ইফতেখারুল হক




বাহান্ন, একুশ, বাঙলা এবং বাঙালির আত্মপরিচয়ের কাল । ফেব্রুয়ারি মাস আসলে আমরা তাকে স্মরণ করেথাকি ।এই অতীত কালটিকে শুধু মাত্র ফেব্রুয়ারি আসলেই মনে পড়ে আমাদের । একুশের চেতনাকেবল আমাদের মনে জেগে ওঠে ফেব্রুয়ারি আসলেই; মনে পড়ে তার মায়াবী, করুণ দুর্দশাগ্রস্ত কাঠামোটিরকথা । যদিও শেষপর্যন্ত এই কাঠামোটিই আমূল বদলে দেয় একটি জাতির ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ । তৈরি করে এমন কাঠামোযা ভূমিকা রাখে বাহান্ন পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনের পেছনের শক্তি হিসেবে । আমরা পেয়ে যাই আমাদের দিশা ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে । আমরা এগিয়ে যাই কাল থেকে মহাকালের দিকে; শৈশব থেকে পূর্ণ যৌবনের দিকে । কিন্তু কথা হলোশুধুমাত্র একটি মাস বিবেচনায় নিয়ে বাহান্ন আর একুশকে বিচার করা যাবেনা । কেবল মাত্র একটি মাস আসলেই তাঁকে আমরা স্মরণ করবো আর তারপর সব ভুলে যাবো এমনটি হতে পারেনা । বাহান্ন আর একুশ আমাদের কাছে দাবি রাখে আরও বেশি কিছু ।দাবি রাখে, বাঙালি তাকে স্মরণ করুক ভোরের সূর্যালোক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতিদিন, প্রতিটি ক্ষণে । শ্বাসে এবং দীর্ঘশ্বাসে । বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি হোক প্রতিটি দিনের, প্রতিটি মাসের একুশ । একুশে, একুশে ভরে যাক আমাদের উঠোন;আমাদের মন প্রাণ । এমন দাবি বাহান্ন আর একুশের অন্যায্য নয় । কারণ আজ আমরা যেখানে যেভাবে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে যেমন করেই হোক,তা কেবল এই বাহান্ন আর একুশের জন্যই । আজ যে বাংলাদেশের সৃষ্টি তা কেবল ওই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই । তাই একুশের চেতনা প্রত্যেক বাঙালিকে ধারণ করতে হবে হৃদয়েতো বটেই; ধারণ করতে হবে তার চেতনা গভীর থেকে গভীর ভাবেই ।

বাহান্ন আর একুশ কোন কাগজের নৌকা নয় যে তৈরি করে ভাসিয়ে দিলাম প্রবাহিত ঝর্ণাধারায়, বাহান্ন আর একুশকোন অলিখিত ইতিহাস নয় যে তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম নদীতে;বরং বাহান্ন আর একুশ এক প্রাচীরের প্রতিচ্ছবি; বরং তাঁকে স্থান দিতে পেরে ইতিহাস নিজেই সম্মানিত ।

