পিয়ালী গাঙ্গুলি

চেনা মুখ অচেনা মানুষ
প্রফেসর রোজারিওর টিউশনে একদিন প্রথম দেখি মেয়েটাকে। আমার সব জায়গায় সময়ের আগে পৌঁছনো স্বভাব। সেদিন দেখি আমার চেয়েও আগে গিয়ে বসে আছে একটি মেয়ে। হয়ত সেদিন থেকেই আমাদের ব্যাচে জয়েন করল। মেয়েটার গায়ের রঙ একটু চাপা, তবে বেশ চটকদার দেখতে। চোখাচোখি হতেই হেসে ‘হাই’ বলল। আমিও উলটে ‘হাই’ বললাম। ভালই হল আলাপটা ও আগে শুরু করাতে। আমার এই বদ স্বভাব, আমি কিছুতেই শুরু করতে পারি না। না না, ইগো টিগো কিছু নয়, কিরকম একটা অদ্ভুত জড়তা, বোঝাতে পারব না। কিন্তু একবার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলে সেটাকে লালন পালন করে মহীরুহর মত দৃঢ় আর শক্তিশালী গড়ে তুলতে আমি খুব ভাল পারি। যাক সে কথা। মেয়েটার নাম জানলাম পরমা। একটু অবাক হলাম শুনে। না মানে, ওরকম ম্যানিকিউরড হাতে ম্যাট ফিনিস নেল পলিস, পরনে পেন্সিল স্কার্ট, জাঙ্ক জুয়েলারি দেখে আমি ঠিক এতটা ঘরোয়া বাঙালি নাম আশা করিনি।

নোটস নিতে নিতে প্রায়ই টিস্যু পেপার দিয়ে নাক মুছছে আর লেখায় পিছিয়ে পড়ছে। ওর জন্য স্যার বেশ কয়েকবার রিপিট করলেন। ফেরার সময় দেখলাম ও মেট্রোতে ফিরবে। আমি ছাড়া ব্যাচের আর কেউ মেট্রোতে যাতায়াত করেনা। ভালই হল, একজন সঙ্গি জুটল। ওর বাড়ি গল্‌ফগ্রিনে, রবীন্দ্র সরবরে নামবে। টুকিটাকি খানিক কথা হল। ও অনেক বছর দুবাইতে ছিল। পড়াশোনা ওখানের কোনো ভারতীয় সিবিএসই স্কুলে। সিবিএসই তে ছোট ছোট উত্তর লিখতে হয়। এখন ইংলিশ লিটারেচার পড়তে এসে হঠাৎ করে এত বড় বড় উত্তর লিখতে ওর খুব সমস্যা হচ্ছে। আমি আর কি বলব? একটু হেসে বললাম “সিবিএসই সম্বন্ধে আমার কোন ধারনা নেই, তবে স্কুল লেভেলে কোন বোর্ডেই বোধহয় এত বড় বড় উত্তর লিখতে হয়না। একে অনার্স, তাই আবার সাহিত্য, উত্তর তো বড় হবেই। ও আস্তেআস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে”। নিজে থেকেই অনেক কিছু বলে যেতে লাগল ওর ব্যাক্তিগত জীবন সম্বন্ধে। আমার বেশ অস্বস্তিই লাগছিল। প্রথম আলাপে কেউ কাউকে নিজের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে এত কথা বলে নাকি? ও যা যা বলে গেল, আমি শুধু  শুনে গেলাম। কাউকে তার ব্যাক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ, যে যতটুকু বলে আমি ততটুকুই শুনি।

বাবা কোথায় চাকরি করতেন বলেছিল ভুলে গেছি। বাড়িতে ও ভীষণ একা। বাবা এলকহলিক্‌, মা বাবার নিত্য অশান্তি, মারধর চলতে থাকে। সেই মারের হাত থেকে ও ও রেহাই পায় না। মায়েরও নাকি কোনো টান নেই ওর প্রতি। ওর একমাত্র সঙ্গী বা ভালোবাসার লোক ছিলেন ওর দাদু। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে ও আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। এইবার বুঝতে পারলাম এই চরম নিঃসঙ্গতা থেকেই ও আমায় এত কথা বলে ফেলেছে। হয়ত কোনো কারণে ওর আমাকে ভালো লেগেছে বা নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে। মনটা ভারি হয়ে গেল। আহা রে, কতটা দুঃখী বা অসহায় হলে মানুষ একজন অপিরিচিতর কাছে সমবেদনা বা আশ্রয় খোঁজে। 

আমি যতীন দাস পার্ক স্টেশনে নেমে গেলাম। বাড়ি পৌঁছনো পর্যন্ত ওর কথাগুলোই মাথায় ঘুরছিল। তারপর আস্তে আস্তে নিজের জীবন সংগ্রামে ওর কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গেল। আবার পরের সপ্তাহে দেখা হল টিউশনে। ক্লাসে তো কথা হত না, ওই মেট্রোতেই ফেরার সময় যেটুকু কথা হত। ক্রমশ দেখলাম পরমা খুব অমনোযোগী, কেমন যেন একটা অগোছালো। নোটস টুকতে পারে না, আমার থেকে প্রায়ই খাতা নিয়ে যায়, হাত থেকে অনবরত পেন পড়ে যায়, হামেশাই বই খাতা আনতে ভুলে যায়। প্রফেসর রোজারিও খুব কড়া ছিলেন। একবার টেক্সট বুক আনেনি বলে ওকে সোজা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমি ওর মানসিক অবস্থার কথা জানি বলেই যতটা পারতাম সাহায্য করার চেষ্টা করতাম। পড়া বুঝিয়ে দেওয়া, নোটস দেওয়া, এমনকি নিজের লেখা উত্তর পর্যন্ত ওকে দিয়ে দিয়েছি। ওর সাথে আর আমার কিসের প্রতিযোগিতা? কেন জানিনা, আমি ছাড়া ব্যাচের আর কারুর সাথে ও বেশি মিশত না। কি জানি কি খুঁজে পেয়েছিল ও আমার মধ্যে। ওর এই আধপাগলি হাবভাবের জন্য অন্যরাও ওকে একটু এড়িয়েই চলত।

এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। মাঝে মাঝেই দেখতাম ওর হাতে বা মুখে কালশিটের দাগ। কখনো নিজে বলত, কখনো বুঝে নিতাম মারধোর খেয়েছে। খুব কষ্ট হত দেখে। ইতিমধ্যে আমার ফোন নম্বর নিয়েছে। আমায় ফোন করে পড়ার ব্যাপারে এটা সেটা জিজ্ঞেস করত। একই কথা হাজার বার জিজ্ঞেস করত। বিরক্ত লাগত, তাও যথাসম্ভব শান্ত গলায় উত্তর দিতাম। বাড়িতেও আসতে চেয়েছিল অনেকবার। প্রতিবারই আমি কায়দা করে এড়িয়ে গেছি। ও ক্রমশ যেভাবে আমায় আঁকড়ে ধরতে চাইছিল আমি বুঝতে পারছিলাম একবার আমার বাড়িটা চিনলে আমার আর রক্ষা নেই। ওর প্রতি আমার আন্তরিক সহমর্মিতা ছিল বটে কিন্তু নিজের পড়াশুনাটার কথাও তো ভাবতে হবে। একদিন ফেরার পথে মেট্রো স্টেশনে নামছি। লক্ষ্য করলাম একটি লাল টি শার্ট পড়া ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই পরমা আলাপ করালো "দিস ইস মাই বয়ফ্রেন্ড"। একটু হকচকিয়ে গেছিলাম প্রথমে। আগে কখনো শুনিনি ওর বয়ফ্রেন্ড আছে বলে। ভাবলাম যাকগে ভালোই হয়েছে, ওর একটা সঙ্গী জুটেছে। এবার একটু শান্তি পাবে মেয়েটা।

তারপর হটাৎ কয়েক সপ্তাহ পরমা উধাও। ভাবছিলাম কি হল। শরীর খারাপ নাকি বাড়িতে কোনো নতুন অশান্তি। ফোন নম্বর ছিল, কিন্তু ইচ্ছা করেই ফোন করিনি। ওর বাড়িতে ফোন করতে কি রকম অস্বস্তি হত। তারপর পরমা আবার যেদিন টিউশনে এল ফেরার পথে মেট্রো স্টেশনে হটাৎ ব্যাগ থেকে একটা বড় সর কাগজ বার করে আমার হাতে দিয়ে বলল "ক্যান ইউ প্লিজ কিপ দিস? ইট ইজ নট সেফ ইন মাই হাউজ।" জিজ্ঞেস করলাম "হোয়াট ইজ দিস?" জবাব এল "মাই ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট"। শুনে তো আমি আঁতকে উঠলাম। কাগজটার দিকে না তাকিয়েই সটান ফেরত দিয়ে বললাম "নো, সরি পরমা, আই কান্ট কিপ দিস"। অনেক কাকুতি মিনতি করল, কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হইনি। নিজের জীবনের সমস্যা নিয়েই জেরবার, আবার শখ করে অন্যের ঝামেলায় জড়ানো। পাগল নাকি? বুঝলাম মনক্ষুণ্ণ হল, কিন্তু কিছু করার নেই। এইভাবে হুট করে বিয়ে করে ফেলার কোনো মানে হয়? মনে হল ও আবার কোনো ঝামেলায় জড়াবে।

পরীক্ষার কিছুদিন আগে হটাৎ ফোন করল ওর সব নোটস হারিয়ে গেছে। আমার সাথে দেখা করতে চায়। বাড়িতে আসাটা তো আমি বরাবরই এড়িয়ে গেছি, তাই ঠিক হল নন্দনে দেখা করবে করব। সকাল দশটা কি এগারোটা সময় টা এখন আর ঠিক মনে নেই। আমি হাঁ করে বসে আছি তো বসেই আছি, পরমার পাত্তা নেই। শেষে বিরক্ত হয়ে আমি বাড়ি চলে এলাম। একটু চিন্তাও হচ্ছিল বটে। এত ভাওলেন্সের মধ্যে থাকে মেয়েটা। কোনোদিন ওর বাড়িতে ফোন করিনি, সেদিন ভাবলাম ওর বাড়িই চলে যাই। কি আর হবে? ওর ও হয়ত আমায় দেখে একটু ভালো লাগবে। ঠিকানা আর লোকেশনটা আমি মোটামুটি জানতাম। ওর বাড়ি গিয়ে বেল বাজাতে এক সুন্দরী মধ্যবয়স্কা মহিলা দরজা খুললেন। মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম ইনিই পরমার মা, মুখের হুবহু মিল। নিজের পরিচয় দিতেই সঙ্গে সঙ্গে আপ্যায়ন করে ভিতরে নিয়ে গেলেন। বললেন "আমি মুন্নির মুখে তোমার নাম শুনেছি। শুনেছি তুমি সবসময় ওকে খুব সাহায্য কর"। "তা মা , তুমি কি মুন্নির খবর নিতে এসেছ?" সোফায় বসা বয়স্ক ভদ্ৰলোক প্রশ্ন করলেন। পরমার মা পরিচয় করিয়ে দিলেন "ইনি পরমার দাদু"। 

একজন মৃত মানুষকে জ্বলজ্যান্ত চোখের সামনে দেখে আমি প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম। প্রথম ঝটকাটা হজম হতে বেশ সময় লাগল। তারপর আস্তে আস্তে পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিস্কার হল। পরমা আমাদের ওর বাড়ি বা পরিবার সম্মন্ধে যে ছবিটা তুলে ধরেছিল সেটা আসলে সম্পূর্ণ বিপরীত। ওর মনগড়া। পরমা একজন স্কিজোফ্রেনিক। ও বাড়িতে ভাওলেন্সের শিকার নয়, বরং উল্টে ওই ওর বাড়ির লোকজনদের মারধর করে। ইদানিং এত বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল যে ওকে আর বাড়িতে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। আমি বাড়ির ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। মাথাটা প্রায় ভোঁ ভোঁ করছিল। পরমার মায়ের শেষ কথাটাই শুধু কানে বাজছিল "শি হ্যাজ বিন ইনস্টিটিউসনালাইজড্"।


পিয়ালী গাঙ্গুলি পিয়ালী গাঙ্গুলি Reviewed by Pd on মে ০৯, ২০১৭ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.