শুক্লা সান্যাল


অনেক কষ্টে দুখাকে বড় করেছিল দুখার মা। যদিও বেশিরভাগ মা কষ্ট করেই সন্তান মানুষ করে। অভাবের সংসারে যখন দুখার জন্ম হল বড় খুশিহয়ে মা বাবা নাম রাখল দুঃখহরণ।এই ছেলে বড় হয়ে তাদের সব দুঃখ দূর করবে। নিজেরা আধপেটা কখনো উপবাস কিন্তু দুখার জন্য ভরপেট খাবার। কামারের ঘর লোহাপেটা কাজ শরীরে শক্তি দরকার। কাজেই দুখার খাওয়া কম হলে চলবে না।দুখার পরে আরওভাই বোন হল। অপুষ্টিতে ভুগে দুটো মরেও গেল
দুখার খাওয়া বজায় রইল।

দুখার এখন বছর পনেরোর দামাল কিশোর। পাঁচকেলাস পর্যন্ত পড়ে মা সরস্বতীকে মাথায় তুলে রেখেছে। দুখারবাবা কামারশালায় ডেকে পাঠায়ে দুখা যায় না।তার কামারের কাজ ভাল লাগে না।বড্ড পরিশ্রমের কাজ।দুখার বাবা অশান্তি করে রোজ।দুখার বন্ধু বান্ধব বামুন কায়েতের ছেলেরা। তার লোহা পিটতে লজ্জা লাগে।দিন যায় মাস যায় দুখার জন্য রোজ অশান্তি। দুঃখ দুর হবে কি দুঃখ আরও ভিড় করে আসে।দুখার ইচ্ছে ব্যবসা করার। পূঁজি কই? পয়সা কড়ি? দুখার মা বলে। ক্যানে তোরপায়ের দশভরির চাঁদির মল আছে ওটা বেচে  দে। খবরদার দুখা উটা আমি বানীর বিহ্যার লেগে রেখেছি উটা দিতে পারবো না।

ঠিক আছে আমি যেমন করেই হোক রাস্তার ধারে একটা ঢপ খুলবো। কিন্তু তোদের কে বলে দিলাম মা,আমি তোর একপাল ব্যাটা বিটির দায়িত্ব লিতেই পারবো না। আমার থেকে একটা ফুটা কড়িও তোরা আশা করিস না। দুখা ওর মাকে স্পষ্টই জানিয়ে দিল। কিছুদিনের মধ্যেই পঞ্চায়েত থেকে ডি আর ডি এরলোন পাস করিয়ে রাস্তার ধারে ফলের ঢপ দিল। বলা বাহুল্য দুখা সেদিন থেকেই মা বাবার সঙ্গে আলাদা হয়ে গেল।

দুখা এখন  বিয়ে করেছে। ভাল ঘরের সুন্দরী মেয়েকে কিভাবে পটিয়ে বিয়ে করলো বোঝা দায়। দুখার চেহারা ছিলকেমন চোয়াড়ে। লালিত্য ছিলনা তবে ওবন্ধুমহল এবং প্রতিবেশীর কাছে  প্রিয় ছিল রগুড়ে স্বভাবের জন্য। ভাল  অভিনয়ও করতো। আর একটা শখ ছিল কীর্তন শোনার। সে মনসার ভাসানই হোক কিংবা পালা কীর্তন। এমনই একদিন কীর্তনের আসর থেকে এসে সোজা মায়ের ঘরে ঢুকল। মা জেগেই ছিল।কিরে দুখা কিছু বুলবি? দুখা খুব নরম ভাবে উত্তর দেয় - মা কীর্ত্তনে বলছিল যে ছেলে মায়ের মনে কষ্ট দেয় তাকে ঈশ্বরও ক্ষমা করেন না। মা তুই আমাকে অভিশাপদিস নাতো? তোকে আমি কষ্ট দিই যে?  দুখার মা কিছুক্ষন চুপ করেথেকে বলল দুখা আমি তোর মা দুষমুন লই। রাত মেলা হয়েছে ঘুমা যেয়ে।

দুখার এখন বাড়বাড়ন্ত ব্যবসা। আমের বাগান কেনে প্রতি বছর। বাগান থেকে পাইকার নিয়ে যায়।উঠোনেও পালা দেওয়া আম। দুখা হাতে করে মা বোনদের  একটাও দেয় না। মা কষ্ট পাই কিছু বলে না। দুখা একদিন বললো- দ্যাখ মা  আমি তোকে হাতে করে আম তুলে দিতে পারবো না। আমার নেচারটাই অমনি। কাউকে দিতে পারিনা। দিলেই আমাশা হয়ে যাবে। তুই বরং নিজে হাতে তুলে নিস কটা আম। সেটা হয়তো সহ্য হবে। দুখার মা শান্ত স্বরে জবাব দেয়  তোর বাবা এখনও বেঁচে আছে দুখা সেই খাওয়াবে আম। তুই নাহে ভাল থাক। দুখার বোন বাণী হাসপাতালেভর্তি।কঠিণ ব্যামো ওর মা মেয়েকে দেখতে হাসপাতাল যাচ্ছে। দুখার ফলের দোকান থেকে পঞ্চাশ টাকার ফল কিনে ত্রিশ টাকা দেয় বাকি কুড়িটাকা পরে দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। মাসখানেক পার হয়েছে অভাবের সংসার দুখার টাকাটা আর দেওয়া হয়নি।ইতিমধ্যে নববর্ষ এল। দোকানে দোকানে হালখাতা। দুখার দোকানেও হালখাতা হবে। হঠাৎ দুখা ওর মাকে একটা কার্ড ধরিয়ে দিল। দুখার মা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। দুখা বলবে- মনে হছে কিছুই জানিস না? তোর বিটির অসুখের সময় ফলের দরুন কুড়ি টাকা পাই মনে আছে? দুখার বউ হাঁহাঁ করে উঠে তোমার কি মনুষ্যত্ব বলে কিছুই নাই? ওটা তোমারই তো বোন! তুই চুপ মাগী! একটা কথা বললে ঝি গিরি করাবো তোকে। বউ বলে এখন তোমার সংসারে কি করছি? ওদের দুজনার বাক বিতন্ডার মাঝে দুখার মা বুড়িটা টাকা দিয়ে বলল তোর দোকানের হাল খাতার লাড়ু খাওয়ার আগে যেন আমার মরন হয়। রাতের আটা কেনার টাকা ছিল ওটা। বলা বাহুল্য সে রাতে দুখার মায়ের আর চুলহা জ্বলেনি।

বেশ কয়বছর কেটেছে দুখার ছেলেরা বড় হয়েছে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। দুখার মায়ের সংসারেও টানাটানি কমেছে। কিন্তু বিধি বাম। দুখার প্যারালিসিস হল। হাইপ্রেসার হয়েছিল। পয়সা খরচের ভয়ে ওষুধ খেতো না। বিছানায় শুয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতো। খুব কষ্ট।অথচ প্রাণ যায়না। দুখার মা পাশে বসে কাঁদে। দুখা বহু কষ্টে সেদিন মাকে বলল  মা ডাক্তারের ওষুধে আমার মুক্তি নাই। যত পাপ আমি করেছি তোকে কষ্ট দিয়ে তারই কুফল ভোগ করছি তোর পায়ের ধুলো আমার মাথায় দে মা ওতেই আমার মুক্তি।

পরদিন ভোরের আলো তখনও ভালো করে ফুটেনি। দুখার মার বুকফাটা আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়লসারা গ্রামে। দুখারে আমি কুনুদিন তোকে অধিশাপ দিইনি রে বাপ। আমি তোর মুখেই পেখম "মা" ডাক শুনেছি রে বাপ। কতি গেলি বাপ। আমি তোর মা দুখা "কুমাতা" লই। শ্মশান যাত্রীর দল ততক্ষণে আসতে শুরু করেছে।



পরিচিতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