পৃথিবীর যেকোনো জাতির কাছে তার নিজস্ব ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নানা কারণেই । ভাষা যেহেতু মানুষের আন্তঃযোগাযোগ রক্ষার প্রধান ও প্রথম উপকরণ, ভাষা যেহেতু মনের ভাব প্রকাশের এক ও অদ্বিতীয় মাধ্যম তাই ভাষার প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী । ভাষার প্রভাব বিবেচনায় এর ব্যবহারও বিস্তৃত ও বিশাল । সুতরাং ভাষাকে সহজ পথে চলতে দিয়ে এবং তার নিয়ন্ত্রণে থেকে তার গতিপথটাকে সহজ সরল রাখতে হয় । বেঁকে গেলেই বিপদ, বাঁকানো হলেই সমূহ বিপর্যয় দেখা দেয়; যেমন দেখা দিয়েছিল ৪৭’র দেশভাগের পর অর্থাৎ দ্বিজাতিতত্ত্বের স্বপ্ন যখন সফল হলো তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের । তখন প্রশ্ন ছিল জাতীয়তা বিভাজনের, প্রশ্ন ছিল জাতিতত্ত্বের যোগ বিয়োগের । বড় হয়ে দেখা দেয় প্রশ্ন গুলো যদিও তার পেছনে ছিল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ এবং উদ্দেশ্য । কারণ ছিল ভেদাভেদেরও । প্রশ্ন আরও একটি ছিল অনেক বড় আর তাহলো হিন্দু, মুসলমান বিভক্তির । মানুষ মানুষের জন্য, ভাষা ভাষার জন্য এই প্রশ্ন গুলো কোন অবস্থাতেই বড় হয়ে দেখা দেয়নি । ওদিকে কারোর দৃষ্টি ছিলোনা ; থাকবার কথা নয়, কারণ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার ছিলো মূল লক্ষ্য ধর্মকে পুঁজি ক’রে । তাঁদেরউদ্দেশ্য ছিল জাতিগত বিভাজনের মাধ্যমে ক্ষমতা ভোগ শেষপর্যন্ত । 

রাজনৈতিক, সামাজিক, ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে ৪৭’র দেশ ভাগ অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয় । তখন দেখা না দিলে এখন দেখা দিতো; এখন না দিলে ভবিষ্যতে । কিন্তু প্রশ্ন হলো এই বিভাজনের ফলে লাভের গুড় কে খেলো আর লোকসানের মাশুল কে দিলো ? সন্দেহ নেই বলির পাঠা তদানীন্তন পূর্ব বাঙলা তথা বাংলাদেশ ঐ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে । বাঙলা চ’লে গেলো উর্দুর বলয়ে; বন্দী হলো কারাগারে । ভাষার হাতে পায়ে পড়ানো হলো শেকল ! শুধু কি তাই ? বুকে কি বিঁধলোনা ছুরি ? গড়িয়ে পরলোনা কি রক্তের ফোঁটা ? ভাগ হয়ে গেলো ভাষার প্রাণ । প্রানের এক টুকরো ওপারে অর্থাৎ ভারতে; এপারে বাংলাদেশ । হতে পারে সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় তা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল; ।কিন্তু কথা হলো কিংবা প্রশ্ন রাখতে পারি- ওই বিবেচনাআর সিদ্ধান্ত গুলো কি ভুল ছিল ? । অন্তত আমি তাই মনে করি । রাজনৈতিক আর ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মানবতা আর বাঙলা ভাষার হাহাকারকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। তাদের বিপর্যয় কারো চোখে পড়েনি । আজ মনে হয় ভাষা আর সাংস্কৃতিক স্বার্থেই ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত বাঙলা ভাষাভাষীদের নিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করলেই বরং ভালো হতো । যদি এমন হতো তাহলে একটি ৫২’র রক্তাক্ত ইতিহাসের ভেতর দিয়ে আমাদের যেতে হতো না আজ । তাতে ভাষার মান যেমন রক্ষা হতো বেশি করে ( যদিও একক বাংলাদেশে সেটা রক্ষা হয়েছে ) তেমনি তার পরিধিও বেড়ে যেতো ।

মানুষ হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা দেখেছি রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে পড়ে এদেশের বাঙালী হিন্দুরা অনেকেই ভয়ে ,অনেকেই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সুরক্ষার কারণে আবার অনেকেই সম্পর্কের সূত্র ধরে সকল মায়া, মমতা, ভিটে, মাটি ফেলে রেখে পাড়ি দিয়েছিলেন অন্য কোথাও ! পেছনে রেখে গিয়েছেন তাঁরা মায়ের আদর, মায়ের ভালোবাসা । মাতৃভাষা ! ইতিহাস বড় নির্মম ,বড় সত্য । আজ হাহাকার ছাড়া আর কি-ইবা করতে পারি আমরা ?

শুরুতে বলছিলাম বিপর্যয়ের কথা । পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষার দ্বন্দ্বডেকে আনে বিপর্যয় । শুরুটা ভাষা নিয়েই তারপর আস্তে, আস্তে দেখা দেয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ও । জিন্নাহ’র ঐতিহাসিক ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার’ ঘোষণা হয়ে দাঁড়ালো বাঙালির নিজস্ব ভাষার অস্তিত্বের উপর আঘাত ।  বাঙলা ভাষার প্রতি অপমান, অবমাননা স্বরূপ । ক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র জনতা । তাঁরা ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নেয় বাঙলা ভাষার অস্তিত্ব ধরে রাখার নিজ ঘরে, নিজ সীমানায় ।গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ভাষার দাবি ;না হয়ে উপায় ছিলো না অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার প্রশ্নে । বাঙলা ভাষা প্রত্যেক বাঙালির আপন পরিচয় । বাঙলা ভাষা যে পথ দিয়ে হেঁটে এসে স্থাপন করেছিল নিজস্ব ঘরবাড়ি, ধারণ করেছিল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সকল আচার, নিয়ম কানুন হাজার বছরের বাঙলা ভাষার ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে তাকে নস্যাৎ ও তার কাঠামোটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছিলো ৪৭’র দেশভাগের পর থেকেই । কারা করেছিল এমন ঘৃণিত কাজ তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা । পাকিস্তানি মানসিকতা ও উর্দু ভাষাবাঙালির উপর জোর ক’রে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা থেকেই উদ্ভব এই ষড়যন্ত্র । তবে দখলদারিত্ব মনোভাব ও মানসিকতাও ছিল এসবের অন্তর্ভুক্ত । ছিল তাঁদের চিন্তায়, তাঁদের কর্মে আর তাই নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে মানুষ খুন করতেও তাঁদের দ্বিধা হয়নি !

পূর্ব বাঙলার মানুষেরা অত্যাচারিত, অবহেলিত হয়েছে নানা ভাবেই তবে অধিকার ছেড়ে দেয়নি তাঁরা,খুলে ফেলে দেয়নি সাংস্কৃতিক ও ভাষিক আবরণ যা একান্ত বাঙালির আর কারোরই নয় । পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা নানাবিধ ষড়যন্ত্রের স্বীকার পূর্ব বাঙলার জনগণ প্রথম বিদ্রোহটা করে বাঙলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারি । বিদ্রোহ বললাম কিন্তু শব্দটি ভালো লাগলো না । যদি ‘বিপ্লব’ বলি বেশ সুন্দর লাগে, ঘটনার সুদূরপ্রসারী প্রভাবটিও বুঝতে সহজ হয়ে যায় আমাদের জন্য । বিপ্লবই মানানসই এ ক্ষেত্রে । তার আগে প্রতিবাদ হয়েছে তীব্র এইসব ষড়যন্ত্র বুঝে ওঠবার পর । কিন্তু বর্বর পাকিস্তানিরা তাতে ক্ষান্ত হয়নি । গেছে আরো গভীরে ষড়যন্ত্রের । ৫২’র ২১ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় জড়ো হয়েছিলো সেদিন ছাত্র, শিক্ষক, সাধারণ জনতা । তাঁরা জড়ো হয়েছিলো ১৪৪ ধারা ভাঙবে ব’লে । মিছিলে স্লোগান শুরু হয়েছিলো রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে, মিছিল এগিয়েও গিয়েছিল পুলিশি বাধা পেরিয়ে; তবে বেশিদূর এগোতে পারেনি, থামিয়ে দেয়া হয়েছিলো গুলি ক’রে মানুষ হত্যার মাধ্যমে । দাবি ছিল একটাই- ‘রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই’ । তবে কেউ কেউ মিছিলে স্লোগানের সুরে যোগ করতে চেয়েছিলেন, কেউ কেউ করেওছে এমন-‘বাঙলা ভাষার রাষ্ট্র চাই’ । স্লোগানটি মারাত্মক ছিল সেদিনের প্রেক্ষাপটে । কারণ রাষ্ট্র ভাগের দাবি তখন কেউ করেনি, করেছে ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিটিই । অগ্রগণ্যও ছিলো তা । কে জানে একদিন সেই অপ্রকাশিত স্লোগানটিই হয়ে দাঁড়াবে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মূলমন্ত্র ? বাঙালির বাঙালি হ’য়েথাকবার একমাত্র ইচ্ছা গোপনে,গোপনেনিরবচ্ছিন্ন ভাবেই ? কারণ শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনহয়েছিলো, অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্র ভাগেরই !

