এম, আর, ফারজানা



চন্দ্র কারিগরের কাছে আপনি ভাল থাকুন
-------------------------------------------



হুমায়ূন আহমেদঃ (১৯৪৮-২০১২)। কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে যিনি চন্দ্র কারিগরের কাছে চলে গেলেন মাথা উঁচু করে তিনি জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। যার লেখায় অভাবনীয় সুন্দরের প্রতিচ্ছবি উঠে আসতো অনায়াসে,মুহূর্তে পাঠক হারিয়ে যেত অন্য জগতে। একজন হিমুকে সৃষ্টি করার মত ক্ষমতা আমাদের নেই কিংবা একজন মিছির আলীর রহস্য উদ্ঘাটন কে করবে? সব ক্ষেত্রে তার সাফল্য ছিল অভাবনীয়।


ক্যান্সার নিয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নিউইয়র্ক সময় বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ২০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ২০ মিনিট) বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুকালে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এই লেখকের বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। বৃহদান্ত্রে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য নিউ ইয়র্কে যান হুমায়ূন আহমেদ। সেখানে মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন তিনি। দুই পর্বে মোট ১২টি কেমো থেরাপি নেওয়ার পর গত ১২ জুন বেলভ্যু হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের প্রধান ডা. জেইন এবং ক্যান্সার সার্জন জজ মিলারের নেতৃত্বে হুমায়ূন আহমেদের দেহে অস্ত্রোপচার হয়।

আমাদের সাহিত্য জগতে উজ্জল আলোয় আলোকিত হয়ে থাকবেন তিনি তার সৃষ্টি কর্মের মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, নাট্যকার । বাংলা কল্পবিজ্ঞানে সাহিত্যের পথিকৃৎ । চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি সমাদৃত ছিলেন। তাকে নিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, “অনেক উৎকৃষ্ট রচনাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সস্তা চতুর্থ শ্রেণীর লেখকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।”

হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের কুতুবপুর গ্রামে। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি । বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা গৃহিনী। ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতকোত্তর পাশ করে তিনি একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অধ্যাপক যোসেফ এডওয়ার্ড গ্লাসের তত্ত্বাবধানে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন।

লেখালেখি ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত সময় দেবার জন্য পরবর্তীতে অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে দেন তিনি। গত কয়েক দশক ধরেই বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর আত্মপ্রকাশ। তারপর একে একে ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘রজনী’, ‘গৌরিপুর জংশন’, ‘অয়োময়ো’, ‘দূরে কোথাও’, ‘ফেরা’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আমার আছে জল’, ‘অচিনপুর’, ‘এইসব দিনরাত্রি’সহ দুই শতাধিক উপন্যাসের স্রষ্টা হূমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্যে, মিছির আলী হিমুর মতো জনপ্রিয় চরিত্রেরও স্রষ্টা তিনি। কেবল অধ্যাপনা আর কথাসাহিত্যই নয়, চলচ্চিত্র নির্মাণেও হূমায়ূন আহমেদ ছিলেন এক সুদ কারিগর। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়া’ বিদেশী ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তাঁর অন্য কীর্তি ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র। টিভি নাট্যকার হিসেবেও হূমায়ূন আহমেদ ছিলেন সমান জনপ্রিয়। আশির দশকের মাঝামাঝি তাঁর প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ তাঁকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা।

১৯৭৩ সালে গুলতেকিনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ । হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলে-মেয়ে। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে তিনি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। সাহিত্যে নিজের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ অর্জন করেছেন একুশে পদক (১৯৯৪), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।


বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি তিনি। বাংলা সাহিত্য জগতে যা রেখে গেছেন তা অতুলনীয় অভূতপূর্ব । তার সৃষ্টি কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি আগামি প্রজন্মের মাঝে বেঁচে থাকবেন । তার মতো প্রাণ প্রাচুর্যভরা মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভার মৃত্যু নেই । তাকে মনে রাখবে তাঁর পাঠকরা।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