সুকান্ত সরণীর মোড়ে বিখ্যাত তেলেভাজার দোকানে মহিলাটির দিকে চোখ পড়তেই চোখটা আটকে গেল। কাঁচা-পাকা চুল টানটান করে বাঁধা। গভীর চোখের সেই দৃষ্টি ... যেটা একদিনের মধ্যেই ছবির মতো গেঁথে গিয়েছিল বুকের হার্ডডিস্কে । মেমরী ডিলিট হয়ে যায়নি আজও । ... নিজের বুকের ভিতরের শব্দটা যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছিল সুব্রত । ও দ্বিধাগ্রস্ত খানিকটা । ভীষণ চঞ্চল সুব্রত। এগিয়ে গিয়ে ধীরপায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালো... বুকের ভিতর হাতুড়ির শব্দটা যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছিল । ভদ্রমহিলা একটু তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল ...
- আপনার কাছে হাজার টাকার ভাঙ্গানী হবে ?
- সুব্রত হেসে বলল , না-নেইতো । আপনি একটু দাঁড়ান-আমি দেখছি , টাকাটা দিন অন্য দোকান থেকে আনিয়ে দিচ্ছি । ভদ্রমহিলার চোখে অবিশ্বাস ,ভয় দেখলো ও। সুব্রত অপমানিত বোধ করল- মনে করার চেষ্টা করল ও কী কারও সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ? না :- মনে করতে পারল না। গভীর চোখ দুটি তখনও তাকিয়ে আছে সুব্রতর দিকে। সুব্রতর আজ একটু জ্বর এসেছে । এই নিয়েও আজ বেড়িয়েছে আড্ডা দিতে । ছুটির দিনগুলিতে বিকেল বেলায় সুব্রত বন্ধুদের সাথে আড্ডা না দিলে ফাঁকা লাগে । অতসী চায় বেড়াতে যেতে। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর কিছুটা মনোমালিন্যও হয় । আজও হয়েছে ।আজ আর আড্ডায় যেতে ইচ্ছে করছিল না। ভদ্রমহিলা উল্টোদিকের গলিতে ঢুকে গেল ক্যারিব্যাগে কিছু জিনিস নিয়ে ... সুব্রত ভাবলো আজও যদি সেদিনের মতো জ্বর আসে ! আশ্চর্য্য জ্বর আসলেই একটা মেয়ের কথা মনে পড়ে। যতবার ওর জ্বর এসেছে কোন কোন সময় সেই পরিচয়হীনার কথা মনে হয় ওর । তখন সদ্য হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা শেষ হয়েছে । প্রচন্ড জ্বর এল ওর । বাড়িতে বাবা-মা আর বোন ছাড়া কেউ নেই । বাবার অফিস, মায়ের স্কুল , বোনের স্কুল -কাজেই কাজের মহিলা যাকে ও মণিমা বলে ডাকতো ছোটবেলায়- সেই মণিমা ওর অসুস্থতার শ্বশ্রুষার দায়িত্ব নিল ।
... মায়ের সঙ্গে ওর সম্পর্ক কোনদিনই ভালো না । কতবার ওর নিজের মায়ের মুখটা মনে করবার চেষ্টা করেছে মনে পড়েনি। এতই ছোট ছিল ও। ঠাকুমা বলেছিলেন ওর মা নাকি হাসপাতালে আছে... সুস্থ হলেই বাড়ীতে ফিরবে। ও প্রতিদিন ঠাকুরঘরে গিয়ে রাধাকৃষ্ণের ছবি অথবা মা কালীর ছবির দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করতো খুব তাড়াতাড়ি যেন মা ভালো হয়ে এসে বলে- এই তো আমি -তোর আর কোন কষ্ট হবেনা । ওয়ান-টুতে পড়ার সময় বাবাকে ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করত- মা কবে আসবে ? বাবা চুপ করে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ঠাকুমা বলতেন- আসবে দেখিস খুব তাড়াতাড়িই আসবে । কিন্তু মা এলেন আরও বছর দুয়েক পরে- একদিন সন্ধ্যাবেলায় । সুব্রত দৌড়ে গেল মার কাছে -ডাকল , মা! মা ! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? মা কোনও কথারই উত্তর দিল না। ঠাকুমা বললেন-হয়ত ভুলে গেছে -ক'দিন যাক ঠিক চিনবে । মা কে চেনাবার দায়িত্ব নিয়ে সারাদিনই মায়ের কাছ ছাড়া হতে চাইতো না সুব্রত। বুকের ভেতর থেকে একটা কান্না উঠে আসতে চাইতো । কাঁদতো না ও পাছে মা যদি খারাপ ভাবে । একদিন মায়ের পাশে বসেছিল। মা ওকে খুব জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো- এখানে কেন? যাও গিয়ে পড়তে বোসো । সেদিন ও খুব কেঁদেছিল -একা একা । ওর অভিজ্ঞতা ওকে বুঝতে সাহায্য করলো -এই মা ওর নিজের মা নয়- সৎ মা।
ক'দিন ওর আর জ্বর আসেনি। ডঃ বসু পরীক্ষা করে বলেছিলেন -টাইফয়েড । সে ভাবেই চিকিৎসা চলছিল । সকালে মণিমা বাবাকে বলেছিলেন ওঁর এক আত্মীয়ের বিয়েতে যেতে হবে । বাবা বলল- এখন তো ও আছে তুমি যাওনা।
-কিরে ? থাকতে পারবিনা একা একা ?
