ঝিলিমিলি



যখন পরিশুদ্ধ মন বিবেকের আলোয় জেগে উঠে তখনি আলোর স্ফূরণ ঘটে। মন ও দেহ বহির্জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে পঞ্চেন্দ্রিয়ের সংযোগে আর সে সকল অভিজ্ঞতালব্ধ তত্ববহুল কথা সঞ্চয় হয়ে যায় মানু্ষের হৃদয় ও মস্তিষ্কের কোষে কোষে। এই সকল আলোকবাহী কণিকারা প্রথমত মানুষের নিজস্ব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পরে অথবা বলা যেতে পারে তার শরীরের রক্তের যে বাহন তাতে তারা আলাপচারিতা থাকে। যখনই কোন ঘটনার সূত্রপাত ঘটে তখন সেই সকল তথ্যবহুল বোধগুলো জোট বেধে আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সচল হয়ে উঠে আর প্রয়োজনমাত্র মানব সমুদ্রে সেই সকল তথ্যগুলোর সঠিক প্রয়োগে ধ্যান-ধারণাগুলোর প্রকাশ ঘটে থাকে। এক পর্যায়ে এই আলোকবর্তিকাসমূহ কল্যাণকর হয়ে ফলপ্রসূ হয় পৃথিবীর সমাজ তথা মানুষের জন্যে। প্রতিটি সুস্থ মানুষের বিকাশের দ্বারাই আমাদের সমাজ সম্বৃদ্ধ হয়ে ন্যায় নীতির আলোকে উদ্ভাসিত হবে তাতে সন্দেহ নাই।

যে আলোকে আমরা খুঁজে ফিরছি সে কিন্তু আমাদের নিজেদের সত্ত্বার মধ্যেই প্রতিনিধিত্ব বা ঘুরাফেরা করছে –আমাদের সেই সকল মৌলিক সত্ত্বাকে খুঁজে নেবার ক্ষমতা ক্ষিপ্রতার সাথে মনমানসিকতায় গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সর্ব ইন্দ্রিয়ের সামনে যা কিছু আছে, সে সব কিছুর উৎস হল ঈশ্বর বা আলো। যে হাতের পরশে আমরা সৃজন হয়েছি আমরা সেখান থেকেই সৃষ্টিমুখী কিছু সৃজন করার ক্ষমতাও পেয়েছি। ঈশ্বর আমাদের মধ্য দিয়ে বিচ্ছুরণ হচ্ছেন আলোর ছটা দিয়ে যেখানে সদা-সত্য-আনন্দ বই অন্য কোন কলুষতা নাই। মানুষের নিভৃতের মননকোষে ঈশ্বররূপী যে আলোক বিরাজমান তাকে প্রকাশ করার সীমানা থাকে – এই সীমানা আপাত নির্ভর পৃথিবীর পর। তাই ঈশ্বর বা আলো হচ্ছে প্রকৃতিরই রূপ আর সকল প্রাণী কূলের অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে তিনি প্রকাশিত হয়ে থাকেন।

মানুষের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার নিমিত্তে পঞ্চেন্দ্রিয়ের ক্রিয়াকলাপ সমূহ রচিত হয়েছে আর বেঁচে থাকার জন্যে আবার আলো-বাতাস-পানি সরাসরিভাবে জড়িত। কিন্তু মানুষের সঙ্গে পশু-পাখির পার্থক্য এখানেই –শুধু মাত্র বেঁচে থাকার জন্যে নয়, মানুষ হিসাবে থাকে আমাদের একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধতা ও শ্রদ্ধাবধ। মানুষের বিবেচনাবোধ সবসময় ঈশ্বরের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য খুঁজে, ভালোবাসার নৈকট্য যত কাছের হয় সততা তত কাঁচের মত স্বচ্ছ হয়। সাধারণত ধর্মগ্রন্থের অনুসারীদের আমরা দেখি ঈশ্বরের নির্দেশনার পথের বাইরে চলতে শাস্তির ভয় করে থাকেন, ফলে তারা গ্রন্থের নির্দেশিত পথে নির্বিঘ্নে চলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। কিন্তু ঈশ্বর বা আলোর একটি নিজস্ব সত্ত্বা আছে,  সে যুক্তির সমর্থনে নিশ্চয়তা বেধে পথ কাটতে পছন্দ করে আর মানুষেরা তাদের কাঠামোকে ঠিক ঈশ্বরের চেহারাতেই দৃঢ়মূলে তৈরি করে নেন যেন সঠিক লক্ষ্যে যেতে সমর্থ হতে পারেন। আর মানুষের প্রকৃত ধর্ম সেখানেই আলো হয়ে পথ দেখায় যেখানে মিথ্যার ক্ষুদ্রতম জায়গার অবকাশ নাই। তাই আমরা যেন আমাদের সহজাত শিক্ষাকে কর্মকাণ্ডে বেধে সাধনা বা পরিচর্যায় লিপ্ত হয়ে একটা সুন্দর পৃথিবীকে গড়তে পারি পরিশীলিত হয়ে, আজ আমাদের রুচি ও বুদ্ধিমত্তা তারই তাগিদ দেয়।

মানুষের দক্ষতা তার নির্দিষ্ট আঙ্গিকে যত প্রখর হবে সেই আঙ্গিকে তার ব্যাক্তিত্বও তুখোড় হবে ভুল নাই আর তখনি সেই মানুষেরাই পারে একটি সমাজে সুস্থ চেতনা দিতে। তাই সুস্থ পরিবেশ, সুস্থ মানুষ জীবনের প্রতি মুহুর্তে আমাদের কাম্য। সংস্কৃতিমান মনের খোরাকে নিজেদেরকে তৈরি করার আহ্বান চিরকালের এবং মানুষের পরস্পরের সঙ্গেই ভাবের আদান প্রদানের মধ্যে দিয়ে সঙ্গীতের মত তা বিস্তার লাভ করতে পারে। মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ এই দুইয়ের সমন্বয় থাকবেই, মিলন-বিরহের মধ্য দিয়েই পূর্ণতার রূপ পায় বিভিন্ন অনুভূতির রস-রঞ্জনের সন্নিবেশ সহকারে। ব্যাক্তিগত অনুভবকে ছাপিয়ে বিশ্বমানবের মিলন তীর্থে প্রকৃত সত্য ধাবিত হয় আর সেখানেই সকল সৃষ্টি স্বার্থকতার দুয়ার খুলে দেয়।

আলোর ফুয়ারা নীরব সৃষ্টির মাধ্যমেও সর্ব মানবের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে। একটি চিত্রকর্ম যে সৌন্দর্য প্রকাশ করে তা মানুষের অনুভবের মধ্যে আবেগের জন্ম দেয়, সেখানের বিশ্বজনীন ভাষা থাকে যাকে আলাদা করে ব্যাক্ত করতে হয় না প্রতিটি জাতিস্বত্বা ধরে ধরে। তেমনি ভাবে বাগানের ফুলের সৌন্দর্যের কথা ব্যাক্ত করতে পারি -–চোখের ভাষা সেখানে নিবিড় হয়ে অন্তরের আলোর সমারোহে ধরা পরে। প্রকৃতি ও প্রাণী কূলের ছোট ছোট প্রতিটি ঘটনা আলোর দাবী নিয়ে ঘটে – পাখির গানে যে আনন্দ তা’তো ঈশ্বরের বন্দনায় আত্মপ্রকাশ করে। আমাদের ছোট ছোট আত্ম-উপোলব্ধির মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর আবির্ভূত হন আর সেখানে একটি  মহাশক্তির দিক নির্দেশনাই থাকে। আলো ফলাবার জন্যে নানা রকম প্রতিকূল পরিস্থিতিও অনুকূলে কাজ করে থাকে। দেখা যায় দুঃখের মধ্যেও পরমশক্তি ঘনঘটার রবে প্রচ্ছন্ন থাকে, সংসারে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত যারা তারাও আলোর পথ পেয়ে যায় নিজেদের দূর্দশা থেকে মুক্ত করে নেবার জন্যে। হৃদয়ে শুভ ইচ্ছা প্রেরণ করে আলোর কণিকাসমূহ, মানুষ সেই আলোর উৎস ধরে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। যতদিন না মানুষ তার সত্যের ভেতরে সঠিক ভাবে আত্মপ্রকাশ না করে মানুষ মুক্তি পাবে না স্থিরতারে নিয়ে। অলীক ভাবনা মানুষকে তাড়িয়ে নিলেই সে কষ্ট পায়, বিজ্ঞান ও দর্শনের নিবিড় যোগাযোগে প্রতিটি সত্য-সুন্দরের আবির্ভাব হয়ে থাকে এই আলোকেরই ঘরে।

এক অর্থে দেখা যায় আলো মানে ঈশ্বর, ভালোবাসা বা মানুষের কল্যাণের সাধনা যেখানে সবকিছু এক হয়ে মিলে যায়। পৃথিবীতে নির্মলভাবে পদার্পণ আর নিষ্ঠুরভাবে তার প্রস্থানের খেলা চলে প্রতিনিয়ত জন্ম মৃত্যুর ক্ষণ ধরে। কিন্তু একটু চিন্তা করলে দেখা যায় পৃথিবী সে সকল দহনভার হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছে, কারণ এই দুইয়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম মিল রয়ে গেছে যার ফলে ভারসাম্যের সৃষ্টি হয়েছে। আর এমন চক্রাকারের সৃষ্টির রহস্যে আলোর প্রনিধান অবদান রয়েছে। একমাত্র আলোই মানুষের চিত্তের মুক্তি দিতে পারে।

মানুষের মনে এই আলো বা ঈশ্বরের অসীম বসবাসের ফলে মানুষ তার সমগ্র জীবনের অস্তিত্ব ধরে রাখতে সক্ষম। প্রতিটি মানুষের ভেতরে জানার আগ্রহ হল একটি সহজাত প্রবণতা আর তার সেই আত্মাই প্রদীপের সলতা হয়ে জ্বলে পথ দেখাতে সাহায্য করে থাকে। তবু যখন মানুষ সমস্ত প্রশ্নের জবাব না পেয়ে ফিরে আসে তার ক্ষুদ্রতার বোধ নিয়ে, তখন তার আপন সত্ত্বায় মজুত করা যত সঞ্চয় ছিল সেই সকল অহং ত্যাগ করতে সে বাধ্য হয়। সে জানে শেষ অবধি কোন প্রশ্নের জবাব পাওয়া হয় না, বৈজ্ঞানিক উত্তরও হয় না –মানুষের গন্তব্য কোথায়, কোথায় সে যাবে আর কোথা থেকে সে এসেছে? আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অস্তিত্ব বন্ধু-বান্ধব, পরিবার বা দেশকে ছাড়িয়ে অনেক কিছুতেই অন্তর্ভূক্তি হতে পারে একাত্মোতাকে বেধে, কিন্তু মানুষ তার নিজের জীবনের পরিপূর্ণ চিত্র না পেয়ে আজও একটা নিরাপত্তাহীনতায় বা গ্লানিতে ভূগে থাকে। মানুষ ধর্মে আশ্রয় নেয় –অথচ সেই ধর্মই হয়ে উঠে যুদ্ধ ক্ষেত্রের কৌশলের বিরাট হাতিয়ার আর আমরা চিহ্নিত হয়ে উঠি জাতিগত বৈষম্যের কারণ হয়ে একে অপরের শত্রুরুপে ভাতৃত্ব সম্পর্ক নির্ণয়ের বদলে, কারণ ধর্মের সঠিক আলো চিনতে আমরা বেশীর ভাগ মানুষ অপরাগ। আর রাজনৈতিক মতবাদ আমাদের সঠিক নকশা দেবার বদলে চতুরতার দাবীতে সন্নিবেশ করে থাকে –কাজেই এখান থেকেও নিজেদেরকে রক্ষা করার কোন উপায় থাকে না । মানুষের মনের যে যুক্তি নৈতিকতার নিকটে নিয়ে যায় আর সকল অস্তিত্বের সত্ত্বায় যে আদি ও অনন্ত আধিপত্য করছে যুগযুগ ধরে তাকেই আমরা বন্দনা করি না কেন কর্ম প্রহরের সীমানা ধরে যার আলোর ছত্রছায়ার পৃথিবীবাসিন্দা হয়ে আমরা আছি?

নিত্যদিন আমরা খুঁজেই চলছি জিজ্ঞাসার উত্তর –সাহিত্যের হাতে সেই আলো ধরা, সেও খুঁজে চলছে। রবি ঠাকুরও এভাবে খুঁজেই চলেছিলেন তার এমন ধারার অনেক অনেক কবিতার মর্মমূলে –প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলেন কি ? 

মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে 
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা । 
----কে সে। জানি না কে। চিনি নাই তারে। 
শুধু এইটুকু জানি, তাঁরি লাগি রাত্রি অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে,
ঝড় ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে 
অন্তর প্রদীপ-খানি। 
কে সে, চিনি নাই তারে।  
     
~ কবি পরিচিতি ~ 
ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি Reviewed by Pd on অক্টোবর ২৩, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.