সেখ সাদ্দাম হোসেন




প্রতাপ আজ একটু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে । অফিসের কাজে কলকাতা যেতে হবে । তাই তারতারি মুখ-হাত ধুয়ে ব্রেকফাস্টের টেবিলে এসে বসলো । মায়া কিচেন রুমে । বাটার টোস্ট আর কফি তৈরি করছে । 
--‘মায়া, প্লিজ একটু তারাতরি করো ।আমার ট্রেন মিশ্ হয়ে যাবে ।
--এই তো আর দু মিনিট ।

ওই দু মিনিটের ফাঁকে প্রতাপ খবরের কাগজে চোখ বোলাতে লাগলো ।ধূস আজকেও ধর্ষনের খবর । ভাল্লাগে না আর । প্রতাপ খবরটা না পড়ে জাস্ট টাচ করে এগিয়ে যেতে চাইলো । কিন্তু হঠ করে খবরটি থেকে একটা পরিচিত গ্রামের নাম তার রেটিনাতে আটকে গেলো । আচ্ছা বাঙালী হয়ে, বাঙালীর উৎসুক মনকে প্রতাপ কি কখনো অস্বীকার করতে পারে ? তাই উৎসুক হয়েই প্রতাপ খবরটি পড়তে শুরু করলো ।

খবরটি পড়া শেষ হওয়া মাত্রই, তার বাড়ির চারপাশ থেকে আসা গাড়ি-ঘোড়া, কল-কারখানার আওয়াজ আচমকা প্রতাপের কান থেকে উধাও হয়ে গেল । দু কানের ভীতর শুধু একটা তীব্র চিঁ শব্দ …
তার চোখের সামনে পুরো পৃথিবীটাই নিরুদ্দেশ । শুধু চিত্রায়িত হচ্ছে এক পুরানো দিনের জলছবি …

তারপর থেকে প্রায় দিনই প্রতাপ আর তৃষা একই বাসে যাতয়াত করতো । বাসে ওদের গল্প হতো খুব । ধীরে ধীরে তৃষার ভালোলাগা মন্দলাগা গুলো যেন প্রতাপের সাথে মিলে যেতে লাগলো । নিজের খেই হারাতে লাগলো প্রতাপ । সারাক্ষন সে শুধু তৃষার কথায় ভাবতে লাগলো । ভেবে ভেবে প্রতাপ ঠিক করলো সরস্বতী পূজোর দিন সে তৃষাকে তার মনের কথা জানাবে ।

সরস্বতী পূজা এল । প্রতাপ সকাল সকাল রেডি হয়ে সোজা তৃষার স্কুলে । তৃষা তখন পূজার ভোগের জন্য ফল কাটতে ব্যস্ত । প্রতাপকে তাঁর স্কুলে দেখে তৃষা বেজায় খুশি হয়েছিল । প্রতাপ ইশারা করে তৃষাকে ডাকলো । তৃষা আসতে প্রতাপ তাঁকে স্কুলের দোতলার বারান্দায় নিয়ে গেলো ।

--(তারপর তৃষার হাত ধরে বললো) ‘ তৃষা আমি তোমাকে ভালোবাসি । তোমার জন্য আমার রাতের আকাশ জেগে থাকে দিনের আলোর মতোই । তুমি ছাড়া আমার সব রাজত্ব মিথ্যা’ ।

তৃষা কথাগুলো শুনে একেবারে থ … তার উপর আবার কাব্যিক পোজ । কি বলবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না ।
--(অবশেষে থতোমতো খেয়ে) ‘দ্যাখো প্রতাপ, আমি জানি তুমি ভালো ছেলে । তোমার মতো ডিসেন্ট ছেলেকে সব মেয়েরাই পেতে চাইবে । কিন্তু… আমি অলরেডি একটি ছেলেকে ভালোবাসি । ওর নাম চন্দন । তুমি একটু ওয়েট করো, চন্দন এক্ষুনি এসে যাবে । তোমার সাথে আলাপ করিয়ে দেবো ।’

সেদিন প্রতাপ আর ওয়েট করেনি । হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই সোজা বাড়ি ফিরে এসেছিল । তিল তিল করে নিজেকে সামলে নিতে প্রতাপের সময় লেগেছিল প্রায় তিন মাস ।

“তৃষার বর্তমান খুব অসহায় । জানি এই অসময়ে চন্দন আর কোনো কারণেই তৃষার পাশে থাকবে না । কুমারীত্ব চলে গেলে এই ভয়ংকর সমাজ তাঁকে নির্লজ্জভাবে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায় । তাঁর প্রতিটি স্বপ্ন, প্রতিটি আশা-আকাঙ্খা বিশ বাঁও জলে দাঁত দেখিয়ে হাঁসতে হাঁসতে ডুবে যায় । এমত অবস্থায় মনে হয় জীবন অপেক্ষা মৃত্যু অনেক সহজ । এমনটা হয়তো তৃষার সাথেও হবে” ।

প্রতাপের ভীতরটা গুমড়ে গুমড়ে ওঠে । কি করবে ভেবে পায় না । তারপর নিজর অজান্তেই প্রশ্ন করে বসে –
--‘আচ্ছা মায়া, আমি যদি কোনোদিন কোনো অসহায় মেয়েকে একটু সিঁদুরে রাঙিয়ে দিই । যদি ফিরিয়ে দিই তাঁর বেঁচে থাকার স্বাধীনতা । তাহলে তুমি কি আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে ?’

প্রশ্নটা করেই প্রতাপের বুক ধরাস ধরাস করতে থাকে । কিছুক্ষন পর্যন্ত কোনো উত্তর না মেলায়, প্রতাপ ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া শিশুর মতো আস্তে আস্তে চোখ খোলে । কিন্তু মায়া তো সেই ঘরে নেই । 
‘কই গো শুনছো, ডিনার রেডি করে ফেলেছি । এসো খেয়ে নিই । তোমার আজ খুব জার্নি হয়েছে, তাই তারাতারি শুয়ে পড়বো’ – কিচেন থেকে ডাক দেয় মায়া ।

মায়া কখন যে উঠে কিচেনে চলে গেছিলো প্রতাপ তা জানতেও পারেনি । মায়ার কথাগুলো শুনে প্রতাপ যেন জীবন ফিরে পেল । তারপর দুজনে ডিনার সেরে বিছানায় শরীর দিলো ।
--আচ্ছা মায়া তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারি ?

--কি হয়েছে বলোতো তোমার ? নিজের বউকে প্রশ্ন করবে, তাও আবার অনুমতি চাইছো ? বলো কি প্রশ্ন ?
(না, সেই প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করার সাহস প্রতাপ আর দ্যাখায়নি ।)
--‘আচ্ছা মায়া তুমি আমাকে ঠিক কতোটা ভালোবসো ? একটা মানুষের কি ভালোবাসার ক্ষমতা অসীম ?’

রেডি । শুনেছি তোমার বস্ টা নাকি খুব খিটখিটে । নাও তারাতারি খেয়ে নাও । আমি ততক্ষন তোমার ব্যাগটা গুছিয়ে দিচ্ছি ।
কোনো কথা না বলেই প্রতাপ দ্রুত খাওয়া শেষ করলো । তারপর রওনা দিল কলকাতা ।

প্রতাপ তখন নেতাজী মহাবিদ্যালয়ের থার্ড ইয়ারের ছাত্র । বাড়ি থেকে কলেজ প্রতিদিন বাসে যাতয়াত করে । 
প্রতাপ সেদিন কলেজ যাচ্ছিল । ইঁটপাঁজা স্টপেজ থেকে বাসে উঠলো মেয়েটি । স্কুল ছাত্রী । বেশ স্মার্ট আবভাব । কাঁচ কাঁচ গায়ের রঙ । প্রতাপ আগে কোনোদিন মেয়েটিকে দ্যাখেনি ।

পরদিন আবার প্রতাপের বাসেই উঠলো মেয়েটি । সেদিন বাসে খুব ভীড় । ঠিক মতো দাঁড়িয়ে থাকাও যাচ্ছিল না । তার উপর মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো ইচ্ছাকৃত ভাবেই হোক কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই হোক, বারবার মেয়েটির শরীরের উপর এসে ঝুঁকে পড়ছিল । অস্বস্তি হচ্ছিল মেয়েটির । ঘটনাটা দেখে তার চেয়েও বেশি অস্বস্তি হলো প্রতাপের ।

--(প্রতাপ নিজের সিটটা ছেড়ে) ‘এই যে ! তুমি এখানে এসে বসো । আমি দাঁড়াচ্ছি ।’
--(মেয়েটি সিটে বসে প্রতাপকে) থ্যাঙ্কস্ ।
-- ইউ ওয়েল কাম ।

এরপর একদিন বাসেই দুজনের পরিচয় পর্ব দেনলেন হলো । মেয়েটির নাম তৃষা । আরামবাগ গ্লার্লস স্কুলে ক্লাস ইলেভেনে নতুন ভর্তি হয়েছে । ওর বাড়ি কুহুগ্রাম । তৃষা রোজ ত্রিশ মিনিট সাইকেলিং করে ইঁটপাঁজা আসে । তারপর ওখান থেকে বাসে করে স্কুলে । 

পরের বছর গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট । গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেই চাকরি পেয়ে যায় প্রতাপ । আর তার পরের বছরেই মায়ার সাথে প্রতাপের বিয়ে । না আর প্রেম নয়, বাড়ি থেকে সম্বন্ধ করেই বিয়েটা হয় ।

প্রতাপ কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরে এলো । তখন ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যে সাতটা দশ । চোখ মুখ বিষন্ন । খবরটা পড়ার পর থেকে প্রতাপের সবকিছু যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে । নিজেকে বেঁধে রাখতে পারছে না । মনে ধিক্কার জমে গেছে খুব ।

আর ধিক্কার জমবেই না কেন ? তৃষা ওদের কি দোষ করেছিল ? কলেজ শেষে টিউশনি পড়ে সন্ধ্যের সময় বাড়ি ফিরছিল তৃষা । হঠাৎ করে অন্ধকার থেকে চারটে লোক বেরিয়ে এসে তাঁর পথ আটকায় । তারপর জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে….  একেবারে যা তা অবস্থা । তৃষা হাসপাতালে ভর্তি ।

প্রতাপ মুখ-হাত ধুয়ে একটু ফ্রেশ হবার চেষ্টা করে । মায়া এক কাপ কফি এনে….
--তোমার কলকাতা যাত্রা ক্যামন হোলো গো ?
--খুব একটা ভালো না !
মায়া আর কারণ জিজ্ঞাসা করেনি । টিভির রিমোট নিয়ে এসে বসলো । সিরিয়াল দেখবে ।
প্রতাপ বালিশে ঠেস দিয়ে উল্টোমুখে শুয়ে রইলো । এখনও সেই খবরটা তার শিরায় শিরায় আন্দোলিত হচ্ছে । প্রতাপ চোখ বুজে তৃষার কথায় ভাবতে লাগলো ।

--“ শোনো প্রতাপ, তোমাকে বিয়ে করার আগে আমি সম্রাজ্ঞী ছিলাম, সম্রাজ্ঞী । কিন্তু বিয়ের পর এক এক করে ধারাপাতের যতদিন অতিবাহিত করেছি, তোমার ভালোবাসার কাছে ততো ঋনী হয়েছি । আজ আমি সম্রাজ্ঞী নই, তোমার ভালোবাসায় কাঙালী অসহায় এক নারী । আমাকে কোনোদিন ভালোবাসতে বলোনা প্রতাপ, শুধু ঋনী কোরো চিরকাল ।”

কথাগুলো শুনে প্রতাপের চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল এক আকাশ পর্দা । সে পর্দায় মায়ার মুখের উপর জড়িয়ে যাচ্ছিলো তৃষার মুখ । আর তৃষার মুখের উপর জড়িয়ে যাচ্ছিলো মায়ার মুখ । প্রতাপ শুধু এক নির্বোধ দর্শক ।

প্রতাপ জানতেও পারেনি, পর্দার আড়ালে যে চতুর্থ ব্যক্তিটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁসছে, তিনি স্বয়ং ঈশ্বর । আজ বোধহয় ঈশ্বর নিজেও বুঝেতে পারেননি, এখানে আসলে অসহায় কে ? 
তৃষা ? না মায়া ?
নাকি প্রতাপ নিজে ?


পরিচিতি  

সেখ সাদ্দাম হোসেন সেখ সাদ্দাম হোসেন Reviewed by Pd on নভেম্বর ২১, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.