আজ এত জ্যাম ছিল রাস্তায় অবিশ্বাস্য! অনুকে কোন মতে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে রিক্সা ,আর গাড়ির সাথে প্রায় যুদ্ধ করেই হাসপাতালে এল শুভ্রা আর এসেই এতোটা অপ্রতিভ হতে হবে ভাবেনি ও , অবশ্য তা কয়েক মুহুর্ত মাত্র তারপরই নিজেকে সামলে নিল , পরিচয় ত আগেই ছিল শুধু সৌজন্য আলাপটুকু সেরে নিয়ে নিজের চেম্বারে গিয়ে বসলো আর বার বার ভাবতে লাগলো একেই কি বলে নিয়তির খেলা ! অফিস বয় চা দিয়ে গেল আর জানিয়ে গেল শুভ্রার যদি আপত্তি না থাকে তো নতুন সার্জন শুভ্রার সাথে লাঞ্চ করতে চান , শুভ্রা আরও অবাক হোল তবুও কিছু বুঝতে না দিয়ে বলল'' তুমি যাও রোগী দেখা হয়ে গেলে আমি ই ওনার রুমে যাব ।
শুভ্রা কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকবে ভেবেছিল কিন্তু সেই সুযোগই হল না একের পর এক রোগী আসছে , আসলে সময়টা ভাল নয় শীত আসছে ঋতু বদলের এই সমটায় বাচ্চারাই বেশী ভোগে , দশজন দেখা হোল বাইরে এখন অন্তত দশজন অপেক্ষা করছে ।
শেষ বাচ্চাটা দেখতে গিয়ে শুভ্রা আঁতকে উঠলো তীব্র শ্বাসকষ্ট আর জ্বর এর ! একে এক্ষুনি ভর্তি করতে হবে প্রয়োজনীয় সব লিখে পেশেণ্ট কে নিচে পাঠিয়ে ,ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিল আর ভাবতে লাগলো , আচ্ছা ওকি কোনদিনও শুভ্রার পিছু ছাড়বে না ? নাহ ! ভুল হয়ে গেল তারা দুজন ইচ্ছে করে কখনোই মুখোমুখি হয়না ,কি করে যেন হয়ে যায় ! তারপর ভাবল যাক দেখা যখন হয়েই গেল স্বাভাবিকত থাকতেই হবে আরও কতোটা বছর না জানি একসাথে এখানে কাজ করতে হবে , মুখে লৌকিকতার হাসি ঝুলিয়ে মিশতে হবে। যাক গে আর ভাব্বে না শুভ্রা আর কিছুত হবার নেই। ওদের মাঝে নতুন করে আর কি দূরত্ব তৈরি হবে ? আর যে ভুল নিয়ে এতোটা বছর পার হয়ে গেল সে ভুলের চাদর সরিয়ে কি লাভ হবে আজ !
রাউন্ড এ গিয়ে প্রায় সারাক্ষণই আনমনা ছিল ও , তবুও বাচ্চাদের অসুস্থ মুখগুলো ওকে খুব পীড়া দেয় আর অসহায় মা যখন কাঁদেন তখন নিজেকে ও স্থির রাখতে পারেনা । রাউন্ড শেষ করে শুভ্রা সোজা চলে যায় নতুন সার্জন এর রুমে, একি ! কেউ নেই! শুভ্রা ভাবল থাক আজ'তো আর সময় নেই কাল কথা হবে চলেই যাই । ও স্কুল থেকে অনুকে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরল তখন দুপুরের রোদ মরে এসেছে বিকেল ছুঁই ছুঁই করছে । মা- মেয়ে খেতে বসলো অবেলাতেই রুনুর আজ শেষ পরীক্ষা ছিল মেয়েটার টেস্ট পরীক্ষা চলছিল ,সামনে এস এস সি দেবে খুব খাটছে ওর জন্যই ভাত নিয়ে বসা কিন্তু মেয়েটা কিছুই প্রায় খেলনা শুভ্রা জিজ্ঞেস করতেই বলল ।
মা আজ পেটে ব্যাথা করছে খেতে ইচ্ছে করছে না '' শুভ্রা আর জোর করেনি ...দুজন দুজনের রুমে ঢুকে গেল । শুভ্রার অস্বস্তি কাটছিলনা কিছুতেই তাই বারান্দায় যায় । ওখানে দাঁড়াতেই ওর মনে পড়লো অনেকদিন পর সে খোলা হাওয়ায় এলো ! আর মুক্ত আকাশ দেখছে ...অথচ ওর জীবনটা কি এখনো রাহুমুক্ত ? নাহ আজো রিতু তার জীবনের সব বিপর্যয়ের জন্য শুভ্রাকেই দায়ী করে অভিশাপ দেয় , শুভ্রা অনেক চেষ্টা করেছিল রিতুর ভুল ভাঙ্গাতে রিতু কিছু শুনতে বা বুঝতে নারাজ ।
সুমন চলে আসে সন্ধ্যাতেই আজো ব্যাতিক্রম হল না । শুভ্রা ওকে চা দিয়ে আজকের গল্প টা বলল শুনে সুমন হেসেই খুন তোমরা দুই বন্ধু দেখছি কিছুতেই দূরে থাকতে পারনা, এর আগে একসাথে কোথায় যেন কাজ করেছিলে? শুভ্রা হাসতে হাসতে বলল রাজশাহীতে তারপর কুমিল্লায় প্রায় ছ' বছর আগে এরপর আর ওর খবর জানা হয়নি ,আজই আবার দেখা ।
---তা এতদিনেও ওর ভুল ভাঙাতে পারলে না ? আর তোমাদের বন্ধু তুষার সেও কি পারতোনা তেমন চেষ্টা করলে ? শুভ্রা বলল করেছিলো কিন্তু রিতু বুঝতে চায়নি উল্টো তুষারের ওপর রাগ করে মাঝে জাহিদের সাথে সম্পর্ক করেছিল ,কিন্তু তা টেকিনি ,কারন রিতু আসলে তুষারকে কখনো ভুলতেই পারেনি ,এখনো না । পারলে নিশ্চয় বিয়ে করত ,আচ্ছা তুমি একবার চেষ্টা করে দেখনা গো ।
---বেশ একদিন যাব ওর কাছে দেখি যদি শোনে আমার কথা ।
শুভ্রা চলে যায় রুনুর কাছে দেখে , শুয়ে আছে হাতে একটা বই , শুভ্রা ভাবে থাক আজ রেস্ট নিক মেয়েটা ! তারপর চলে যায় রান্নাঘরে ! হঠাৎ মনে হুল রুনু বমি করছে ,ছুটে চলে যায় ও রুনুর কাছে হা রুনু বমি করছে ,পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা ! রুনুর পেটে হাত দিয়েই শুভ্রা বুঝতে পারে কিসের ব্যাথা ! শুভ্রা তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করতে বলে সুমন কে ।
হাসপাতালে পৌঁছেই ও সার্জনের খোঁজ করে ডিউটি ডাঃ ওকে ভর্তি করে ,বলে ম্যাডম অপেক্ষা করুন ,আমি যা বুঝলাম এক্ষুনি অপারেশন করতে হবে , এটা এপিন্ডিক্স শুভ্রা বলে হা আমিও তাই ধারনা করছিলাম, রক্তের রিপর্ট ও তাই বলছে কিন্তু সার্জন কই ?
এই ত উনি নিচে চেবমারে আছেন , খবর দেয়া হয়েছে এক্ষুনি এসে যাবেন ।
সার্জন এসে রুনুকে দেখেই বলে ওটি রেডি কর ।
শুভ্রা সার্জন কে দেখে আঁতকে ওঠে রিতু করবে ওর মেয়ের অপারেশন! যে কিনা ওকে পনেরো বছর ধরে অভিসম্পাত দিয়ে যাচ্ছে সে! যদি ওর মনে তখন পুরনো ক্রোধ জেগে ওঠে তখন ভুল তো করতেই পারে ? পরক্ষনেই ভাবে ধুর! তাই কি হয় ? ও একজন ডাক্তার আর সব রোগীই তো ডাক্তারের কাছে সমান । তাছাড়া এখন উপায় ও নেই ডাঃ ইসলাম কিংবা ডাঃ সুজন কে ডাকা মানে রিতুকে অপমান করা ,তাছাড়া ডাঃ ইসলাম মনে হয় এখনো দেশের বাইরে, ফেরেন নি ।
রিতু রুনুর ব্যাপারে সুমনের সাথে কথা বলছিল , কিন্তু শুভ্রার দিকে তাকিয়ে হয়ত ওর মনের কথাটা বুঝতে পারে তাই সুমনের সাথে কথা থামিয়ে শুভ্রাকে বলে ভয় করছিশ কেন ? আমি কি ওর ক্ষতি করবো ? তোর ওপর রাগ তোর মেয়ের ওপর দেখাবনা আমি। আর তোর মেয়ে তো আমারও মেয়ে , আমি একজন ডাক্তার। আয় তুই ও আয় ওটি তে।
শুভ্রা বলে নাহ! আমি আমার মেয়েকে অজ্ঞান দেখতে পারবনা তুই যা তোর ওপর আমার আস্থা আছে তুই দেখিস আমার মেয়েটা যেন বেশি কষ্ট না পায় ।
এক ঘণ্টা পর রিতু ও টি থেকে বেরিয়ে আসে রুনুর জ্ঞ্যান ফিরেছে ভাল আছে শুভ্রা আর সুমন গিয়ে দেখে এসেছে । শুভ্রা রাত টা পোস্টঅপারেটীভ রুমে বসে রইলো রুনুর পাশে । সুমন আছে কেবিনে । ও ভাবছিল রিতুটার কি অভিমান ! কি এমন ঘটেছিলো সেদিন ? সামান্য দুষ্টুমির মূল্য এভাবে ওদের দুজনকেই দিতে হবে কে জানতো ?
সেদিন ওদের ইনকোর্স পরীক্ষা ছিল শুভ্রা বসেছিল তুষারের পাশে একটা উত্তর কিছুতেই মনে পড়ছিল না তাই তুষার বলেছিল কথা বোল না আমারটা দেখে লিখ ,এ সময় স্যার দেখে ফেলেন তারপর দুজনের খাতাতেই ৫ নম্বর মাইনাস করে দেন ,হল থেকে বেরিয়ে রিতু খুব রেগে যায় শুভ্রাকে ভীষণ বকাবকি করে কারণ ওর জন্যই তুষারেরও পাঁচ নম্বর কাটা গেছে, ঠিক তখনি স্যার ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন ,এদের দেখেই বলে উঠলেন ? এই যে তোমরা দুজনও আছো দেখছি ?আচ্ছা তুষার তুমি বলত কেন ওভাবে ওকে দেখাচ্ছিলে ? কতদিনের সম্পর্ক তোমাদের ?
জাহিদ পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে উঠলো অনেকদিন আগে থেকে স্যার !
----বল বল কতদিন থেকে ?
----স্যার সেই ছোট বেলা থেকেই ...
---মানে ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সাথে ?
ধমকে ওঠেন স্যার । তুষার বলে না স্যার আসলে আমরা দুজন একই পাড়াই থাকতাম একসময় আর একই স্কুলে পড়েছি মাঝে শুধু কলেজ টা আলাদা ছিল ।স্যার শুভ্রার দিকে তাকিয়ে বললেন সত্যিই? শুভ্রা বলল জী স্যার সত্যি । স্যর বললেন বেশ তাহলে তোমাদের নম্বর ফিরিয়ে দিলাম । বলে হাসতে হাসতে চলে গেলেন ।
এইটুকুই তো ছিল ঘটনা। অথচ সেদিন থেকে রিতু শুভ্রার সাথে কথা বলেনি আর তুষারের সাথেও সম্পর্ক রাখেনি । ওরা বন্ধুরা অনেক বুঝাতে চেষ্টা করছিল এটা সত্যি নয় কিন্তু রিতু কিছুই বুঝতে চায়নি । আর সেই থেকে শুভ্রার সাথে সম্পর্কও রাখেনি ,এড়িয়ে গেছে বরাবর । এটা ঠিক যে তুষার আর শুভ্রা একই পাড়াতে থাকতো আর একই স্কুল থেকেই এস এস সি পাশ করেছে কিন্তু বন্ধুত্ব ছাড়া অন্যকোন সম্পর্ক ছিলনা ওদের মাঝে । এরপর কত ১৫ বছর কেটে গেছে তুষার পাশ করে বিদেশে চলে গেছে রিতু অনেক ডিগ্রী নিয়েছে বিখ্যাত সার্জন হয়েছে তবু সংসার করেনি । আজো সে অবিবাহিত ।
সকালে ঠিক সাতটায় রিতু রুনুকে দেখতে এলো বলল ,ওকে দুপুরে কেবিনে দিয়ে দেব তুই এত চিন্তা করিস না আয় বাইরে আয় তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে আয় ।
শুভ্রা বেরিয়ে আসে দেখে তুষার কথা বলছে সুমনের সাথে ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে বছর পাঁচেক এর এর একটা মেয়ে ! শুভ্রার মনে স্বস্তির নদী বয়ে যায় কুল কুল করে ।
![]() |
| পরিচিতি |
ফারহানা খানম
Reviewed by Pd
on
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
Rating:


দারুন লিখেছেন গল্পটা
উত্তরমুছুন