খলিল কে আমি প্রথম দেখি বড় কাকার সাথে, তারুণ্যদীপ্ত অথচ বিষন্ন, ছয়ফুট লম্বা দেহাতী গড়নের মানুষ । কাকা পইপই করে বললেন গেস্টরুমটা রেডি করতে, ছেলেটা এখানে কিছুদিন থাকবে, এসব আমাদের পরিবারে নতুন নয়, ঐতিহ্যগতভাবে চলছে, আমাদের এসব নিয়ে ভাবার সময়ও খুব কম, আমরা যারা যৌথ পরিবারের কয়েকগণ্ডা ভাইবোন তারা অবিরাম কোন না কোনভাবে ব্যাস্ত । বাবা মা, কাকারা - কাকিমারা, বিধবা ফুপু এবং যুবক তরুণ কিশোর ল্যাদা মিলিয়ে আঠারো জন ভাইবোন ।
মা কাকিরা সারাক্ষণ হেঁশেলে, বারো রাজ্যের কথা, তের কাব্যের মনোমালিন্য । আমরা খুবই দায়িত্বশীল, নিজেদের মত করে নাওয়া- খাওয়া, পড়া, স্কুল, গল্প, পাশের বাসার ছেলেদের সাথে ভাব চালাচালি, নিয়ম মেনে ছোটভাইবোনদের শাসন, আমরাও বড়দের কিল চড় নিয়মিত খাই! বলছিলাম খলিলের কথা, ছেলেটা ভাবনায় ঘুরেফিরে আসে কিন্তু মেহমানখানার দায়িত্ব মেয়েদের হাতে নেই, মহিলাদের হাতেও না ।
আমেনা কে বলেছি কেবল, সে ছোট কাকিমার কাছে লাগিয়ে দিলো । কাকিমা আমাকে ডেকে শাসন করে দিলেন, পরপুরুষের দিকে এত নজর ক্যান ছেমড়ি? এ কোন কীর্তন? ঘরময় চাউর হয়, মায়ের বকা শুনি, এরা কি খিচুরি পাকালো? লাবড়া বানিয়ে ফেলেছে, বিরক্তিকর যৌথ দেয়াল । তারপরও কানে আসে ছেলেটা বাংলা বলতে জানে না, তাই বড়দা রোজ ওকে নিয়ে বের হয়, দোভাষী । কোথায় বেরোয়? খলিল তার মা কে খুঁজতে এসেছে । জট লেগে যায় মগজে ।
আমাদের যৌথ দেয়াল, ভাবনার গভীরে যাবার অবকাশ কম । দুপুরে সমাজবিজ্ঞান বইয়ের মলাট লাগিয়ে চোখের বালি পড়ছি, ছোটভাইয়ের আগমন ঘটলো, জানিস রাঙা’বু, কাহলিল ভাইয়ের গলায় আজ কই মাছের কাঁটা আটকেছে! কাহলিল ভাইটা আবার কে? আরে খলিল ভাই, নরওয়ে থেকে এসেছে জানো না? সে কি! এই পিচ্চিতো অনেক জানে! নরওয়ে থেকে এখানে কেন? সেই ব্যাটাকে কই মাছ খাওয়াচ্ছিস! জলদি বেড়ালের পা ছুঁয়ে সালাম করতে বল, কাঁটা নেমে যাবে । আইডিয়া শুনে তড়াক করে উঠে পড়ে ভাইটি, আরে, এটা আমার মাথায় এলো না কেন? হাসিব, এই হাসু একটু শুনে যা ,হতচ্ছাড়া গায়েব ।
যৌথ পরিবারে গল্পগুজব লেগেই থাকে, অর্থহীন প্যাঁচালই বেশী, বংশী গোয়ালা দুধে ডাকাতের মত জল মেশাচ্ছে, মেজ কাকিমা বললেন, বংশী ডাকাত হয়ে গেছে, শুনে ভয়ে বাঁচি না । খলিল ছেলেটা মায়ের সন্ধান পায়নি, বাড়ি খুঁজে পেয়েছে, তার মাকে চিনতো এমন মানুষদেরও, কেউ তার মায়ের খবর জানে না । আমি বেশ বিরক্ত, নিজ মনে ভাবি, তাহলে ও মা কে ছেড়ে গেলো কেন! সেই ভাবনার মাঝে মায়ের গলা, কান খাড়া করে শুনি মা বলছেন, শুনলাম তোমাদের দাদা বললেন, ছেলেটা নাকি অর চাইল্ড । ওয়ার চাইল্ড! আমার মাথায় এবার সবকিছু পরিস্কার হতে শুরু করে ।
উনিশ শ একাত্তর, তুমি কি দিয়েছো? কি নিয়েছো? খলিল ফিরে গেছে তার নরওয়েজিয়ান বাবা মায়ের কাছে, সে তার বায়োলজিকাল মায়ের খোঁজ পায়নি । সেই মা যাকে আমি জানি না, খলিল ও জানতে পারেনি, আহা ভাইটি, সে কি বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে? অনেক লাঞ্ছনা সয়ে সে এই সন্তানটিকে পৃথিবীতে এনেছিলো, খলিল ভাগ্যবান কারণ বিদেশী এক দম্পতি তাকে দত্তক নিয়েছিলো, সব যুদ্ধশিশুরা এই সুযোগ পায়নি । সে হতভাগ্য, কেননা এই জন্মের ক্ষরণ তাকে হয়তো সারাজীবন রক্তাক্ত করবে ।
আজকাল আমরা খুব বলি, আমরা আগেও বলতাম, আমরা সবসময়ই বলবো কিন্তু কিছুই করতে পারবো না । আমরা বাকপটু, যুদ্ধশিশুদের কথা বলি, বীরঙ্গনাদের অধিকারে সোচ্চার হই, কিন্তু মঞ্চ ছেড়ে বেরুনোর পরেই আমাদের আদিম চেহারাটা বেরিয়ে পড়ে ।
![]() |
| পরিচিতি |
সাঈদা মিমি
Reviewed by Pd
on
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন