পরিবেশের বেজায় দম্ভ এখন। বাড়ির গরম, গাড়ির গরম, ক'দিন আগেই নোটের বাজার ছিল আরো গরম! নেতানেতৃদের গলার শির ফুলিয়ে তর্কাতর্কি চলছিল গরমগরম। সেই সাথে বাবু-বিবির মেজাজ গরম, ছোট্ট শিশুর গা গরম, রান্নাঘরের কর্ত্রীর মাথা গরম। সেনসেক্সের বাজার গরম, ফল সবজী ছুঁলে গরম, চ্যানেলে চ্যানেলে ঘটি গরম। সিনেমায় সেক্সি সেক্সি গরম সিন, ঠান্ডা ঘরে গরম দিন। বলছে নাকি, বিশ্ব উষ্ণায়ণে বাষ্পহীন, বৃষ্টিবিহীন গ্রীষ্মদিন। তারমাঝেই নোটরঙ্গ চলল, হল কোটিটাকার ধামসা মাদল...আবার একটু থিতু হতে না হতেই এই গরমে প্রাণ যায়! মুখ ফসকে বেসামাল কিছু বলে ফেললেই নারদ-নারদ!
হাবেভাবে প্রকৃতি জানান দেয় সেই বিরস দিনের যার নাম গ্রীষ্মকাল।
সারাবছর বাগান আলো করে সবুজ পাতা সর্বস্ব লিলিফুল গাছ ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকে বাগানের এক কোণে, আপন মনে। বসন্তে তার রূপ দেখানোর শেষ হলেই গরম পড়ে যায় ।
গরমকাল এলেই মনে পড়ে যায় বারব্রতের কথা। অরণ্য ষষ্ঠী, জয় মঙ্গল বার, শীতলা পুজো। মায়ের কাছে ঠান্ডা ঠান্ডা ছাতু মাখা, নারকোল কোরা, দুধ আর কলা দিয়ে অথবা চিঁড়ে, দই আমের ফলাহার। সাথে বেলের পানা অথবা তরমুজের সরবত। শ্বশুরবাড়ি এসে সেই ছাতুর বদলে একই ফলাহার জুটল সাবুমাখা দিয়ে। গরমের দুপুরে যেন প্রাণ ফিরে পাওয়া। আর রাতে ফুলকো ফুলকো লুচির সাথে গরমে সদ্য ওঠা কচি পটল, কুমড়ো, ছোলা, আলু আর এক টুসকি হিং দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কুমড়োর ছক্কা। মনে হয় গরমকাল সার্থক। সেই পটলে এখন ঢাক বাজান যাবে। দানায় ঠাসা...চলবে ভাদ্র অবধি।
এই সময় টা আবার ভালোও । কারণ সারাটা বছর সেগুলিই যে ফলগুলি মেলে না এই সময়েই সেগুলি পাকে। আম ছাড়াও লিচু, বেল, কালোজাম, তালশাঁস, জামরুল, আরো কত বলব?
প্রথমে কাঁচা আমের পালা। এই অনবদ্য ফলটি জানান দেয় আসন্ন গরমের। কাঁচা আম উঠলেই ঠাম্মার সমবচ্ছরী পার্বণগুলির একটি ছিল আমবারুণী। আর আমার জন্ম যেহেতু গঙ্গাপারে আড়িয়াদহতে সেই হেতু ছোটবেলায় ঠাম্মাকে বলতে শুনেছি "বৌমা, কাল আঁব-বারুণী, আমি সকালে উপোস করে গঙ্গায় নেয়ে এসে তবেই চা খাব" । কিছই নয়, পাঁচটি কাঁচা আম গঙ্গায় ভাসিয়ে মা গঙ্গাকে নিবেদন করে তবেই রান্নাঘরে আম ঢুকবে।
কাঁচামিঠে আম কোরা নুন-চিনি দিয়ে মা রোদে রেখে দিতেন কাঁচের পাত্রে। দুপুরবেলায় সেই আম-কুরোনোতে কাঁচা লঙ্কা কুচোনো ছড়িয়ে দিতেন আর পড়ার টেবিলে রেখে দিতেন। গ্রীষ্মের ছুটির বাড়ির কাজ অনায়াস হয়ে যেত অম্ল মধুর এই মুখরুচিতে। মা আবার বানাতেন কাঁচা আমের পায়েস। কাঁচা আম কুরোনো চুনজলে ভিজিয়ে রেখে এসিড প্রশমিত করে তারপর ঘিয়ে ভেজে দুধে ফেলা। অসাধারণ সেই পায়েস। এই গরম পড়ার মুখেই মা বানাতেন আম-মৌরলা বা মৌরলামাছের টক। শেষপাতে কি যে ভালো লাগত! আমি এখনো বানাই এই পদটি। মনে হয় গরমকাল আসুক বারেবারে।
কাঁচা আম উঠলেই মনে পড়ে যায় আমাদের বাড়ির এক সাবেকী রীতির কথা। আম-কাসুন্দী হাত করার কথা। কাঁচা আম কুচিয়ে রোদে রেখে দিতে হবে নুন-হলুদ মাখিয়ে । তারপর অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে সরষে ধুয়ে শুকিয়ে শুকনো গুঁড়ো করে সেই আমের সাথে বয়ামে ভরে চিনি, তেঁতুলের ক্বাথ আর সরষের তেল দিয়ে রোদে রেখে দিতে হবে। তৈরী হল সম্বত্সরের আচার তথা চাটনী। কি অদ্ভূত স্বাদ এই আম-কাসুন্দীর। আমার ঠাম্মা বলতেন কাসন। শেষপাতে ভাতের ওপর ঠান্ডা জল ঢেলে এই কাসনের সাথে কলা মেখে, গন্ধরাজ লেবু চটকে ঠাকুমাকে খেতে দেখেছি। এছিল বাঙলার বিধবাদের গ্রীষ্মবিলাস। এছাড়া সর্ষে ফোড়ন দিয়ে আমের অম্বল কিম্বা টক-ডাল তো বাঙালীর গ্রীষ্মবরণের অঙ্গ স্বরূপ। কাঁচা আম থাকতে থাকতেই বাজারে এসে পৌঁছায় পাকা টুসটুসে আম।
আহা কি জাদু এই আম্রময়তায়!
একবার বাবা মালদা থেকে অফিস ট্যুর করে ফেরার পথে বাড়ি নিয়ে এলেন এক টুকরি হিমসাগর আম। আমি তখন বছর তিনেকের । মা আমপাতার ওপর সেই আমগুলিকে একে একে বিছিয়ে উঁচু খাটের তলায় রেখে দিলেন। দিন দুয়েক পর বাড়িতে খোঁজ খোঁজ। আমাকে পাওয়া যাচ্ছেনা কোথাও। ছাদ থেকে বারান্দা, সিঁড়ির তলা থেকে মেজানাইনের ঘর কোথাও নেই আমি। তারপর এঘর সে ঘর খুঁজতে খুঁজতে মা হঠাত খাটের তলায় নীচু হয়ে দেখতে পেলেন আমাকে। একরত্তি সেই আমি একটা আর্দির পেনিফ্রক পরে মনের সুখে টুসটুসে একটা পাকা আম ফুটো করে মনের আনন্দে খেয়ে চলেছি। আমার মুখ, দুই হাত, কনুই বেয়ে সেই আমের রস সাদা ফ্রকের কোলে। এককথায় আমি ও খাটের তলা তখন আম্রময়! মা আমাকে সানন্দে কোলে তুলে নিয়ে সোজা কলঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
পেতলের বালতিতে থরে থরে বোঁটা কাটা, গায়ে দাগ দেওয়া আম ভেজানো থাকত অন্তত পক্ষে ঘন্টা দুয়েক যাতে আঠা মুক্ত হয়। আমার দাদু নাকি দুপুরে ও রাতে খাওয়ার আগে সেই বালতি নিয়ে খেতে বসতেন। ঠাকুমা ভাত খাওয়ার পর সেই বালতি থেকে একটা একটা করে আম দাদুর পাতে দিতেন যতক্ষণ না দাদু থামতে বলেন। সেই ট্র্যাডিশান অনেক দিন চলে এসেছে আমাদের বাড়িতে তবে মধুমেহ ও ইত্যাদির কবলে পড়ে ভীত আমবাঙালীর আম্রপ্রীতি কিছুটা কমেছে এখন। গরমের ছুটিতে আমাদের ব্রেকফাস্ট ছিল ফলাহার। চিঁড়ে দিয়ে আম, দুধ আর চিনি। কখনো মুড়ি আর খই দিয়েও। সেই ফলাহারের স্বাদ এখনকার ছোটরা পেল কিনা জানিনা তবে গ্রীষ্মের লাঞ্চ ব্যুফেতে যে আইসক্রিমের সাথে আম কুচোনো থাকে তা তারা খুব ভালো জানে ।
গরমকাল এলেই মা'কে দেখতাম তুলসী চারা বাঁচিয়ে ছাদের তুলসীমঞ্চে শুকনো পাতার অড়ালে রেখে তাকে যত্ন করতে। তারপরেই পয়লা বৈশাখের দিন তার মাথায় মাটির ছোট্ট ঘটি দিয়ে ঝারা করে দেওয়া হত। সারাটা বৈশাখ মাস ধরে সকালে সেই ঝারায় ঘটি করে জল ঢালা হত । তির তির করে সেই ঝারার ফুটো দিয়ে তুলসী গাছে অবিরত জলঝারি হত। কারণ একটাই। প্রকৃতি সুপ্রসন্না হলে বর্ষা আসবে তাড়াতাড়ি সেই আশায়। মা জল ঢালতে ঢালতে বলতেন
"তুলসী, তুলসী নারায়ণ, তুমি তুলসী বৃন্দাবন, তোমার শিরে ঢালি জল, অন্তিমকালে দিও স্থল।"
আজ যেন গরমের বিকেলে চোখ বুঁজলে কিউটিকিউরার গন্ধ পাই। গা ধুয়ে ছাপা শাড়ি পরে গৃহবধূদের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই মাদুর নিয়ে ছাদে বাস। মায়ের হাতে একটা হাতপাখা আর অন্যহাতে বাড়িতে পাতা টক দইয়ের ঘোল। ওপরে কাগচিলেবুর সুবাস ছড়ানো। ফ্রিজ তখনো ঢোকেনি বাড়িতে। বরফ যেন আমাদের কাছে সোজা হিমালয় পৌঁছনোর মত ব্যাপার। বাজারে একটা দোকানে সন্ধ্যের ঝুলে বরফ বিকত । সেখান থেকে বরফ কিনে এনে শরবত খাওয়া হত। সেদিন যেন চাঁদ হাতে পেতাম। গরমের ছুটিতে বাবা একবার বাসে করে কলকাতায় নিয়ে গেলেন "হিমক্রিম" খাওয়াতে। সেও যেন এক অতি আশ্চর্য রকমের প্রাপ্তি। আমাদের উত্তর কলকাতার এক মিষ্টির দোকানে আইসক্রিম মিলত। কোয়ালিটির আইসক্রিমের কাপ।কোনোকোনো দিন দুধের বড় ক্যানের মধ্যে বরফ দিয়ে সেই আইসক্রিম আসত গরমের ছুটির বিকেলে । ছাদের ওপর হয়ে যেত আমাদের ছোট্টবেলার আইসক্রিম পার্টি।
আমাদের স্কুলজীবনে গরমকালের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল লোডশেডিং। তখন ইনভার্টার ছিলনা রোজ নির্দ্দিষ্ট সময়েই পাওয়ার কাটের পূর্বাভাস পেয়ে যেতাম আমরা। তখন আমাদের দখিণের খোলা বারান্দাই ভরসা। সেখানেই জ্যামিতি, পরিমিতি আর উপপাদ্যে নিয়ে জোর কসরত চলত আমাদের। সকাল থেকেই হ্যারিকেনে কেরোসিন ভরে, ঝেড়ে পুঁছে রেখে, তার সলতে ঠিকমত কেটে সমান করে দেওয়া হত । এখন কলকাতা শিল্পহীন, বিদ্যুতের চাহিদাও নেই। কলকারখানাও নেই বড় একটা তাই লোডশেডিং মুক্ত দিন। অতএব শিশুরা আরামেই গ্রীষ্মের ছুটির হোমওয়ার্ক করে । রাতে লোডশেডিংয়ে মা টানতেন হাতপাখা। শাড়ির পাড় দিয়ে মোড়া থাকত হাতপাখাটি। টেঁকশই হবে বলে । ছোটদের বেয়াদপির দাওয়াই ছিল এই পাখার বাড়ি। যে খায়নি এই পাখার বাড়ি সে জানেওনা তা কেমন খেতে । সেই তালপাতার পাখাখানি টানতে টানতে বাইচান্স আমাদের গায়ে ঠুক করে লেগে গেলেই মায়ের যেন একরাশ মনখারাপ। যেন কি ভুলই না করেছেন। সেই পাখা সাথে সাথে মাটিতে ঠুকে তিনবার আমাদের কপালে, চিবুকে হাত রেখে চুক চুক করে ক্ষমা চাইতেন। দোষ কাটিয়ে নিতেন। সন্তানের গায়ে হাতপাখা লেগে যাওয়া যেন দন্ডনীয় অপরাধ। মাটির কুঁজো বা জালার জল ছিল আরেক প্রাণদায়ী বন্ধু সে গরমে। মা আবার এক ফোঁটা কর্পূর দিয়ে রাখতেন জালার জলে। জীবাণুনাশক আবার সুন্দর গন্ধ হবে বলে। জলের লীনতাপকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দেবার জন্য সকাল থেকেই লাল শালু ভিজিয়ে জড়িয়ে দেওয়া হত মাটির জালার বাইরে। এখন গর্বিত বাঙালির ঘরে ঘরে ফ্রিজ। সে মাটির কুঁজোও নেই আর নেই সেই হাতপাখা।
সকলে বলে গরম বেড়েছে। কারণ নাকি বিশ্ব উষ্ণায়ণ। মায়েদের এখন থাইরয়েড তাই গরম আরো বেশি। হোমমেকারের হটফ্লাশ তাই গরম বেশি। বাজারদরের আগুণ নেভেনা তাই বাবার কপালের ঘাম শুকোতে চায়না। ছেলেপুলেরা জন্মেই ফ্রিজ দেখেছে তাই ফ্রিজে জল না থাকলে তারাও অগ্নিশর্মা। কি জানি লোডশেডিং, মাটির জালা, হাতপাখার বাতাস, ছাদে বসে বরফকুচির দেওয়া সীমিত শরবত এগুলোই বোধ হয় ভালো ছিল। তাই বুঝি এত গরম অনুভূত হতনা।
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
Reviewed by Pd
on
জুন ৩০, ২০১৭
Rating:
Reviewed by Pd
on
জুন ৩০, ২০১৭
Rating:

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন