রুমকি রায় দত্ত

বিশাল  মরচে ধরা লোহার গেট। ঠিক মাথার উপরেই একটা বাঁকানো লোহার পাতের উপর লেখা আছে না্মটা—“বৈশালি হাউজিং কমপ্লেক্স”। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বাঁ-দিক থেকে শুরু হয়েছে এ-ব্লক,তারপর বি-ব্লক,সি-ব্লক। প্রতিটি ব্লকের মাঝেই বাঁধানো রাস্তা আর দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি।আবাসনটি অনেক পুরান। এই আবাসনের বি-ব্লকের ডানদিকের যে বিল্ডিংটা, ওটার ফার্স্টফ্লোর ডানহাতের প্রথমঘরটিতে থাকেন” দিবাকর সান্যাল”। পেশায় অধ্যাপক।

গতকাল রবিবার ছিল,আজ সোমবার দু’দিন কলেজ যায়নি,বাড়িতেই আছে। কিন্তু এই ছুটির দিনেও মধ্যচল্লিশের দিবাকরকে বিরহে দিন কাটাতে হচ্ছে। অমন রূপসী,নিটোল পরিপাটি শরীরের, অমন গলানো মোমের মতো চকচকে চামড়ার বউ যদি দু’দিন বাড়ি না থাকে তবে শুধু দিবাকর কেন যে কোনো পুরুষ মানুষের মনেই বিরহ জাগবে। মধুমিতা দু’দিনের জন্য ছেলে সৈকতকে নিয়ে বাপেরবাড়ি গেছে।রবিবারটা সারাদিন দিবাকর একা একা স্বাধীনতা ভোগ করেছে।রাতে যদিও বিছানাটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছিল। সোমবারটা যেন কাটতেই চায়ছেনা ওর। রাঁধুনি রান্না করে দিয়ে গেছে। সকাল থেকে চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভোটের কচকচানি ও সব শোনা হয়ে গিয়েছে।কি করা যায় ভাবতেই চোখ পড়লো পুরানো বই এর আলমারিতে। দিবাকর নেমে পড়ল কাজে। একে একে সব বই মুছে আলমারিতে বেশ কয়েকটা শুকনো লঙ্কা ছড়িয়ে দিল। এতে নাকি পুরানো বইতে রূপোলী পোকা ধরেনা।বই এর ফাঁকে লুকিয়ে থাকা হলদে হয়ে যাওয়া কাগজ গুলো একপাশে রাখলো। পরে দেখে দেখে ফেলবে।এরপর স্নান,দুপুরের খাওয়া,অবশেষে ছোট্ট একটা ঘুম।

অনেকদিন সৈকতের ঘরটাই ঢোকেনি দিবাকর। ছোটোবেলায় এই ঘরটা কে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল দিবাকরের নিজস্ব জগৎ । এইঘরটার দক্ষিন-পশ্চিম জুড়ে একটা ছোট্টো ব্যালকনি আছে। শিতের উত্তুরে হাওয়া বন্ধ হয়ে এখন দক্ষিনা বাতাস বওয়া শুরু হয়েছে। আজ হঠাৎ নির্জনাতায় দক্ষিনা বাতাস গায়ে মাখার জন্য,সৈকতের ঘরে ঢুকে ওই ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো দিবাকর। পাশের বড় রাস্তাটা দিয়ে হুসহাস গাড়ি চলে যাচ্ছে।এদিক টা বি-ব্লকের পিছন দিক। ঠিক তিরিশ ফুট দূর থেকেই শুরু হয়েছে সি-ব্লক।হ ঠাত দিবাকরের চোখ গেল ওর সোজাসুজি সি-ব্লকের গ্রাউন্ড ফ্লোরের প্রথম ব্যালকনিটার দিকে। চোখটা যেন কোনো এক অজানা আগ্রহে কিছু একটা খুঁজে নিল। নাহ! কিছু নেই। শুধু তারে ঝুলছে একটা আধভেজা শাড়ি,ফিকে গোলাপী রঙের সায়া আর লাল রঙের একটা ব্লাউজ,সেটা দিয়ে কালো অন্তর্বাসটা গোপন করার চেষ্টা করা হয়েছে।দিবাকর চোখ ফিরিয়ে নিল,কিন্তু মনটা ফিরিয়ে নিতে পারলো না। পৌঁছে গেল প্রায় তিরিশ বছর আগে।দিবাকর তখন ক্লাস নাইন। ব্যালকনি লাগোয়া এই ঘরটায়তখন ওর রাজত্ব চলত।আর সি-ব্লকের একতলার ওই ব্যালকনি লাগোয়া ঘরটায় রাজত্ব চালাতো ‘রজনী’। রজনী তখন ক্লাস এইট। রোগা,কালো আর ছেলেদের মতো চুল ছাঁটা রজনী চৌধুরী। মেয়েটা খেলাধূলায় বেশ ভালো ছিল।

