শুক্লা সান্যাল



অনেক দিন পর সাবু পিসির সাথে দেখা হল। অসম্ভব শুচিবায়ুগ্রস্ত। কেউছুঁয়ে দিলেই কাপড় কাচবে। আর যদি কুকুরে ছুঁয়ে দেয় তাহলে পৌষমাসের সন্ধ্যাতেও স্নান করবে। ঘরে তার গৌর নিতাইএর নিত্য সেবা হয়। হাঁটুর উপর কাপড় পড়াইছিল তার অভ্যেস। মুখ বেঁকিয়ে বলতো  দুনিয়ার লোকের কাশ থুতু  যদি শাড়িতে ঠেকে? সেই সাবু পিসির এত পরিবর্তন? নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পিসির মস্ত উঠোন জুড়ে ৩৫/৪০টা মাটির সরা লাইন দিয়ে রাখা উঠোন সংলগ্ন চালা ঘরেগোটা ২০/২৫টা নানা রঙের কুকুর শুয়ে আছে বাকিগুলো উঠোনে পায়চারি করছে। তাদের সাথেই গোটা পাঁচ ছয় বিড়াল  বিড়ালী তাদের ছানাপোনা নিয়ে শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছে। কুকুরের সঙ্গে শান্তিপূর্ন সহাবস্থান। এতগুলো কুকুর দেখে ভয় পাবারই কথা। আমি আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখেপিসি ডাকল আয় ভেতরে আয়  কেউ কিছু বলবে না।আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম এত কুকুর পুষেছো কেন? পিসি যেন জ্বলে উঠলো খবরদার ওদের কুকুর বলবি না  ওরাই আমার সব আমার সন্তান আমার মহাপ্রভু আমার রক্ষাকর্তা সব। তাছাড়া ওদের নাম আছে জানিস? ওরা কুকুর নয়। আমি ভয়ে ভয়ে বলি তা কি নাম শুনি? পিসি ললিতা বিশাখা থেকে শুরু করে ধর্মেন্দ্র হেমা মিঠুন শ্রীদেবী একগাদা নাম বলল। আমি হো হো করেহেসে ফেলায় পিসি'ও সহজ হয়ে গেল। বলল বোস।

সাবু পিসি আমার নিজের পিসি নয় আমার পিসির সই। কাজেই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ পিসির দুই ছেলে অজয় ও বিজয় পিসেমশায় রেলে গ্রুপ ডি কর্মচারী  ছিলেন। রিটায়ার করার পর মারা যান। কিন্তু অজয় বিজয় তাদের পরিবার কোথায় গেল? জিজ্ঞেস করতেও ভয় লাগছে। আবার কৌতূহলও মাথা চারা দিয়ে উঠছে ...।

কেন এত কুকুর পোষা? পিসি ঠাকুরঘরে ঢুকেছে আমার জন্য নাড়ু মোয়া বের করতে। কুকুরগুলো'র চালচলন সম্রাট সম্রাজ্ঞীর মতো। আমার প্রতি তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তাই এখন আর কুকুরের ভয় নেই। পিসি জল নাড়ু নিয়ে এল। আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম পিসি সব কথা খুলে বলো আমিসব শুনতে চাই। পিসির অবরুদ্ধ কান্নার বাঁধ ভাঙল।এ কটানা অনেকক্ষন কেঁদে একটু শান্ত হয়ে পিসি যা বলল তাতে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

মৃত্যুকালে পিসেমশায় ব্যাঙ্কে চারলাখটাকা টাকা রেখে গিয়েছিলেন পিসির নামে। আর ছিল পেনসন। ভালোয় চলতো অজয় বিজয়ও খাটছে। তাদের বিয়ে দিয়েছে। সুখের সংসার। অজয় বিজয়ার কিন্তু শান্তি নেই। ওই টাকাটা তাদের চাই। এই নিয়ে পিসির সাথে রোজ ঝগড়া। পিসিও নাছোড়বান্দা।বলে আমি মরার আগে তোদের কিচ্ছু দেবো না। মরার পর তো তোরাই পাবি। তা গুনধর পুত্ররা তা মানতে রাজি নয়। শেষে বিবাদ তুঙ্গে  পৌঁছালো। ঘটনা চরম মোড় নিল। একদিন ভর সন্ধ্যে বেলা পিসি জপ করছে। অজয় বিজয় পেপার নিয়ে হাজির। এখানে সই করো। পিসি বলল যদি না করি? তোমার বাপ করবে অজয় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। পিসির এক কথা না। বিজয় আর অপেক্ষা না করে একটা দড়ি দিয়ে পিসির গলায় ফাঁস লাগিয়ে দেয়। মরতে তোমাকে হবেই যক্ষীবুড়ি। ততক্ষণে পিসির জিব বেড়িয়ে গেছে। এরই নাম বুঝি মৃত্যু? তবু শেষবারের মতোমনে মনে নিজের গর্ভকে অভিসম্পাত দেয় পিসি। হঠাৎ বাঁধনটা যেন হাল্কা লাগে! কোথায় বসে ছিল কুকুরটা। ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের উপর আঁচড়ে কামড়ে ক্ষত বিক্ষত ।লোকজন জুটেগেল।

পিসি আর পুলিসি হাঙ্গামায় যায়নি। কিন্তু অজয় বিজয়কে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সেই শুরু। যে কুকুরকে সে এত অবহেলা করেছে সেই কুকুর তার প্রাণ রক্ষা করেছে। আর সন্তান? মাতৃঋণ শোধকরেছে মাকে হত্যা করতে এসে। একটানা কথাগুলো বলে পিসি তখন হাঁফাচ্ছে।

তিনবছরে তার বত্রিশটা কুকুর আর ছটা বিড়াল জুটেছে। তাদের জন্য পিসি এখন মাংসের ছাঁট কিনেএনে রান্না করে দেয়। তারপর স্নান করে। পিসি বলে এটাই আমার প্রভুর নির্দেশ।ওরা যে কিষ্টে র জীব। আমি ভাল আছিরে বিনু আমার কোন কষ্ট নেই., কপালে হাত ঠেকিয়ে পিসি বলল গৌর হরি গৌর হরি। কিন্তু পিসির দুগাল বেয়ে নামছে জলের ধারা।

আজ পিসির নতুন চেহারা নতুন ভাবনা দেখে অনুপ্রাণিত হলাম। নতুন প্রাণের পরশে জেগে উঠলাম আমি। এমন মানুষও আছে এ জগতে? গৌরহরি নয় পিসিকে একটা প্রনাম করে বেড়িয়ে এলাম। মনে হল যেন দেবী দর্শন করলাম।

পরিচিতি
শুক্লা সান্যাল শুক্লা সান্যাল Reviewed by Pd on নভেম্বর ২১, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.