বাইরের শহর যেমন উইটওয়াটারেসরানও প্রিটোরিয়া, ডারবান এবং কেপটাউনসহ বিভিন্ন জায়গায় এবং এটি আরও ভয়াবহ রূপ নিল। যার ফলাফল বছর শেষে মৃত্যু প্রায় ৫৭৫ জনের এবং আহত প্রায় ৩ হাজার ৯০৭ জন।

সে সময় সয়েটো এর ওই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতার প্রথম পদক্ষেপ ছিল। এর পর থেকেই তারা তাদের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন ও সংগ্রাম করতে থাকে বিভিন্ন সময়ে। যার ফলাফল আসে ১৯৯৪-এ তাদের স্বাধীনতা দিয়ে। ওই আন্দোলনের পর যে সুবিধাটি তারা সবার আগে পাই তাহল ছাত্রছাত্রীরা কোন মাধ্যমে পড়াশোনা করবে তা তারা নিজেই পছন্দ করতে পারবে। এছাড়া টিচারদের বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দিয়ে তাদের দক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থাও নেয়া হয়। ওই ঘটনার পর সয়েটোতে আরও অনেক স্কুল তৈরি করা হয় নতুন করে এবং অনেক শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে পরিবর্তনটি আসে তাহল বহু পুরনো সেই আইনকে বাতিল করে কৃষ্ণাঙ্গদের শহরে আসা ও বসবাসের সহ ব্যবসা করার স্থায়ী অনুমতি দেয়া হয়। 

যা আগে শুধু শেতাঙ্গরা পেত। এমনকি ডাক্তার, আইনজীবী ও অন্য পেশার মানুষ শহরে এসে ওই পেশা ধরে রাখতে পারবেন। সয়েটো আন্দোলনের ৩০ বছর পর ১৬ জন ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট থারো এমবেকি প্রতিষ্ঠা করেন হেক্টোর পিটারসেন মেমোরিয়াল এবং মিউজিয়াম। যার প্রবেশের মুখেই রাখা আছে সাম নজিমা এর সেই বিখ্যাত ছবিটি যার ক্যাপশনে লেখা আছে, ‘সেই যুবদের স্মরণে যারা প্রাণ দিয়েছিল মুক্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে।’

পরিচিতি
শৌনক দত্ত শৌনক দত্ত Reviewed by Pd on ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.