               দিবাকর বরাবর পড়াশোনায় ভালো ছাত্র ছিল,আর দেখতেও সুন্দর। দাঁড়ির রেখা উঠতেই পুরুষালী ছাপ পড়েছে শরীরে। আর মন তখন রঙিন স্বপ্নে বিভোর। ক্লাসের ও জুনিয়ার ক্লাসের মেয়েরা তখন দিবাকরের প্রেমে দিবানা, আর দিবাকর দিবানা মধুমিতার প্রেমে। প্রথম বয়সের নিখাদ প্রেম উজার করা দিবাকর হঠাৎ একদিন মেতে উঠল নতুন এক খেলায়। রজনীরা তখন ওই বাড়িতে নতুন এসেছে। রোজ সকালে স্কুল যাওয়ার সময় দিবাকরের সাথে দেখা হতো রজনীর। শীর্ণ শরীরে হাটু পর্যন্ত ঢলা স্কার্ট-ব্লাউজে রজনীকে কাকতাড়ুয়ার মত লাগত। দিবাকর কে দেখলেই কেমন যেন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকত। প্রথম প্রথম মাঝে মধ্যেন্দেখা হত। হঠাৎ দিবাকরের যেন মনেহতে লাগল, মেয়েটি যেন ওকে দেখার জন্যই আগে থেকে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এই বয়সে এই ধরনের ব্যাপার গুলো আর সবার মত দিবাকরও উপভোগ করতে লাগলো। ওরও যেন আগ্রহ দেখা দিল মেয়েটিকে দেখাদেবার। কিন্তু এই খেলার পরিনতিটা ওদের দু,জনের কাছেই তখন অজানা। ক্রমে ক্রমে দেখা হয়াটা ব্যালকনি পর্যন্ত গড়ালো। এই সেই ব্যালকনি যেটাতে দিবাকর এখন দাঁড়িয়ে আছে। খেলাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে,দিবাকর পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ব্যালকনিতে এসে দাড়াত, আনমনে তাকিয়ে থাকত রজণীদের বাড়ির দিকে। কখনও বা চোখাচোখি হত।

ও দিকে রজনীর কাছেও ব্যাপারটা আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে লাগল। হৃদয়ে দোলা লাগল। এই দেখাদেখির ভাললাগাটা উপভোগ করার জন্যে পড়ার টেবিলের জায়গাটা পরিবর্তন করলো রজণী। টেবিলটা এনে রাখলো ঠিক জানালার সামনে। কয়েক মাসের চেষ্টায় চুল্টা ঘাড় পর্যন্ত নেমে এল। চোখে কাজল পড়া শুরু করল,পোশাকের সেটাকে উসকে দিতে লাগল। রিজনীও অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগল দিবাকরের প্রস্তাবের আশায়।রজনী নাইন আর দিবাকর টেন হল।অবশেষে একদিন ঠিক করল নিজেই জানাবে ভালবাসার কথা।চিঠি লিখল দিবাকরকে।

প্রিয়,
দিবাকরদা,তুমি আমার প্রথম ভালবাসা। শুধু তোমাকে ঘিরেই আমি স্বপ্ন দেখি। আমি রজনী,আমার আছে এক আকাশ তারা। আমি ওই তারা দিয়ে তোমাকে সমস্ত জীবণ ভরিয়ে রাখবো।
       ইতি—
          তোমার একমাত্র ভালবাসা
                         আমি---‘রজনী’

রজনী জানতো না কতবড় মিথ্যা ও বুকের মধ্যে সযত্নে তুলে রেখেছে। চিঠিটা শেষ পর্যন্ত দিবাকরের হাতে পৌঁছায়। চিঠিটা পাওয়ার পর দিবাকর স্কুলের সব বন্ধুদের সামনে,এমন কি মধুমিতার সামনেও চিৎকার করে পরেছিল। রজনীর অলক্ষে সেদিন ওর মন ও ভালভাসার চরম অপমান ঘটেছিল। দিবাকর চিঠিটার জেরক্স কপির পিছন পিঠে বড় বড় হরফে লিখেছিল----
‘আয়নায় কখনও নিজেকে দেখছ? বাড়িতে আয়না আছে? যদি না থাকে জানিও, এবছর তোমার জন্মদিনে একটা বড় আয়না দেব।। যাতে তোমার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত দেখা যাবে। আমায় তারা দিয়ে ভরানোর আগে নিজের দেহটাকে একটু মাংস দিয়ে ভরো’।
চিঠিটা পেয়ে রজনী নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। মন কে বার বার প্রশ্ন করেছে,এতদিন ধরে দিবাকরের দিক থেকে আসা ইঙ্গিত গুলোর সবই কি ভুল? হার, মানেনি,লজ্জার মাথা খেয়ে ভালবাসার ভিক্ষা চেয়ে আরও কয়েক বার চিঠি লিখেছে।

এরপর দিবাকর মাধ্যমিক পাশ করে বাইরে চলে যায় পড়তে। রজনীর কি হল বা কেমন আছে জানার তাগিদ ও বোধ করেনি কোন দিন। দিবাকর চাকরী পেয়ে মধুমিতা কে বিয়ে করেছে। সৈকত ওদের জীবনে এসেছে। জীবন থেকে বাদ পড়েছে বাবা-মা। জায়গা নিয়েছে দেয়ালে টাঙানো ফোটোফ্রেমে। বিয়ের ঠিক পরপরই মধুমিতাকে দূর থেকে দেখিয়েছিল রজনী নামের বকা মেয়েটা কে।

এত বছর পর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দিবাকরের আজ মনে পরছিল রজনীর কথা। শুনেছে রজনী নাকি বিয়ে করেনি। কোনো একটা স্কুলে খেলার শিক্ষিকার চাকরী করে। ওরও বাবা মারা গিয়েছেন। বৃদ্ধা মা কে নিয়ে ঐ বাড়িতেই থাকে। দিবাকর ভাবে এতগুলো বছর একই জায়গায় আছে অথচ একদিনের জন্যও সামনা সামনি হইনি। রজনী কি তবে দিবাকরের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে? ঠিক তিরিশ বছর আগে যেমন দৃষ্টি গোচর হওয়ার চেষ্টা করত!

সূর্য তখন মধ্যগগন ছেড়ে নামতে নামতে দিগন্ত রেখার মাঝামাঝি পৌঁছেছে। চারিদিক লাল আভার রশ্মি ছড়াচ্ছে। সূর্যাস্তের আগের শেষ আলো। রজনী দরজা খুলে এসে দাঁড়ালো ব্যালকনিতে । শাড়িটা শুকিয়ে গিয়েছে তাই ভাঁজ করে ঝুলিয়ে রাখল ব্যালকনির রেলিংএ। সায়াটা হাত দিয়ে দেখল শুকিয়েছে কিনা। তারপর রেলিং এর উপর হাতের ভর দিয়ে দাড়াল। একটা হাত থুতনির নিচে। পরণে হাল্কা রঙের সুতির শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ । গোধূলির সবটুকু আলো আর সবটুকু রঙ ওর সর্বাঙ্গ ভরিয়ে তুলেছে। আগের থেকে স্বাস্থ্যটা ভালো হয়েছে। চামড়া ও চিকচিকে লাগছে । চুলটা পিছনে খোঁপা বাধা। অপূর্ব গোধূলির রঙে ওর সাদা ব্লাউজের ফাঁকে জেগে থাকা বিভাজিকা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দিবাকর। যেন আলো চুঁয়ে চুঁয়ে ওর শরীরের ভিতর গড়িয়ে যাচ্ছে। অপূর্ব - অপূর্ব সন্দরী লাগছে  ওকে। কোন উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দিগন্ত রেখার দিকে ।

হঠাত কি মনে হতেই ঘরে এলো দিবাকর। ফেলে দেওয়ার জন্য রাখা হলদে কাগজ গুলো হাতে নিয়ে ফিরে এলো ব্যালকনিতে। মেলে ধরল তার একটি নিজের সামনে। গোধূলীর আলোয় অক্ষর গুলো যেন ধীরে ধীরে একেকটি তারায় পরিণত হতে লাগলো।
   
পরিচিতি 

রুমকি রায় দত্ত রুমকি রায় দত্ত Reviewed by Pd on ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.