ভাষা আন্দোলন যদিও ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংঘটিত হয়েছিলো প্রথমে কিন্তু এই আন্দোলনের গভীরে লুকিয়ে ছিল আসলে আমাদের সামগ্রিক মুক্তির অপ্রকাশিতব্যঞ্জনাটি ।পথঘাট চেনাজানা ছিল বাঙালির। দরোজা, জানালাও ছিল; কিন্তু তার সবকটা রুদ্ধ ছিল । আসলে রুদ্ধ করে রেখেছিল পাকিস্তানের ক্ষমতা লোভী শাসকেরাই । তাই বাঙালিরা তাঁদের চেনা পথে হাঁটতে পারেনি অনেকদিন, হাওয়া এসে লাগেনি গায়ে,শ্বাস নিতে পারেনি; নিঃশ্বাস ছাড়তে পারেনি যার সবকটার আসল রূপ ছিল খাঁটি বাঙালি ধারার ।

মুক্তিটি কিসের ? বুঝে নিতে পারি-না বুঝেও যে, মুক্তিটি ছিল রাজনৈতিক, মুক্তিটি সামাজিকএবং অবশ্যই ভাষিক । অসাম্য আর রাজনৈতিক বিভেদ বাঙালিদের ক’রেতুলেছিল অস্থির । তাঁদেরকে আন্দোলন, বিদ্রোহ ( আসলে বিপ্লব ) করতে বাধ্য করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা । ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়েছিলো বাঙালির জীবনে এক একটি টুকরো, টুকরো ইতিহাস; এক একটি অগ্নিঝরা দিন । সৃষ্টি হয়েছিলো মুক্তির পথে অধিকারের দাবিতে ৫২’র পর ৬৬’র ছয়দফা, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান এবং সবশেষ ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ।মানুষকে নির্যাতন, নিপীড়ন সেটা শারীরিক হোক কিংবা মানসিক ইতিহাস ক্ষমা করেনি কোন স্বৈরাচারকেই, কোন রাষ্ট্র নায়ককেই । রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে হেয় করা অথবা রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী কিংবা যৌথ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের দ্বারা দমন পীড়নের ইতিহাস নতুন নয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে । যদিও গণতান্ত্রিক সংজ্ঞা বলে অন্য কথা ! সাধারণ জনগণকে তাঁদের প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং তাঁদের মৌলিক যে অধিকার গুলো তা কেড়ে নেবার তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলবার অভ্যাস শাসক শ্রেণীর বহু পুরোনো।পৃথিবীতে এ যাবত যতগুলো বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তার পেছনে রয়েছে অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম  কারণ । ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা । বিপ্লব হয়েছিলো অধিকার আদায়ের জন্য । বিপ্লবটি ছিলো আদর্শ প্রতিষ্ঠার, বিপ্লবটি ছিলো মানবমুক্তির । রাষ্ট্রের অতি সাধারণেরাই করেছিল বিপ্লবটি । রাজতন্ত্রের সীমাহীন অত্যাচারে অতিষ্ঠ অধিকারহীন ফরাসিরা সাম্যের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব সেদিন হাতে তুলে নিয়েছিল বাধ্য হয়েই । তার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ইউরোপে ।

সাধারণের কণ্ঠস্বর এতোটাই কার্যকরী যে তাঁরা ভেঙে ফেলতে পারে তাঁদের কণ্ঠধ্বনিতে অদক্ষ, অকর্ম, অমানবিক শাসকদের রাজপ্রাসাদ । ফরাসি বিপ্লব পৃথিবীর পরবর্তী বিপ্লব গুলোতে যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে । বিপ্লব সফল হোক কিংবা না হোক প্রেরণা সেই ফরাসি বিপ্লব । কারণ, ওই বিপ্লব ছিলো সাম্য, অধিকারের এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠার; হোক না সেটা প্রায় দুশো বছর আগের । আমাদের ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সাথে ফরাসি বিপ্লবের রয়েছে অভূতপূর্ব মিল যদিও ফরাসি বিপ্লবে ভাষা নিয়ে ঘটেনি কোন ঘটনা । কিন্তু মিলতো সেই সাম্য আর অধিকারের দিক দিয়েই ? পশ্চিম পাকিস্তান সেসময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্রায় সবদিক দিয়েই বঞ্চিত করে রেখেছিল । চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল তাঁদের নিয়ম,যা পালন করেনি বাঙালিরা । পালন না করার ফল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ । মেনে না নেবার ফল আজকের আমাদের বাঙলা ভাষা ।

একটি দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও ভাষা তার নিজস্ব সম্পদ; সে সম্পদ যদি লুটে নিতে চায় কেউ , দখল করতে চায় সুরক্ষিত সাংস্কৃতিক জায়গাটি কেউ;তাহলে তার পেছনের অসৎ উদ্দেশ্যটি আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়না । বুঝে যাবার পর ধরা পড়ে লুটেরা আর দখলবাজদের কারসাজি । পাকিস্তান সেই কাজটিই করতে চেয়েছিল,কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিছু প্রকৃত খাঁটি বাঙালি আর দেশের, বিশেষ ক’রেবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং জনতা । তৎকালীন শক্তিমান পাকিস্তানের কাছে দুর্বল বাঙালিরা যে রুখে দাঁড়িয়েছিল তার কারণ মানসিক শক্তি আর বাঙলা ভাষার প্রতি অশেষ ভালোবাসা । একুশ আমাদের মুক্তির পথে প্রথম প্রহর যদিও বেদনার, অন্তর দহনের তবুও সেই প্রহরেই উঠেছিল বাঙলার আকাশে প্রথম সূর্য । প্রতিবাদ, আন্দোলনের মুহুর্মুহু তাপে জ্ব’লতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা । পরবর্তীতে বাধ্য হয়েই তাঁরা ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাঙলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয় । এটি হার পাকিস্তানের জয় বাঙলা ভাষার । বাহান্নথেকে ৭০’র সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বেছে নেয় মানুষ হত্যার মতো ঘৃণিত পথ যার চূড়ান্ত রূপ এবং ফলাফল ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ; যা ইতিহাসে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত ।

যখন ভাবি তখনকার দিনের কথা বুকের মাঝে বেজে ওঠে হাহাকারের সুর । আমার সমস্ত সত্তায় আমি ধারণ করি সেই সময়, সেই দিন গুলোর এবং প্রতিটা মুহূর্তের ঘটনা, ঘটনা উত্তর টালমাটাল বাঙলার আবেগ অনুভূতি গুলো । ভাষার জন্য, জানা নেই আর কোন জাতির এমন ক’রেজীবন বাজি রাখার ঘটনার কথা; জানা নেই, ভাষাকে রুদ্ধ ক’রে সম্পূর্ণ সংস্কৃতির বাইরের অন্য ভাষা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেবার চেষ্টার কথা । বাংলাদেশ খুব ছোট একটি দেশ, অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণও নয় তবুও তাঁর রয়েছে এক দুর্লভ হাসি কান্না জড়িত ইতিহাস ও ঘন আবেগ । রয়েছে আন্দোলন আর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে জয়লাভ করা ভাষার ঐতিহ্য । কিন্তু কষ্ট পাই যখন দেখি মধ্য আর উচ্চবিত্তে বাঙলা ভাষার প্রতি অবহেলা । বিশেষ করে উচ্চবিত্তেই বেশি । ওখানে চর্চা হয় ইংরেজির হয়তো অন্য কোন ভাষারও । কিন্তু মাতৃভাষার চর্চা ঘরে বাইরে অবহেলিত । অবহেলিত উচ্চশিক্ষায়, উচ্চ আদালতেও ।সম্ভবত ইংরেজির আগ্রাসন থামানো যাবেনা আর ।  ক্ষেত্রবিশেষে তার প্রয়োজনও আছে । তবে অনাবশ্যক কাজ ও কর্মে তার প্রচার ও প্রয়োগ না করাই ভালো ।ত্যাগ করতে পারলে আরও বেশি ভালো ।

শিক্ষিত সমাজে বাঙলাভাষার সুর পাল্টে যায়, পাল্টে যায় নিজের রূপটিও; পাল্টে গিয়ে ধারণ করে বিদেশী রূপ অর্থাৎ ইংরেজি তবে অধিকাংশই ব্যর্থ নতুন রূপে । আধুনিক যুগে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় । মানুষ শিখছে, আরও শিখবে এটাই স্বাভাবিক তবে ভুলে গেলে চলবেনা প্রত্যেকরই আছে একটি নিজস্ব সাংস্কৃতিক সামাজিক এবং ভাষিক পরিবেশ ও আবহ । থাকতে হবে সীমার মাঝেই; তবে সীমা অতিক্রমও করা যায় বিশেষ দরকারে, বিশেষ প্রয়োজনে। ইংরেজি আমরা শিখবো, পড়বো অবশ্যই, দরকারও আছে আন্তর্জাতিক পরিসর বিবেচনায় তবে অহেতুক অনাবশ্যক কথায় ও কর্মে এর ব্যবহারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে ।

বাঙলা ভাষা দিয়ে হয়তো বৈশ্বিক চাহিদা মেটানো যাবেনা ইংরেজির মতো তবে এই ভাষা এখন মুক্ত, ব্যবহারও আর সীমিত নয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত ও পরিচিত । এইসব দিয়ে যদিও বাঙলা ভাষাকে চিনে নিতে অসুবিধা হয়না কিছুটা বিচারওকরা যায় তাঁর স্বপক্ষে । কিন্তু নিজ ঘরে যদি অবহেলায় প’ড়ে থাকে বাঙলা তাহলে বোধকরি বিচারের রায় তাঁর বিপক্ষেই যায় । শুধু কি তাই ? বাঙালি জাতি হিসেবে এবং অবশ্যই তাঁর ধারক ও বাহক হিসেবে আমাদের জন্য কি বিষয়টি লজ্জার নয় ? লজ্জার অবশ্যই । ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ তা । ভাবতে হবে আমাদের, আমাদের প্রয়োজনেই; আমাদের বাঙলা ভাষার ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদেই । সেইসব প্রয়োজন, এই তাগিদ অনুভব করতে হবে হৃদয় দিয়ে । লালন করতে হবে একুশের চেতনা; ছড়িয়ে দিতে হবে তার কোমল আবেদন ঘরে বাইরে এবং অবশ্যই দেশের তরুণ প্রজন্মের মনেপ্রাণে । একুশ আমাদেরকে দিয়েছে অনেক কিছু; তার কাছ থেকে অপ্রাপ্তির থেকে প্রাপ্তিই বেশি আমাদের, তবে আমাদের কাছ থেকে একুশ কী পেলো ?  আমাদের কাছ থেকে তার প্রাপ্তিই-বা কী ? সেসব নিয়েও ভাবতে হবে আমাদের উদারভাবে, সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি ফেলতে হবে তীক্ষ্ণ ।

পরিচিতি  
ইফতেখারুল হক ইফতেখারুল  হক Reviewed by Pd on ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.