সকালে চায়ের -কাপ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখলাম, উলটো দিকের বাড়ির বারান্দায় সুব্রতর মা মণিমাসিমা চেয়ারে বসে অ্যালামুন্ডার ফুল আর পাতা কুচিকুচি করতে করতে আপনার মনে বিড়বিড় করছেন। দৃশ্যটা নতুন। একটু পরে সুব্রতর- বৌ মিঠু এসে ঝঙ্কার দিয়ে গেল। আমাকে দেখে একটু অপ্রতিভ হয়ে বলল, আজকাল এই এক রোগ হয়েছে। সকালে গাছের পাতা, বিকেলে কাগজ, আপনার ভাইএর দরকারি কাগজ প্রায়ই ছিঁড়ে ফেলছেন।
-ডাক্তার দেখিয়েছ?
মিঠু উপেক্ষার হাসি হাসল, কী হবে দেখিয়ে? বুড়ো বয়সের ভীমরতি ছাড়া আর কি?
মণিমাসিমা আমার দিকে হাসি ছুঁড়লেন, তরকারি কুটছিলাম রে, আজ সুব্রতর জন্মদিনে সবাই খাবে তো, বিকেলে পায়েস হবে, আসিস কিন্তু।
মিঠু বলল, দেখছেন টুকুদি , সারাদিন কাকে নিয়ে থাকি!
তীব্র দৃষ্টি শানিয়ে মণিমাসিমার চটপট উত্তর , তোমার দুই ছেলের আঁতুড় তুলিনি, কোলে- পিঠে করে মানুষ করিনি? বলতে বলতে গলা কোমল হয়ে যায়, তখন তুমি কত ছোট , কলেজের পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতে।
দেখছেন টুকুদি, পুরোনো কথা কিচ্ছু ভোলেন নি, এখনকার দরকারি কথা ভুলে যান , ইচ্ছে করে । ভরপেট খেয়ে বলবেন খাইনি, কাচা- জামা কেচে জল নষ্ট করবে্ন, বললে আবার রাগ কত!
মনটা খারাপ লাগল, অনেক দিনের প্রতিবেশি। মিঠু না বুঝলেও সুব্রতর বোঝা উচিত, মণিমাসিমার পৃথিবীতে সময়ের স্রোত এলোমেলো, স্মৃতি আর সতত বহমান নয়, ডাক্তারি চিকিৎসা দরকার।
কদিন পর এক অফিস- সহকর্মীর জন্য পাড়ায় সুব্রতর চেম্বারে গেলাম। ও এখন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, প্রয়োজনে আইনি পরামর্শ পাওয়া যায়। অপেক্ষা করার আগেই বলল, টুকুদি, তুমি এখানে কেন? রাতে বাড়িতে এসো। আশ্বস্ত হলাম, সুব্রতকে মাসিমার কথাও আজ বলতেই হবে।
একটু বেশি রাতে ওকে বাড়িতে খোঁজ করতে গিয়ে অভাবনীয় এক দৃশ্য দেখলাম । বসার- ঘরে মণিমাসিমাকে সুব্রতর দুই ছেলে নিষ্ঠুর ভাবে মারছে। আমায় দেখে মিঠু তেতো গলায় বলল, কত আর সহ্য হয়?, বাথরুমে না গিয়ে আজ সোফায় বসে বসে কাজ সারলেন।
- সুব্রত বাড়ি নেই? ও এসব জানে?
- জানে সব, বাড়ি এখনো ঢোকেনি। ওই তো শাসনের ভার ছেলেদের ওপর দিয়েছে। সারাদিন খাটনির পর এসব পোষায়?
আচমকাই মনে পড়ে গেল, রাস্তায় দু তিন জায়গায় আজ মস্ত হোর্ডিংএ ওয়ার্ল্ড- অ্যালঝাইমারস ডে-র জ্বলজ্বলে প্রচার দেখেছি, "স্মৃতিহারা বয়স্ক মানুষদের একটু সহ্য করার অভ্যাস করুন, অতীতে এরা আপনাদের অনেক অন্যায় সহ্য করেছেন।"
চুলোয় যাক সহকর্মীর জন্য আইনি- পরামর্শ! বেলা- শেষের সুখী জীবনের সবপ্ন দেখার সাহস এই বিচিত্র দুঃসময়ে যে আহাম্মকেরাই করুক, আমার নেই। ছুটতে ছুটতে সুব্রতর চেম্বারে পৌঁছলাম, ও তখন একটি বয়স্ক ক্লায়েন্টকে নরম ভাষায় বোঝাচ্ছিল, ছেলে বাড়ির সিংহ- ভাগ দখল করে বসে থাকলে, ভরণ- পোষণে সহায়তা না করলে আইন আপনার পাশে থাকছেই, ভয় কি?
এক বৃদ্ধা একই সঙ্গে অ্যালঝাইমারস রোগ আর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হলে তাকে আইনি পরিষেবা কিভাবে দেওয়া যায়..., সেই প্রশ্ন নিয়ে আমাকে যে এখন এখানে অপেক্ষা করতেই হবে।
কৃষ্ণা রায়
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৯, ২০১৬
Rating:
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৯, ২০১৬
Rating:

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন