ফারহানা খানম








আগুন


আজকের দিনের শুরুটা খুব অন্যরকম সুন্দর,বিনুর ঘুমভাঙলো ফোনের শব্দে বিনু শুয়েই রিসিভার কানে ধরে বলে হ্যালো ...ওই প্রান্ত থেকে ভেসে আসে মেজদির আনন্দিত কণ্ঠ ,''বিনু দেখ লাবণ্য কে বি,বি,সি তে দেখাচ্ছে ও এখন অনেক বড় মডেল,বিশ্বের সেরা কোম্পানিগুলোর একটার ব্র্যান্ড আম্বেস্যডার হয়ে বার্নভিকটিমদের জন্য কাজ করবে।

লাবণ্য পড়াশুনায়ও খুব ভাল সে ডাক্তারি পড়ছে ইংল্যান্ডেই । মেজদি ও ভাইয়া ওখানেই চাকরি করেন ।
বিনুর মনটা আনন্দে ভরে যায় সেই ছোট্ট লাবণ্য যার জীবন বাঁচানো নিয়েই শংশয় ছিল ডাক্তারদের মনে , তিন মাস যে মেয়েটি গায়ে কাপড় দিতে পারেনি, প্রচণ্ড শীতে রুমহিটার অন করে থাকতে হয়েছে ,গরমে এসির নিচে থেকেছে ,কতকাল সে বাইরের পৃথিবী দেখেনি,মশারিঘেরা খাটে শুয়ে থেকেছে মা ডাক্তার আর সিস্টার ছাড়া কত প্রিয় মুখ সে দেখেনি কতদিন ...ভাইয়া নানু দাদু খালা খেলার বন্ধুদের কাওকেই সে দেখতে পেতনা ।সারাগায়ে আগুনে পোড়া ক্ষত,ঘা হয়ে গিয়েছিল রক্ত দিতে হচ্ছিল, লাবণ্য এক এক সময় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলো ,প্রলাপ বকছিল আগুন আগুন বলে চিৎকার করে উঠতো মাঝে মাঝেই ,বিনুর মনে পড়তে থাকে সেই বীভৎস দিনগুলোর কথা ।

তারপর যখন একটু সুস্থ হোল একদিন স্কুলে গেল ,সবাই ওকে দেখে হাসছিল অভিমানে ও পড়াশুনা বন্ধ করে দিল, বাবা তখন খুব ব্যাস্ত ওর চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে ,কিন্তু তখন অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। গারেয় পোড়া দাগ মিলিয়ে যাবে এমন সম্ভাবনা খুব কম । কিন্তু তার আগেও কিছু করার ছিলনা ওই অবস্থায় ওকে বিদেশে নেয়া অসম্ভব ছিল।
লাবণ্য ও ফোন করে আনন্দিত কণ্ঠে বলে খালামনি আমাকে দেখেছো ? বিনু বলে হ্যাঁ মা দেখেছি ভীষণ আনন্দ লাগছে , আজ গরীব দুঃখীদের জন্য কিছু খাবার দেব আর তোর জন্যে অনেক অনেক দোয়া করবো রে ... হ্যাঁ খালামনি আমি নানুকেও ফোন করবো এখন রাখছি কেমন ! লাইন কেটে যায়।বিনু উঠে কাজে লাগে ,বাচ্চাদের খোজ নেয় এখনো ওঠেনি ওরা । থাক আজ ছুটির দিন ঘুমাক কিছুক্ষন । আজ মনে আনন্দ অনেকদিন পর কানে বেজে ওঠে আবীরের সেই কথা ...লাবণ্য পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে ও মরে যাচ্ছে তোমরা এস ।

খালামনির সাথে কথা বলতেই লাবন্যর খুব দেশের কথা মনে পরে যায় ।বন্ধুদের যদি একবার বলতে পারতো দেখ তোমারা সেদিন আমায় দেখে হেসেছিলে বিচ্ছিরি দাগ ছিল আমার গায়ে ,আর আমি বিশেষ ধরনের জামা পরেছিলাম তাই ...আমার মন খারাপ হয়েছিল ভেবেছিলাম সব শেষ ,কিন্তু আজ দেখো আমি হেরে যাইনি । আমি পড়াশুনা করেছি পাশাপাশি ফটোগ্রাফি করি শখে এই পড়া দাগ নিয়ে এই দেশে মডেলিং ও করি আমি প্রমান করেছি মনের জোর আর যোগ্যতা থাকলে চেহারা কিছু নয় ।
ওর মনে পড়ে যায় সেই দুর্ঘটনার দিনের কাথা । সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার ,খুব মন খারাপ নিয়েই ফিরেছিল নানুবাড়ি থেকে ।একবার ইচ্ছে হচ্ছিল আজ থেকে যাই আবার পোষা টিয়াটার জন্যেও মন কেমন করছিল । তাই বাসায় এসেও সারা দুপুর কেমন যেন মন খারাপ ছিল ,মনে আছে স্পষ্ট । বিকেলে টিয়ে পাখি টা নিয়ে ছাদে গিয়েছিল , খাঁচাটা রেখে রেলিং ধরে দারিয়ে ছিল অনেক্ষন ।

ঘরে ফেরা সন্ধ্যা মন কেনন করা এক অনুভূতি । লাবণ্য তখনো ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছে রক্ত লাল সূর্যটাকে ওর বয়স আট বছর ক্লাস থ্রী তে পড়ে আজ মন কেমন যেন শুধু মাকে খুঁজছে , কিন্তু মা'ত ডাক্তার এখনো হাসপাতালে অবশ্য আসার সময়ও হয়ে এসেছে । এমন সময় নীল গাড়িটা দেখল সে মা এল হাসপাতাল থেকে এখনি ডাক পড়বে জানে , নেমে এল সে মা বললেন ''কি রে আজ এত মন খারাপ কেন?' নানু বাড়ীতে থাকা হলনা তাই? '' লাবণ্য একবার তাকাল মায়ের দিকে তারপর নিজের ঘরে চলে গেল। মা খুব অবাক হলেন এত শান্ত মেয়েত সে নয় আজ কি হল ওর ? মুহূর্তেই মা চলেগেলেন ফ্রেশ হতে ।
কাল ছুটি এসময় প্রায় লাবণ্য নানু বাড়ি থেকে যায় কিন্তু আজ কেন যেন মন চাইলো না ,একবার বিনু খালামনি বলেছিল আজ থেকে যাও কিন্তু ভাইয়া এসে বলল চল বাড়ী যাই আজ আলম ভাই বাড়ি যাবে আম্মু রাতে তোমাকে নিতে আসতে পারবেনা ,লাবণ্য কেমন যেন অবসন্ন সে নিজের ইচ্ছেয় কিছুই করছে না এমন ভাবে কোনদিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি ভাংতে লাগলো বাসাতেই যাবে , বিনু খালামনি একবার ডাকল তাকালও না সে গাড়িতে উঠে চলে গেল দুই ভাইবোন ।ওদের স্কুল নানুর বাড়ির খুব কাছেই তাই আবীরের ছুটি পর্যন্ত লাবণ্য অপেক্ষা করে নানুর বাসায় এখানে তার অনেক খেলার সঙ্গী ,পাশের বাড়ির অনু ,মিতু ঝুনু খালার মেয়ে নিতু বিনু খালার ছেলে দিগন্ত সবাই ওর বন্ধু ।

ফ্রেশ হয়ে এসে মা আবীর, আর লাবণ্য কে ডাকেন বিকেলের নাস্তা মা এলে ওরা এক সাথেই খায় ,সারাদিনের গল্প হয়,এই সময় মাকে ছাড়া ওরা কিছু বোঝে না । মা বলেন বই নিয়ে বস তোমারা আমি আসছি পড়ার ঘরে ।
ওরা উঠে বই নিয়ে বসে ,এসময় কারেন্ট চলে গেল ,খোলা জানালায় জ্যোৎস্না খেলা করে বাগান থেকে ভেসে আসে হাস্নাহেনার গন্ধ। এ সময় ফোন বেজে উঠে মা কথা বলছেন ইংল্যান্ড থেকে বাবা ফোন করেছেন ।আলো নেই রুমে কয়দিন থেকে চার্জ লাইটও নষ্ট দুই ভাইবোন টেবিল ছেড়ে উঠে আসে ,বুয়া রান্নাঘরের বারান্দায় হারিকেন জ্বালাচ্ছে এই ফাঁকে আবীর ছাদে চলে যায় আর লাবণ্য দেখছিল বুয়ার কাজ ,হারিকেন টা নিভে গেল ...বুয়া বলল কেরোসিন ভরতে হবে ,এক বোতল কেরসিন নিয়ে অর্ধেক টা ঢালে হারিকেনে ,বোতলটা রাখতে গিয়ে হাত ফস্কে পড়ে গেল ,ছড়ালও মেঝেতে বুয়া ম্যচের কাঠী জ্বালাল সেটাও পড়ে গেলো মেঝেতেই আর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন , লাবুন্য সেই আগুনের মাঝে শুধু মা কোথাটি ই বলতে পারলো সে ... আর তার।।চারদিকে শুধু সোনালী আগুন আর কিছু মনে নেই তার ।
শোবার ঘর থেকে মা আর ছাদের সিঁড়ি থেকে আবীর দেখল একটা আগুনের শিখা ঘুরপাক খাচ্ছে বারান্দায় , মা দৌড়ে এসে কম্বল চেপে ধরলো আর আবীর বুয়া বুয়া বলে ডাকতে লাগলো পানির জন্যে বুয়া ততক্ষনে বাড়ির বাইরে । আবীর নিজেই মগে পানি এনে ছিটাতে লাগলো ...তারপর নিচ থেকে দাদুরা এলেন চাচা- চাচি এলেন লাবন্যর ওসব মনে নেই পড়ে সে এসব শুনেছে ।আবীর কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা দাদু বুড়ো মানুষ দাদাও তাই , চাচা গাড়ির খোঁজে গেছেন ওদের ড্রাইভার ত ছুটিতে ।

ও ভেবে চিনতে বিনুখালাকে ফোন করে কি বলবে সে বুঝতে পারছেনা ...বিনুখালামনি হ্যালো হ্যালো করছেন বিনু ফোন রেখেদিতে যাচ্ছিলো এসময় শুনতে পেল আবীরের কান্না ভেজা কণ্ঠ বলছে লাবন্য পুড়ে ছাই হচ্ছে মরে যাচ্ছে তোমরা এস প্লিজ ।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে আজো বিনুর এই কথাটা মাঝে মাঝেই কানে বাজত লাবণ্য পুড়ে ছাই হচ্ছে ...না লাবণ্য ছাই হয়নি আজ ঠিক ঘুরে দাঁড়িয়েছে জীবনের কাছে হার মানেনি সে ।


ঢাকা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন