ফিদেল কাস্ত্রো

ফিদেল কাস্ত্রো


ফিদেল কাস্ত্রো ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলে বিরান জেলায় স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এক অসচ্ছল অভিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ। তার পিতা ছিলেন ছোট্ট আখের খামারি। তাই তার শৈশব মোটেও সচ্ছল ছিল না। দরিদ্র শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় ছোট বেলা থেকেই কাজ করেছেন কাস্ত্রো। মাত্র ১৩ বছর বয়সে নিজের বাবার আখের খামারে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত করেন এবং একটি ধর্মঘটের ব্যবস্থা করেন। অসচ্ছলতার মাঝে একটি জেসুইট বোর্ডিং স্কুল থেকে আইনের স্নাতক হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধূলায়ও ফিদেল ছিলেন তুখোড়।

১৯৪৪ সালে কিউবার সেরা অলরাউন্ডার স্কুল অ্যাথলেট পুরস্কার পান। আইনের স্নাতক হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেন। ডিগ্রি নেয়ার পরপরই হাভানায় একজন আইনজীবী হিসেবে পেশা জীবন শুরু করেন কাস্ত্রো। পাশাপাশি দরিদ্র মক্কেলদের পক্ষে আইনি লড়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সকলের মাঝে সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন। 

১৯৪৭ সালে নবগঠিত কিউবান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন ফিদেল। এসময় কিউবা পরিণত হয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল ধনীদের স্বর্গরাজ্যে। যৌন ব্যবসা, জুয়া এবং মাদক চোরাচালান চরম আকার ধারণ করেছিল। মার্কিন ব্যবসায়ী শ্রেণী ও সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবিচার, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও নিম্ন মজুরীর অভিযোগ নিয়ে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে তুখোড় বক্তা ফিদেল দলের তরুণ সদস্যদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন কিউবার লাগামহীন পুঁজিবাদের কারণে দেশটির যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যার উদ্ভব এবং একমাত্র জনগণের বিপ্লবের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।  

১৯৫২ সালে দলীয় কংগ্রেসের সদস্য প্রার্থী হন তিনি। নির্বাচনে পিপলস পার্টির বিজয়ের সম্ভাবনা থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে জেনারেল বাতিস্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করলে নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। বাতিস্তার সরকারের নীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মতই, যা ছিল কাস্ত্রোর বিশ্বাসের পরিপন্থী। ফলে বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের জন্য তিনি একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলেন যার নাম 'দ্য মুভমেন্ট'।  সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩-র জুলাই মাসে সান্টিয়াগোর কাছে মোনাকাডা সেনা ছাউনিতে একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন কাস্ত্রো। আক্রমণটি ব্যর্থ হয় এবং অনেক বিপ্লবী হয় নিহত হন এবং ধরা পড়েন। বন্দীদের মধ্যে কাস্ত্রোও ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তার বিচার শুরু হয়। জেনারেল বাতিস্তা, মনকাডা আর্মি ব্যারাকে হামলায় ‘বিদ্রোহীদের আটক করা মাত্র হত্যা’ করার নির্দেশ জারি করেন। এই আদেশে ফিদেল কাস্ত্রের প্রায় ৮০ জন সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হলেও ফিদেলকে আটককারী লেফট্যানেন্ট বাতিস্তার নির্দেশ উপেক্ষা করে তাকে বেসামরিক কারাগারে পাঠিয়ে দিলে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। পরর্তীতে কারাগারে তাকে বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা চালানো হয় যার দায়িত্ব ছিল ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ারের ওপর। কিন্তু তিনি দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বরং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেন। এই বিরুদ্ধচারণের জন্য কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ারকে। শেষ পর্যন্ত বিশ্ব জনমতের কথা বিবেচনা করে কাস্ত্রোকে হত্যা না করে বিচারের মুখোমুখি করেন বাতিস্তা।

বিচারের শুনানিগুলো কাস্ত্রো ব্যবহার করতেন সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের ঘটনাবলী ফাঁস করে দেয়ার মঞ্চ হিসেবে। মনকাডা হামলায় অভিযুক্ত হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ফিদেল যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন তার মধ্য দিয়ে কিউবার রাজনৈতিক সংকট এবং তার সমাধানের পথ-নির্দেশ করেন তিনি।  এসময় শুনানিগুলোতে বিদেশী সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল, তার এ বক্তৃতা আলোড়ন তোলে গোটা কিউবায়, জননায়কে পরিণত হন ফিদেল। কাস্ত্রোর জনপ্রিয়তা এসময় বেড়ে যায়। বিচারে তার ১৫ বছরের কারাদণ্ড হলেও প্রবল জনমতের কাছে মাথা নত করে দুই বছরের মাথায় তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন বাতিস্তা।

সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে ১৯৫৫ সালের মে মাসে জেল থেকে ছাড়া পান কাস্ত্রো। ছাড়া পাওয়ার পর বিপ্লবকে আরও প্রখর করে তুলতে মেক্সিকো চলে যান তিনি। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে রাউল কাস্ত্রোর সাথে নিকো লোপেজের মাধ্যমে তরুণ বিপ্লবী আরনেস্তো চে গুয়েভারার পরিচয় হয় এবং পরে তার মাধ্যমে ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে পরিচিত হন চে। কাস্ত্রোর সাথে চে'র প্রথম সাক্ষাতে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় এবং চে বলেন যে কিউবার সমস্যা নিয়ে তিনি চিন্তিত। সেই সময় চে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন এই আগ্রাসি তত্পরতার আশু সমাপ্তি প্রয়োজন। একসময় সেখানে একটি গেরিলা দল গঠন এবং পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়ের পর চে গুয়েভারা, জুয়ান আলমেইডা এবং অন্যান্যদের মিলিয়ে প্রায় ৮০ জনের একটি বিপ্লবী দল নিয়ে ১৯৫৬ সালে কিউবায় ফিরে আসেন ফিদেল। ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই মনকাডায় সেই হামলার নামানুসারে ফিদেল কাস্ত্রোদের এই গেরিলা দল ‘জুলাই টুয়েন্টি সিক্স মুভমেন্ট’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। গেরিলারা সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বত ছেড়ে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। স্থানীয় জনতা গেরিলাদের অভ্যর্থনা জানায়।অন্যদিকে জেনারেল বাতিস্তা গেরিলা নিধন অভিযান আরও জোরদার করেন।

১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি জেনারেল বাতিস্তার প্রায় ১,০০০ সেনা, বিপ্লবী গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারালে - বিমান, বোমা, জাহাজ ও ট্যাংক পাঠিয়ে গেরিলাদের হঠানোর চেষ্টা চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নাপাম বোমার মতো সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও গেরিলাদের সঙ্গে জেনারেল বাতিস্তা পেরে না ওঠায় তাকে নির্বাচন ঘোষণার পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্র।  ১৯৫৮ সালের মার্চে জেনারেল বাতিস্তা নির্বাচন ঘোষণা করলেও জনগণ সে নির্বাচন এর দিন প্রত্যাখ্যান করে। ৭৫ ভাগ থেকে শুরু করে কোথাও কোথাও ৯৮ ভাগ মানুষই ভোটকেন্দ্রেই যায়নি। 

একসময় ফিদেলের যোদ্ধারা চারদিক থেকে রাজধানী হাভানাকে ঘিরে ধরতে শুরু করলে ১৯৫৯ সালের পহেলা জানুয়ারি নববর্ষের দিনে কিউবা ছেড়ে পালান জেনারেল বাতিস্তা। ১৯৫৯ সালের ৯ জানুয়ারি রাজধানী হাভানায় ঢুকে দেশের নিয়ন্ত্রণভার নিয়ে নেয় ফিদেল কাস্ত্রোর গেরিলারা। হাভানা জয়ের পরপরই কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফিদেল। ১৯৬৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অফ কিউবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং কিউবাকে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের কাজ শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে কিউবার প্রেসিডেন্ট অফ দ্য কাউন্সিল অফ স্টেটস এবং কাউন্সিল অফ দ্য মিনিস্টারস নির্বাচিত হন তিনি। একইসঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবেও দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

সারা বিশ্বে যখন কমিউনিস্ট সরকারগুলো ধসে পড়ছে ঠিক তখন কমিউনিস্ট ব্যবস্থার বৃহত্তম শত্রু বলে পরিচিত আমেরিকার দোরগোড়াতেই সমাজতন্ত্রের ধ্বজা তুলে ধরে রেখেছিলেন মি. কাস্ত্রো। তার সমর্থকেরা তাকে সমাজতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখতেন, যিনি জনগণের কাছে কিউবাকে ফেরত দিয়েছিলেন।


কিউবা-বিপ্লবের পর থেকে অর্ধ শতক ধরে পরপর ১০ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাকে হত্যা কিংবা উৎখাতের জন্য লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও সেসবকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কিউবার শাসন ক্ষমতায় ছিলেন ফিদেল। অবশেষে ৮১ বছর বয়সে স্বেচ্ছায় কিউবার প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেন তিনি। স্বাস্থ্যগত কারণে ২০০৬ সালের ৩১ জুলাই সাময়িকভাবে ক্ষমতা তুলে দেন ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে৷ এরপর নির্জনে চলে তাঁর চিকিৎসা৷ পরবর্তীতে এই স্বাস্থ্যের কারণেই দুই বছর পর স্থায়ীভাবে ক্ষমতা দিয়ে দেন ছোট ভাইকে।

বিংশ শতাব্দির মহানায়ক, সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী কিউবান রাজনৈতিক নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। স্নায়ুযুদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদের জয়জয়কারের মধ্যেও সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে টিকিয়ে রেখে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রবাদ পুরুষ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি।

আজ ২৬শে নভেম্বর ২০১৬, শুধু সমাজতন্ত্রের অনুসারী নয়, বিশ্বব্যাপী নানা মত ও পথের বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে প্রায় পৌরাণিক এক চরিত্রে পরিণত হওয়া ফিদেল কাস্ত্রো চলে গেলেন এ পৃথিবী থেকে।


তথ্য -  উইকিপিডিয়া, বিবিসি 







ফিদেল কাস্ত্রো ফিদেল কাস্ত্রো Reviewed by Pd on নভেম্বর ২৬, ২০১৬ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.