চন্দ্রা মুখার্জী


পসরা কাঁধে ফেলে শ্রান্ত পা এ ঘরে ফেরার তাড়া। এই খরস্রোতা পাথুরে নদী,শেষ বিকেলের গোধূলিরঙ্গে তার শরীর জোড়া সোনার বসন। অগভীর জলে পাথর গুলিও স্বচ্ছ্ব,ভারী শান্ত মূর্তি।

কাছেই কিছু ছেলে মেয়ে আঁচলা ভরে সোনা ছ্যাঁকায় ব্যস্ত । সকাল বিকেল এগুলি নিয়ে যায় শহরতলিতে ,বিকোয় ছোট মাছ ,গেঁড়ী,গুগুলি,শামুক হয়ে । অন্ধকার নেমে এলে তারা ঘরে ফিরে আসে আধপেটা ভাতের গন্ধ নিয়ে।

একখানি মুখ রোজ চোখের সামনে ভাসে , বড় ভাললাগে ,তেলহীন রুক্ষ চুল, যত্নের অভাবে তামাটে হয়ে আছে ,লজ্জা নিবারনে শতেক তালি তাপ্তি ,শান্ত দীঘির মত বড় বড় দুটি করুণ চোখ, যেন বয়ে চলা স্বচ্ছ্বতোয়া সুরের নদী। তখন'ই ঝমঝমে বৃষ্টি নেমে আসে , বৃষ্টিতে ভিজে হালকা গোঁফের রেখায় তামাম দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে । দূর থেকে সে হাঁক দিয়ে যায় "ও দোকানী সিকি জমুক নেব অনেক কিছু "

নদী শেষে জঙ্গল পেড়িয়ে আমার প্রত্যন্ত গ্রাম,সাঁঝে পিদীম হাতে মা গলায় আঁচল টেনে নিকনো তুলসী মঞ্চে । ছোট্ট বাটিতে মুড়ি ভাঙ্গা বাতাসা, ভীষণ খিদের গন্ধে ম ম করে উঠোন । মায়ের ছড়ান সিঁথে দগদগে ল্যাপা সিঁদুর্ টিপ ।টিমটিমে জ্বলা কুঁপি,মাথা টা টেনে নেয় কোলে এখন লজ্জা লাগে ভারী । অহ্লাদের আবেশটুকু ছাড়তেও না পারি। রাতে কলমীর শাক মোটা চালের ভাত,গতরে আমেজ নিয়ে আসে । ঘুমের ঘোরে দীঘল চোখ মোচড় দেয় বুকে ,রক্তে ছড়িয়ে পড়ে আগুনের উল্লাস । চমক ভাঙ্গে ভিজে গেলে চাটাই। সন্তর্পনে ছুটি কুয়োর পাড়ে। দু ঘটি জল মাথায় না ঢালা অবধি ঠাণ্ডা হয়না এ শরীর ।

শিউলী রাঙ্গা ভোরে ঘুম ভেঙে যায় যাবার তাড়ায়। ট্যাঁটরা ঘাড়ে করে ফেরি করি ভিন্ন দুয়ারে। চরণ জবা আলতা,সিঁদুর,মনোহারী কাঁচ চুড়ি,ফিতে,চাঁদপনা টিপের বাহার,অনেক রকমারি।হেঁকে যাই পাড়া-বেপাড়ায় মা,মাসি দের শাঁখা পড়াই , তাদের সুখে ও দুঃখে । 

বেপাড়ার বিভিন্নি মায়েরা সিঁদুর নাড়ে শাঁখা নেড়েছেরে দেখে বটে , কেনে না কিছুই । খালি চোখের জল ফেলে।জিনিস কেনে দু টি পয়সা বেশি দেয়,দয়া হলে দুই বাতাসা,মুড়ি।নইলে কলের জল সম্বল ।

পসার জমেছে বেশ জমিয়ে ,দুটি পয়সাও হচ্ছে এবার ভাল,এবার । সেই দীঘল চোখ বাঁধা পড়ে বুকের পাঁজরে। একাকী নদীর পাড়ে চিৎকার করে বলে -- "তুই বৌ হবি "?

তখনই কান ফাটানো শব্দ,ধোঁয়া কেবল ধোঁয়া,মেশিনগানের তীক্ষ্ণ ফলা,বুক বেয়ে ঝরঝরে রক্তে ভেসে যায় মাটি ,মাটিতে লুটিয়ে রয়েছে তখন সময়ের পাখি । আমার স্বচ্ছ্বতোয়া ধোঁয়ার মাঝে গুটি পায়ে এগিয়ে যায় , রক্তাক্ত শরীর বুকে তুলে নিয়ে কেঁদে ওঠে পৃথিবী কন্যা ।

সন্ধ্যা পিদীম হাতে আমার মা,দ্গদগে সিঁথে,বাটি ভরা মুক্ত দানা মুড়ি অনেক বাতাসা।স্বচ্ছ্বতোয়া নদীর সাথে মিশে।দূর থেকে ডাক দিয়ে যায় "ও দোকানী সিকি জমুক নেব অনেক কিছু "


পরিচিতি  
চন্দ্রা মুখার্জী চন্দ্রা মুখার্জী Reviewed by Pd on ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.