-সুব্রত বলল হ্যাঁ ,হ্যাঁ । এখন তো ভালোই আছি -মা আর বোন তো বিকেল পাঁচটার মধ্যেই ফিরে আসবে। শুয়ে শুয়ে গান শুনবো।
মণিমা খাবার ঢেকে রেখে-ওষুধ বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল । দুপুর বেলা সুব্রতর জ্বরটা ফিরে এল। বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করছিল না। বাথরুমে যাবার জন্য বিছানা ছেড়ে নামতেই মাথাটা ঘুরে গেল। তারপর জানালায় দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির তুলসী পিসীমার নাম ধরে কয়েকবার ডাক দিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখে তখন অন্ধকার । দূর থেকে কিছু শব্দ যনে হল ওর কানে ঢুকছে- এ্যাই মিতুল, মিতুল তাড়াতাড়ি আয় তো। সুব্রতর জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
...সুব্রত চোখ মেলতে পারছিল না। কিছুক্ষণ পর দেখল একটি কালো মত মেয়ে ওরই বয়সী হবে অথবা একটু কম...মমতা মাখা চোখে জিজ্ঞেস করল- একটু ভালো লাগছে ? ও উঠে বসতে চাইলে ধমক দিয়ে আবার শুতে বলল। ধমকটা এর খুব ভালো লাগলো । ও শুয়ে পড়লো চিৎ হয়ে । মেয়েটি নিঃশব্দে জল ঢালতে লাগল আগের মতো...কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল যাতে চোখে-কানে জল না যায় । একটা সময় মাথা মুছিয়ে বলল, শুয়ে থাকো । উঠো না । এবার আমি খেতে যাব। পরে আবার আসবো । পরম মমতায় যখন ও মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল তখন সুব্রতর খুব ছোট বেলার একটা স্মৃতি অস্পষ্ট- খুবই ক্ষীণ মনে পড়ছিল- যেন মা এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।
.........বাবা , মা ও বোন এসে সব তুলসী পিসীমার কাছে শুনলো। মা তুলসী পিসীমাকে একটু কথাও শোনালো একা একা দুপুরবেলায় মেয়েটিকে পাঠাবার জন্য । ..... সুব্রত এবার মেয়েটিকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। ক'দিন পর জ্বর থেকে উঠে তুলসী পিসীমাকে খানিকটা ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করল- মিতুল কোথায় ? ওকে তো দেখছি না । তুলসী পিসীমা উত্তর দিলেন- আরে ওরা তো পরদিন ভোরেই কুচবিহারে চলে গেছে। ওর বাবার সাথে এসেছিল। ওরা আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় । অফিসিয়াল কাজে এসেছিল ওর বাবা। মেয়েকে নিয়ে এসেছিল দেখা করে গেল ।
সুব্রত পড়াশোনা শেষ করে চাকুরী করছে । বিয়ে করেছে মধ্যমগ্রামে । শিলিগুড়ি কোচবিহার মালদা এসব জায়গায় ও চাকুরী সূত্রে ছিল । বাবার দেওয়া ওর নিজের মায়ের একটি ছবি ওর কাছে আজও আছে । সেই ছবির মায়ের চোখটা যেন মিতুলের চোখের সাথে অদ্ভুতভাবে মিলে গেছে। তুলসী পিসীমা ওদের কোনও হদিস দিতে পারেন বহু চেষ্টা করেও। ... সেই শুরু হল মিতুলের খোঁজ । আজ এখন এই শহরের এই রাস্তায় দেখা হওয়াটাই কি ওর জ্বর এনে দিল ওর শরীরে ? সুব্রত জানে না । অল্পবয়সী যুবকের মতো সব কিছু ভুলে ভদ্রমহিলার পিছু নিল সুব্রত। দেখল গলির ভেতর ঢুকে অপরিচিত চোখে কোন বাড়ি খুঁজছে ? সুব্রতকে জিজ্ঞাসা করল-
- আচ্ছা আপনি কি এখানে থাকেন ?
- হ্যাঁ । খানিকটা এগিয়ে ।
- আমি এখানে নতুন এসেছি আজকেই। আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া এখানে থাকতেন। আমি একবারই এসেছিলাম সেই স্কুলে পড়বার সময়-এখন চিনতে পারছি না। আমার সেই আত্মীয়ার হাসব্যান্ডের নাম অমিয়ভূষণ দে । একটু হেল্প করবেন ?
- আসুন আমার সাথে। আমাদের বাডীর পাশের বাড়ীটাই ওদের। তুলসী পিসীমা , পিসেমশাই তো কবেই চলে গেছেন- দুই ছেলে আছে । আসুন । সুব্রত ভদ্রমহিলার সাথে সাথে এগিয়ে গেট অবধি এগিয়ে দিল। ভদ্রমহিলা- যাঁর নাম মিতুল গেট খুলে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল- ধন্যবাদ। সুব্রতর কান্না পেল । বলতে পারল না , আমার জ্বর এসেছে ।
![]() |
| পরিচিতি |
কমল দাস
Reviewed by Pd
on
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন