নাসির ওয়াদেন

অগ্নিস্তূপে ভাবনার চিতা সাজিয়ে মুহূর্তের অপেক্ষা
বিপন্ন স্বদেশ, বিপন্ন সময় । এই সময়ে আমরা খুব ভালো নেই । প্রসঙ্গতঃ আলোচনা করতে গিয়ে বলতে পারি যে, দেশে এক জটিল সময়ের মধ্যে আমরা আছি। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার ক্রমাগত অবনতি ঘটছে । আর্থিক সমস্যাগুলো জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। তার উপর বিশ্বায়ণের দরজা উন্মুক্ত করা হয়েছে, প্রতিনিয়ত দেশের সম্পদ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, বিশেষতঃ উদারীকরণের নামে সনাতনী ঐতিহ্যকে নীলামে তুলে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান শাসনকালে বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠী বা দল নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির করতে, মুনাফা লাভের অভীপ্সায় আমাদের চিরায়ত সম্প্রীতির পুষ্প বনে হতাশার আগুন জ্বেলে মনকে বিনষ্ট করার অপপ্রয়াস অবিরত চালাচ্ছে । এক ধর্মের মৌলবাদী চিন্তার হুঙ্কারে অন্য ধর্মের মৌলবাদীর উল্লাস ও নগন্যতা প্রকটিত হচ্ছে । পরিকল্পনা মাফিক গণহত্যা, ধর্ষণ সংঘটিত হচ্ছে, ফলে ধর্মের শান্তির বাতায়নে সুশীতল ফল্গুধারা বিশুষ্ক না হয়ে আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, যা শুধু উষর করছে না, স্বাভাবিক জীবন যাপনে ঘোর সংকট ডেকে আনছে। কোন কোন জঙ্গী সংগঠন সুপরিকল্পিত ভাবে বিপরীত মেরুর দিগন্তে অশনি বান হেনে সাম্প্রদায়িক মুনাফা লাভের প্রচেষ্টায় অব্যাহত, ফলে আমরা মনে করি সন্ত্রাসবাদীদের কোন ধর্ম নেই, জাতি বিদ্বেষী -মানবতাবিরোধী ।

তারা নির্দিষ্ট কোন ধর্মের প্রতিনিধি হতে পারে না--তারা স্বদেশ বিদ্বেষী, মানবতার শত্রু। জাতিসত্বার নামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিতে বিভাজন করতে চাইছে। মহাত্মা গান্ধী, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, শ্রী রাজীব গান্ধী প্রমুখ নেতৃত্বের খুনের পিছনে উগ্র জাত্যভিমান যেমন আছে, তেমনি ঘৃণ্য অভিপ্রায়ও ছড়িয়ে আছে ।এই রকম নানান জটিলতা এ সময়ে নানা প্রকার রূপ ধারণ করে মানবতাবিরোধী আগ্রাসন দৃষ্টি নিয়ে ঊদারবাদের পথে চালিত করে , একচেটিয়া পুঁজিবাদের পক্ষে, উগ্র সাম্রাজ্যবাদীর শ্যেন দৃষ্টিতে আলোকপাত ঘটায়, শতাব্দীর পর শতাব্দী হিন্দু -মুসলমান দুটি বৃহৎ মানবতাবাদী ধর্মগোষ্ঠী পাশাপাশি বসবাস করে আসছে, কোনরকম সংঘাত বিদ্বেষ দেখিনি, কিন্তু বর্তমান সময়ে সেই সমান্তরাল ভালবাসা ক্রমশঃ সরে সরে যাচ্ছে ।

বিশ্ব বরেণ্য বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন -"আমাদের মধ্যে কেউ কেউ চোখ বুজে বলেন, সবই সহজ হয়ে যাবে যখন দেশটাকে নিজের হাতে পাই। অর্থাৎ নিজের বোঝাকে অবস্থা পরিবর্তনের কাঁধে চাপাতে পারব এই ভরসায় নিবিষ্ট থাকবার এই ছুতো। "অন্যত্র বলেছেন " বাংলাদেশে আমরা আছি জতুগৃহে, আগুন লাগাতে বেশিক্ষণ লাগে না । বাংলাদেশে পরের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে যখনই নামি ঠিক সেই সময়টাতেই নিজের ঘর সামলানো অসাধ্য হয়ে ওঠে । কারণটা আমাদের এখানে গভীর করে শিকড় গেড়েছে,  অবস্থায় শান্ত মনে বুদ্ধিপূর্বক পরস্পরের মধ্যে সন্ধি সহাবস্থানের উপায় উদ্ভাবনে যদি আমরা অক্ষম হই, বাঙালি প্রকৃতি সুলভ হৃদয়াবেগের ঝোঁকে যদি কেবলই জেদ জাগিয়ে স্পর্ধা পাকিয়ে তুলি, তাহলে আমাদের দুঃখের অন্ত থাকবে না ।" ভারতে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বিরাজ করছে । বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের প্রশ্নে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণায় নবমবার কারাগারে থাকাকালীন জওহরলাল নেহেরুর লেখা -" ভারত সন্ধানে "র " ভারতের বৈচিত্র ও একত্ব " শীর্ষক আলোচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে পারি - " ভারতের বৈচিত্র্যের তুলনা হয় না, স্বয়ম্প্রকাশ তার এই বিচিত্র রূপ... বাহিরের আকৃতিতে তো বটেই, প্রকৃতির দিক থেকেও স্বভাবের এই বিচিত্র ভারতের পরিচয় আছে ।প্রত্যেক জাতির আপন বৈশিষ্ট্য আছে -- একথা সত্য, কিন্তু ততোধিক সত্য হলো যে, এরা সবাই ভারতীয়। ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, প্রদেশ ভেদে নানা বিভিন্নতা থাকলেও তারা যুগ যুগ ধরে ভারতীয়ত্ব বজায় রেখেছে --তারা সকলেই একই সংস্কৃতির গৌরবে সমৃদ্ধ একই প্রকার মানসিক ও নৈতিক গুণাবলীর অধিকারী।" 

ভারতে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদী, পারসী, বৌদ্ধ জৈন ইত্যাদি ধর্মাবলম্বীর লোক যেমন আছে, তেমনি বাঙালি, মারাঠি, গুজরাটি, তামিল, উড়িয়া, অসমীয়া , কানাড়ি, সিন্ধ্রি, পাঞ্জাবি, পাঠান, কাশ্মিরি, রাজপুত, অন্ধ্র প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষও একসূত্রে অবস্থান করে আছে । তারা 'বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে কোন না কোন ধর্ম গ্রহণ করেছে, ধর্মান্তর সত্ত্বেও তারা অ-ভারতীয় বলে পরিগণিত হয়নি। তাদের চিন্তা চেতনার মর্মমূলে ভারতীয়ত্ব দর্শন লেপ্টে আছে। রামমোহন রায় প্রফেট তত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না । মুতাজিলা ও সুফিদের মতই ঈশ্বর এবং মানুষের মধ্যবর্তী কাউকে আবশ্যিক বলে তিনি স্বীকার করেন নি । তিনি আরও মনে করতেন যে, প্রফেটদের ঈশ্বরবোধ কিংবা ঋষিদের ব্রহ্ম জ্ঞান 'প্রকৃতির অন্তর্গত অন্যান্য বিষয়ের মতো স্বাভাবিক। তিনি ব্রাহ্মধর্মালম্বী হয়েও হিন্দু ধর্মের সনাতনী রূপ পরিহার করেন নি, সেই সঙ্গে ইসলামের প্রতি মনোযোগ নিবন্ধ ছিল । তিনি মনে করতেন যে, ইসলাম বস্তুতঃ অতিশয় গৃহীর ধর্ম । কিন্তু অপরিমিত ভোগ, অসংযত বাসনাও একই সঙ্গে নিন্দনীয় । সংযমের মধ্যে ভোগ করতে বলেছে ইসলাম । মুতাজিলা ও সুফিরাও সংসার ত্যাগী ছিলেন না , অনেক সময়েই অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধরেছেন । সামাজিক নির্মাণ কর্মেও সহযোগিতা করেছেন । তিনি মনে করতেন ইসলাম প্রচণ্ডভাবে জীবনবাদী এবং ভোগমুখী ধর্ম । আমরাও তাঁর জীবনদর্শন পর্যালোচনা করে দেখি যে, তিনিও জীবনবাদকে আঁকড়ে রেখেছিলেন ।'যাতে অমৃত নেই তা নিয়ে কি করব ' এই নিয়ে আর্তনাদ না করে ভিন্ন যাত্রা পথে বা মার্গে তিনি মর্ত্যেই অমৃত জেনেছিলেন। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মানুষ -'এই প্রখর জীবন চেতনা, আন্তর্জাতিকতা বোধ ইসলামের মধ্যে খুঁজে আয়ত্ব করেছিলেন ।

বর্তমান বহুত্ববাদী সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাস স্থান পেয়ে থাকে যে, সংখ্যা গরিষ্ঠের সুদৃঢ় ভাবনার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না, বরং সহমর্মিতা প্রকাশ করে। আমরা দেখেছি যে, এই বহুত্ববাদী সমাজে আইনকেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে । ন্যায়ালয়ের মহামান্য বিচারপতিদেরও বলতে হয়েছে যে, আমাদের ঐতিহ্য সহিষ্ণুতা শিখিয়েছে, আমাদের দর্শন সহিষ্ণুতার প্রচার করেছে, আমাদের সংবিধান সহিষ্ণুতার চর্চা করেছে, একথা যেন আমরা গুলিয়ে না ফেলি ।" তাহলে আমরা বলতে পারি যে, সনাতনী ভারতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো কঠোর সংযমের মধ্যে সহিষ্ণুতার ফল্গুধারা প্রবাহমান। সুফি তত্বের মধ্য দিয়ে ভারতীয় দর্শনে সাধন ভজনের মধ্য দিয়েই ঐকান্তিক মিলনের সূত্র রচনা করেন। সর্বধর্ম সমন্বয়-ভারতের আত্মা ।বেদান্তের আত্মা পরমাত্মার অনন্যতা, মায়াবাদ, হল্লাজের 'আনাল হক"- সুগভীর ভাবে সরল ভাষায় অভিজ্ঞতার মর্মমূল থেকে উত্থিত হয়েছে -" আপনার আপনিতে মন না জানো ঠিকানা / পরের অন্তর কেটে সমুদ্দুর কি যে যাবে জানা? "হাছন উদাস গেয়েছেন -" মরণ জীবন নাই রে আমার, ভাবিয়া দেখ ভাই / ঘর ভাঙিয়া ঘর বানানি, এই দেখতে পাই ।" সৈয়দ হবীব উন নিসারের সংগ্রহ থেকে তাঁর কথা বলি : অক্ষরে না ধরে নাম শ্যাম বিনোদিয়া / দেখ, ভোলামন আপন ঘরে আছে ছাপাইয়া ।/চুরি করো ধারি করো আপনার লাগিয়া / আপনার নামে আসবে শমন সব যাবে পলাইয়া ।" সাধনার গভীরতম সর্বজনীন সত্য মনের ভেতর থেকে, হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে উঠে আসে ।" আছে যার মনের মানুষ মন সে কি জপে মালা ।/  অতি নির্জনে বসে বসে দেখছে খেলা ।"

সর্ব ধর্ম সমন্বয় বার্তা ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে পরম্পরাগত কারণে সন্নিবেশিত হলেও, আজ কোথাও যেন বেসুরো বাজনার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে । অনৈক্যের সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, পশু নিয়ে চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে কর্পোরেট পুঁজি ও উগ্র সাম্রাজ্যবাদীদের সুযোগ করার প্রয়াস চলছে, যা ভারতীয় অর্থনীতিতে প্রবলভাবে আঘাত হানছে। আবার পরাধীনতার শৃঙ্খলে ভারত বন্দি হতে চলেছে, পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে যে দেশ মুক্ত -স্বাধীন হয়েছিল, এই সময়ে তার অপমৃত্যু ঘনিয়ে আসছে ক্রমাগত । জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বিপ্লবীদের মননে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের প্রভাব থাকলেও দেশমাতার মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ উভয় সম্প্রদায় করে । মহাত্মা গান্ধী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করেন । দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের বিরোধ সংগঠিত হলেও গান্ধীজী চাষীর হাতে জমি দেওয়ার প্রয়োজনের কথা অস্বীকার করেন নি । শওকত উসমানী ইসলামের সমতাবাদ আদর্শের (egalitarian principles ) সঙ্গে সমাজতন্ত্রবাদের আদর্শের সঙ্গতি খুঁজে পান ।তিনি জানান যে," ইসলাম সাম্যবাদ প্রচার করে, সাম্যবাদও তাই করে ।এই কারণে আমি কমিউনিস্ট । "বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের আদর্শ অবলম্বন করেই কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক ও কৃষকদের আন্দোলন সংগঠিত করে । বর্তমানে ভারতের রাজনীতিতে মৌলবাদী চিন্তার প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সম্প্রদায়গত বিরোধের ক্ষেত্রটি প্রসারিত হচ্ছে ।

পরিশেষে, কবি গালিবের বিখ্যাত উক্তি দিয়ে বলতে চাই যে,"I have loved with the same intensity, the Beloved country. " প্রাচীন কবিতা প্রেমিকের মতো ফৈয়াজ তাঁর কমরেডদের আহ্বান করেছেন, "Let's go on, friends, to get ourselves killed today. "

এই সময়ে আমাদের দেশে অস্থিরতা নিরসনে উদার মানসিকতার নিয়ে দেশপ্রেমীদের সাথে সাথে রাজনীতিবিদদের ও রাজনৈতিক চিন্তার মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষা জরুরি । ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন যাতে পায় তার জন্য আত্ম সংগ্রামে নিযুক্ত হতে হবে ।




নাসির ওয়াদেন নাসির ওয়াদেন Reviewed by Pd on জুন ৩০, ২০১৭ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.