বাস থেকে নেমে কাঁধের ব্যাগ-টা একটু সামলে নিলেন স্বদেশ বাবু। তারপর সোজা হাঁটা মারলেন লক্ষ্মণপুরের উদ্দেশ্যে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে হাত ঘড়িটা একবার দেখেনিলেন, তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় দশ-টা ছোঁব, ছোঁব করছে। বাসস্টপের সামনে যা দোকানপাট ছিল তা সবি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যা দু-একটা খোলা আছে-- সেগুলোরও ঝাঁপ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে; দোকানদারের তোড়জোড় দেখে তা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি।
আর এর পরের পথ তো একেবারে শুনশান! দোকানপাট তো দূরের কথা-- দূর, দূর পর্যন্ত কোনো জনমনবের চিহ্ন মেলা অসম্ভব! বুকের ভিতর-টা হঠাৎ যেন ছ্যাঁক করে ওঠে স্বদেশ বাবুর। একটা সুপ্ত স্মৃতি যেন হঠাৎ খোঁচা খেয়ে জেগে উঠেছে তার মনে। এই জায়গাটা নিয়ে কতইনা গল্প শুনেছেন ছোটবেলায় দাদু, দিদার মুখ থেকে। এখানে নাকি তেনাদের বাস। ছোটবেলায় সেই সব কাহিনী শুনে দাদু, দিদার কোলে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতেন তিনি। আর তিনি এটাও জানেন যে-- গল্পগুলো আসলে মন-গড়া বানানো কোন গল্প ছিল না। একটু আধটু খাদ মেশানো থাকলেও; কিছুটা এই রাস্তায় ঘটে যাওয়া সত্যি ঘটনা। সত্যি এতো বছর কেটে গেলো তবুও এই বাসস্টপ থেকে লক্ষ্মণপুরের বড় রাস্তায় পৌঁছানোর পথটা চিরোকাল একই থেকে গেলো!
দুর্ভেদ্য অন্ধকার। চারিধার বড়, বড় বনস্পতি আর তাদের গা বেয়ে ওঠা পরগাছা দিয়ে ভরা। তারই মাঝ দিয়ে কাঁকড় মাটির পথ চড়াই-উৎরাই হয়ে চলে গেছে বড় রাস্তার সীমানা পর্যন্ত। বেশি লোকের যাওয়াআসা নেই এই পথে। আর সন্ধ্যে ছটার পর তো এ তল্লাটের আশেপাশের মাটিও কেউ মাড়ায় না! রাতের বেলা এই পথ সত্যিই দুরতিক্রম্য। শোনাগেছে কয়েকবার বাতি লাগানো হয়েছিল এই রাস্তায়; কিন্তু প্রতিবারি সেই বাতি কোথায় যে উধাও হয়ে গেছে-- তার কোন বিন্দুমাত্র চিহ্ন আজ পর্যন্ত মেলেনি! তাই এখানকার মানুষজন বিশ্বাস করেন যে-- এই রাস্তায় নাকি এখনও তেনারা বসবাস করেন।
এই কম্পিউটারের যুগে এইসব ভাবনার কোন মানেই হয় না! ভূত বলে যে কিছু আছে সেটা কিছুতেই মানতে রাজি নন স্বদেশ বাবু। তার মতে এটা মানুষের মন-গড়া কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। আর কজনই বা ভূত দেখেছে! আর যারা দেখেছে তারা কি কেউ এর সঠিক প্রমাণ দিতে পারবে! কেউ পারবে না। আর এর থেকেই তো পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রমাণ ছাড়া কেন যে সব ভূতে বিশ্বাস করে; ধুত! আসলে স্বদেশ বাবু সত্যিই নির্ভীক মানুষ। যদিও ছোটবেলায় শোনা কাহিনী-গুলো সবি সত্যি বলে তিনি জানেন; তবে সেগুলোও যেন কেমন এখন আর বিশ্বাস হয় না তার। আর যদিও তখনকার দিনে কিছু ঘটে থাকে; আজগের দিনে তার পুনরাবৃত্তি কখনওই ঘটবেনা! তাহালে হঠাৎ করে কেন ভয় লাগতে শুরু করেছে তার! সে তো এইসবে বিশ্বাসই করে না! তবে কিসের ভয় চেপে ধরেছে তাকে! সেই ছেলেবেলায় শোনা গল্পগুলো কি?
এবার মন থেকে সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে গুন, গুন করে গান ধরলেন। আর বড়, বড় পা ফেলে হাঁটার গতি ক্রমশ বাড়াতে লাগলেন।
মামার বাড়ি আসার ট্রেন পথের আর একটি রাস্তা যদিও আছে-- কিন্তু সেই পথে এলে প্রায় দু-ঘন্টা সময় বেশি লাগে। তাই বাধ্য হয়ে এই পথটাই বেছে নিতে হয় তাকে। তিনি সকালেও আস্তে পারতেন; কিন্তু, অফিস থাকার কারনে তাকে এই রাতেই ছুটে আসতে হল। কাল মেজো মামার ছেলে টিকলুর জন্মদিন। এ বছর সাতে পা দিল টিকলু। জোর বায়না ধরেছে-- বড় করে তার জন্মদিন পালন করতে হবে। অনেক লোক হওয়া চাই। সে যেন অনেক উপহার পায়। আর তার কান্নাকাটির ঠেলা সামলাতেই আয়োজন করতে হচ্ছে মেজো মামাকে। আর কাল ভোরবেলায় পটাশপুরের বড় বাজারে মাছ কিনতে যাওযার দায়িত্ব এসে পরেছে স্বদেশ বাবুর উপর। তাই অনন্যোপায় হয়ে অফিস ছুটির পর বাস ধরতে হয় তাকে। তিনি আজ অফিসও কামাই করতে পারতেন; কিন্তু, গেলো দু-মাস ধরে অফিস কাটার জন্য তার নামে খাতায় যে পরিমানে লাল কালি পরেছে, সেটা এই মুহূর্তে শুধরে না নিলে তার আসুনটা যে আর বেশিদিন টিকবে না সেটা তিনি বেশ ভালোকরেই জানেন। তাই নিজেকে শুধরে নিচ্ছেন। আসলে ভদ্রলোক সম্প্রতি মাস দুয়েক হল কৃতদার হয়েছেন। নববধূ রূপে অনন্যসাধারণ এক সুদর্শনা। মনোহারিণী রমণীটি যেন কামের দেবী। তাই সকাল হলে রোজই বিছানা ছাড়তে ইচ্ছা করে না স্বদেশ বাবুর। আর এই একটি মাত্রই কারণ অফিসের খাতায় লাল কালি পরার। স্ত্রী মল্লিকা অবশ্য মায়ের সাথে সকালেই পৌঁছে গেছে মামার বাড়িতে।.
বাসস্টপেজ থেকে মিনিট দুই হাঁটার পর চোখে পড়ল সেই পরিচিত দুটি রাস্তা-- যার একটি চলেগেছে কেষ্টনগর; আর অপরটি লক্ষ্মণপুর। দুটি রাস্তার মধ্যে আকাশপাতাল প্রভেদ! কেষ্টনগর যাবার পথ পিচ দিয়ে ঢালাই। পথের একধার দিয়ে বরাবর চলেগেছে বৈদ্যুতিক পোস্ট। প্রতিটা পোস্টে বাতি লাগানো। রাস্তার মুখেই দুটি ভেন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে-- যাত্রী নেওয়ার জন্য। কিন্তু, যে পথে স্বদেশ বাবু যাবেন সে পথে ভেন গাড়ি যাওয়া তো দূরের কথা-- রাস্তায় বিন্দুমাত্র আলো পর্যন্ত নেই! ভাগ্যিস সঙ্গে করে একটা টর্চ এনেছিলেন-- না হলে এই কাঁকড় মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তায় হাঁটা মোটেই সুবিধাজনক হত না।
একবার ভাবলেন ভেনগুলোকে একবার বলে দেখলে কেমন হয়। কেউ যদি যেতে রাজি হয়। আবার ভাবলেন-- কোন লাভ হবে না। কারন তিনি বেশ ভালোকরেই জানেন যে কেউ যাবে না। এইভাবে একবার ঠকতে হয়েছিল তাকে। মাস ডেরেক আগে নতুন বৌ কে নিয়ে মামার বাড়ি আসার সময়-- তারা কেউ যাবেনা জেনেও জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি; আর তার বদলে যা শুনতে হয়েছিল। সেটা যেন আর ভাবতে পারলেননা তিনি। তবু তো তখন দিন ছিল, আর এখন এই রাত দশ-টার সময়; ওরে বা- বা----- তাকে যখন একাই যেতে হবে তাই ফালতু সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ব্যাগ থেকে টর্চটা বারকরে হাঁটার গতি আর একটু বাড়িয়ে দিলেন।
দুর্ভেদ্য অন্ধকার। টর্চ- টাই ভরসা। দু- পাশের বনস্পতি ফেলেরেখে এগিয়ে চলেছেন স্বদেশ বাবু। পথ কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। আকাশে কাস্তের মতো চাঁদটা গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে যেন তার সাথে লুকোচুরি খেলছে। মনের মধ্যে যদিও একটু ভয়, ভয় করছে-- তবুও নিজেকে শক্ত করে এগিয়ে চলেছেন।.
প্রায় দশ মিনিটের পথ তিনি অতিক্রম করে ফেলেছেন-- আর মাত্র মিনিট পাঁচেক। এবার যেন মনের ভিতর থেকে সমস্ত ভয় উবে যেতে শুরু করেছে। কি সব সাতপাঁচ ভাবছিলেন তিনি, এখনকার দিনে এই সব ভূতপ্রেত আর থকে! আদৌ কোনোদিন ছিল কি? সব ভীতু লোকগুলোর মনের কল্পনা। একটু আগে যেন আমিও তাদের মতই হয়ে গিয়েছিলাম! অথচ এতটা পথ চলে এলাম তাদের কোন নাম গন্ধই নেই! শুধু একটু সাহসের দরকার। স্বদেশ বাবুর এবার নিজেকে খুব সাহসী বলে মনে হতে লাগলো।
আরও মিনিট দুই হাঁটার পর তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে লক্ষ্য করলেন সামনের দিক থেকে ভেনে চেপে কে যেন আসছে। সেই ভেনেরই চাকার একটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ শোনা যাচ্ছে; যেন বেশ কিছুদিন চাকায় কোনো তেল পড়েনি। মাটিতে ফেলা টর্চের আলোয় ঝাপসা দেখা যাচ্ছে লোকটাকে।
টর্চ তুলে ভালো করে দেখতে গিয়েই ঘটল কাল। রাস্তায় পরে থাকা পাথর জাতীয় কিছুর সঙ্গে পা লেগে একটা জোর হোঁচট খেলেন স্বদেশ বাবু। মুখগুঁজে পড়লেন কাঁকর মাটির উপর। আর সেই সঙ্গেই হাত থেকে টর্চটা ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে লাগল একটা গাছের গুঁড়িতে। ব্যাস-- টর্চ গেলো ভেঙে; সঙ্গে, সঙ্গে চারিধার তিমিরে গ্রাস করে নিলো।
স্বদেশ বাবু তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এরই মধ্যে ভ্যানটি তার খুব সামনে চলে এসেছে -- চাকার শব্দ শুনে বুঝলেন। এবার আর একটা শব্দে মনে হল-- একজন লোক যেন ভ্যান থেকে নামল। এবার একজন লোকের পা ফেলার শব্দ। শব্দটা ক্রমশ তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। এবার একেবারে তার সামনে এসে থেমে গেলো। এবার সেই শব্দের সৃষ্টিকর্তাকে অন্ধকারে খুব অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পেলেন তিনি। রোগা প্যাঁকাটির মতো, কদাকার চেহারা। গায়ে মাংস বলে যেন কিছুই নেই। যেন এক ভূতুড়ে ছায়ামূর্তি।
স্বদেশ বাবুর বুকের ভিতরটা ধকধক করে ওঠে। হাত পা যেন সব ঠান্ডা হয়ে গেছে তার। -- ভূত বলে সত্যিই তাহালে কিছু আছে নাকি! এই ছায়ামূর্তিটা কি আসলে একটা প্রেতাত্মা! আর যদি সত্যি তাই হয়! তাহালে যে তার কপালে কি নাচছে---- ভাবা মাত্রই লোক-টার নাকের সুরে ভারী গলা কানে এলো, "আপনই কি স্বদেইশ বাইবু?"
স্বদেশ বাবু শুকনো গলায় কাঁপা, কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দিলেন, " হ্যাঁ-- আ- আ- আপনি কে?"
"আপনই যা ভাবইছেন আমই তা নই।" লোক-টার গলায় একটা বিশ্রী হাঁসি। "আমাইকে বিইষ্ণু বাইবু, মাইনে আপইনার মামা পাঠইছেন; আপইনাকে নিইয়ে যাইবর জন্য।"
"মা- আ- নে-- এই- রা- রাস্তায় তো রাতের বেলা কেউ আসতে চায় না-- তুমি এ-এলে যে?"
"মা- আ- নে-- এই- রা- রাস্তায় তো রাতের বেলা কেউ আসতে চায় না-- তুমি এ-এলে যে?"
"আইজ্ঞে -- বেশ মোটা টাইকা বকশিইস পেইলুম যে। তাই আর লোইভ সামইলতে পারইলুম না। ভাবইলুম আপইনি আসইতে পারইলে আমই কেন পারইমু না।"
"ঠিক আছে, ঠিক আছে-- এবার ভ্যানে বসতে পারি কি?" বলেই সঙ্গে, সঙ্গে ভ্যানে চেপে বসলেন। লোকটি কোন কথা না বলে-- ভ্যান টানতে শুরু করলো।
এতক্ষণ গাছের একটা পাতাও নড়ছিল না; এখন কোথা থেকে হঠাৎ করে যেন- মন্ত্রবলে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে! সারাদিনের পরিশ্রমের পর স্বদেশ বাবু খুব ক্লান্তি বোধ করছিলেন-- তাই ভ্যানে চেপে ঠাণ্ডা হাওয়ার ছোঁয়া পেয়ে-- চোখ যেন বুজে আসতে লাগলো তার। .
লোক-টার ডাকে স্বদেশ বাবুর তন্দ্রা ছুটে গেলো। চোখ মেলে দেখলেন-- একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ভ্যানটা।খুবি চেনা, চেনা লাগছে তার। আরে এটাই তো মেজো মামার বাড়ি! কিন্তু বাড়িতে একফোঁটা আলো নেই কেন! বোধহয় বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। কিন্তু তাও তো কোন কেরোসিনের বাতি জ্বলার কথা! কাউকে তো চোখেও পরছে না; বাড়ির সব গেলো কোথায়! কাল অনুষ্ঠান আজ তো অনেকেরই চলে আসার কথা; বাড়ি তো রীতিমত জমজমাট হবার কথা! তাহালে কি সব ভিতরে আছে! তাই হবে হয়ত।
স্বদেশ বাবুকে নামিয়ে ভ্যান চলে গেলো।
বাড়ির মেন গেট ঠেলে এগুতে লাগলেন তিনি। মনেতে কি রকম যেন একটা খটকা লাগতে শুরু করেছে তার। এটা মেজো মামার বাড়িই তো? আজ যেন বাড়িটাকে কিরাম অদ্ভুত লাগছে! বহু কাল বাড়িতে মানুষজন বসবাস না করলে বাড়ির যেরাম দশা হয়; কিরাম যেন ভূতুড়ে বাড়ি বলে মনে হচ্ছে! না, না কি সব ছাইপাঁশ ভাবছি-- আসলে এর আগে রাতের অন্ধকারে বাড়িটাকে কোনদিন দেখিনি তো, তাই; দেখলে এইসব উদ্ভট ভাবনা মাথায় আসত না।
এবার দরজায় টোকা মারলেন স্বদেশ বাবু-- কিন্তু কোন সাড়া এলো না। আবার টোকা-- ঠক--ঠক--ঠক--- এবারও নিরুত্তর! ব্যপার কি! বাড়ির সব গেলো কোথায়!
এবার দরজাটা হালকা করে ঠেলতেই একটা ক্যাঁচ শব্দে কিছুটা খুলে গেলো। এর আগেও এই দরজা সে খুলেছে-- কিন্তু, এরাম আওয়াজ তো এর আগে কোনদিন হয়নি! ভিতরে কালো অন্ধকার। একটা অতি ক্ষীণ আলোতে ঘরের ভিতরটা খুব অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। এবার দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। কিন্তু, কি আশ্চর্য ঘরে তো কেউ নেই! তাহালে কি ভিতর ঘরে! -- তাই হবে। কেরোসিনের একটা অতি ক্ষীণ আলো ভিতর ঘর থেকেই আসছে। স্বদেশ বাবু হাঁক মারলেন, "মামি, ও মামি, কোথায় গো সব তোমরা?" কোন উত্তর নেই! সারা ঘর নিস্তব্ধ। কোথা থেকে যেন ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে কানে।
সে তো যথেষ্ট জোরেই ডেকেছে; ভিতর ঘরে কেউ থাকলে এ ডাক তার কানে পৌঁছাবেই এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই! তাহলে কি সবাই ঘুমিয়ে পরেছে! তাই বা কি করে হয়! সে আসবে এটা তো সবাই জানে; আর এই ভাবে দরজাকবাট হাট করে সবাই ঘোমাবেই বা কেন! স্বদেশ বাবু এবার তার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকলেন, "মল্লিকা-- মল্লিকা।" এবারেও কোন জবাব এলো না!
আবার যেন ভয় করতে শুরু করেছে তার। কাঁপা, কাঁপা বুক নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন সেই মৃদু আলো জ্বলা ঘরটার দিকে। এবার তিনি যা চাক্ষুষ করলেন-- তাতে তার রক্ত জল হয়ে গেল। মৃদু আলো-টা আসলে কোনও কেরোসিনের বাতি নয়; টেবিলে রাখা একটা জ্বলন্ত কাঠ! যেন মরার চিতা থেকে তুলে আনা আধপোড়া কাঠ; যা এখনো মিন, মিন করে জ্বলছে! তিনি অচিন্ত্য হয়ে পরলেন; এ কাঠ এ ঘরে টেবিলে কেন কেউ রাখবে! --- তাহলে কি এটা মামার বাড়ি নয়! তিনি কি এখনও সেই রাস্তার মধ্যেই ফেঁসে আছেন! এই বাড়িটা কি প্রেতাত্মাদের কোনো মায়াবী বাড়ি! ছোটবেলার একটা গল্প যেন তার চোখের সামনে ভাসতে শুরু করেছে। হ্যাঁ; সেইসব গল্প গুলোর মধ্যে ঠিক এরামি একটা গল্প ছিল! আর যদি এটা সত্যি হয়-- তাহলে যে তার কপালে কি আছে-- ভগবানই জানে..... গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে; শুকনো গলায় কাঁপা, কাঁপা কণ্ঠে আবার ডাকলেন, "মা--মা--মা--মা।"
এবার দরজার সামনে এসে ঘরের ভিতর চোখ রাখতেই-- যে দৃশ্য তিনি দেখলেন-- তা এর আগে কোনদিন তিনি কল্পনাও করতে পারেননি! প্রত্যক্ষ ভাবে লক্ষ্য করলেন- দশ থেকে বারোটা কঙ্কাল মূর্তি যেন তার দিকেই চেয়ে আছে! তাদের রক্তবর্ণ চোখগুলো জাজ্বল্যমান। একাদিক্রমে তারা যেন দরজার দিকেই এগিয়ে আসতে শুরু করেছে!
সঙ্গে, সঙ্গে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা স্বদেশ বাবুর শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। হঠাৎ যেন তার শরীর চমকে দুলে ওঠে। তৎক্ষণাৎ মুখ দিয়ে একটা গোঁ- গোঁ শব্দ বের করে মাটিতে লুটিয়ে পরেন তিনি। এরপর আর কিছুই মনে নেই তার। পরদিন সকালে তাকে পাওয়া গিয়েছিল সেই রাস্তাতেই। ধুলোমাটি মেখে অচৈতন্য অবস্থায় পড়েছিলেন তিনি। .
তিনদিন পর , জ্ঞান ফিরে দেখলেন-- নার্সিংহোম এর একটা বেডে তিনি শুয়ে আছেন। তাকে ঘিরে তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন-দের ভিড়। চোখ খুলতেই সবাই নানা প্রশ্ন করতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু কারো কথা যেন কানেই পৌঁছচ্ছেনা স্বদেশ বাবুর; তার চোখে যেন সেই রাতের ছবি বারবার ভেসে উঠছে।
আর তার মনের ভিতর একটাই কথা উথালপাতাল করছে; তার মতন যারা ভূতে বিশ্বাস করে না-- তাদের কি সেই রাতের কথা বললে বিশ্বাস করবে? তিনি যে ভূত দেখেছেন-- তার কোনও প্রমাণও তো তিনিও কাউকে দিতে পারবেন না। তার কাছে যে কোনও প্রমাণ নেই।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন