রুমকী রায় দত্ত

rumki



বরের কর্মসূত্রে এর মধ্যেই অনেক দেশ দেখে ফেলেছি। শুধু এদেশ নয়,বিদেশও। ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালী তকমাটা ছেঁটে ফেলেছি এই চল্লিশের দোড় গোঁড়াতেই।প্যারিসের অইফেল টাওয়ার কে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে পোষ্ট করার মধ্যে আছে এক অদ্ভুত তৃপ্তি। আমি এমন অনেক মূল্যবান ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করে নিজেকে প্রমান করার চেষ্টা করেছি যে, আমি আমার বন্ধুদের থেকে কতটা এগিয়ে। করেছি,আর পেরেওছি। কিছু পরশ্রীকাতর বন্ধু আমার এই উন্নতি দেখে হিংসায় জ্বলেছে,---কেউ মুখ বেকিয়ে বলেছে,----“আমিও চাইলেই যেতে পারতাম কিন্তু যাওয়ার তাগিদ অনুভব করিনা”। আবার কেউ বলেছে, “ও গিয়ে কি এমন হাতির মাথা কিনেছে যে,আমি ওকে হিংসা করব”? আমি ওদের কথায় আনন্দ উপভোগ করেছি। আর যতবার আনন্দ পেয়েছি ততবার নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করে আমার সেই সব বন্ধুদের আরো বেশি করে ভাবতে বাধ্য করেছি যে, ওদের দেখা স্বপ্ন গুলো কেমন আমার পায়ে গড়াগড়ি খায়।নিজেকে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবার মধ্যে আমি এক অদ্ভূত তৃপ্তি পেতাম। শুধু একজন ছিল যে সেই কলেজ জীবন থেকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।

একদিন বর্ধমান থেকে যাচ্ছি চন্দননগর,ননদের বাড়ি।পান্ডুয়ার কাছে ট্রাফিকের কাছাকাছি আটকে গেলো গাড়িটা।কাঁচ নামিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখ পড়ল আমার বয়সি এক মহিলার দিকে,চমকে উঠলাম! চিনতে ভুল হলো না,আমার পুরানো প্রতিদ্বন্দ্বী আরিশেলী। ডাকলাম,---‘আরিশেলী-ই’। দেখলাম ওর চোখটা একবার চারপাশ দেখে নিয়ে আগের মতই দাঁড়িয়ে রইল। এবার আমি হাত নেড়ে ডাকতেই তাকালো আমার দিকে। মুখটা সামান্য বার করে বললাম, ‘চিনতে পারছিস?’

ও কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মত চেয়ে থাকলো। তারপর বলল-- ‘প্রথমে বুঝতেই পারিনি,বল কেমন আছিস?’

আরিশেলী যে স্কুলে চাকরি করে সেটা সুজাতার কাছে শুনে ছিলাম, বললাম, ‘স্কুলে যাচ্ছিস?’ —ও মাথা নেড়ে বলল না রে চন্দননগর যাব। স্নাতক থেকে মাস্টারডিগ্রী পর্যন্ত আমরা এক সাথে পড়েছি,পড়াশোনায় একেবারেই ভালো ছিলনা। তপশীল উপজাতি সম্প্রদায়ের হওয়ায় অনেক সুবিধা পেত,তাই যোগ্যতার নিরিখে সফলতা ওর অনেক বেশি ছিল।ওদের সমাজে তখন মেয়েদের শিক্ষার হার অনেক কম, প্রায় ছিলনা বললেই চলে। কলেজের শিক্ষকরা তাই ওকে নিয়ে বেশিই মাতামাতি করতো। ওর জনপ্রিয়তা আমার থেকেও বেশি ছিল।স্যার প্রায় বলতেন, ‘আরিশেলী ভালকরে পড়,তোকে দিয়ে আমি রিসার্চ করাবো’।আমার মনে মনে খুব হিংসা হত। ওকে এই ভাবে হঠাৎ পেয়ে আমার মনের প্রতিহিংসাটা জোড়ালো হলো।নিজের সুখ-স্বচ্ছন্দ প্রদর্শনের এবং ওর হঠাৎ এম-এ ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে আদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কারণটা জানার ইচ্ছায় ওকে বললাম, ‘ আই না,আমার সাথে গাড়িতে। চল,আমিও তো ওখানেই যাচ্ছি’।ওকে ইতস্থত করতে দেখে বললাম, ‘আরে লজ্জা পাস না,এটা আমার নিজের গাড়ি,নে উঠে আই’। ও আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে এলো।

কলেজে পড়ার সময় শুনেছিলাম মাধ্যমিকের পরই ও হেমন্ত হেমব্রম নামে ওর সহপাঠি একজনকে বিয়ে করে ঘর ছেড়েছিল।ছেলেটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করতো আর আরিশেলী একটা পারটাইম কাজ করতো।আরিশেলী দেখতে বেশ সুন্দরী,ফর্সা গায়ের রঙ।শেষের দিকে ওর লাবণ্যে কেমন যেন একটা ভাঁটা পড়তে থাকে। সুজাতার কাছে শুনেছিলাম ওর কিছু দাম্পত্য সমস্যা আছে। আরিশেলীকে সামনে পেয়ে আমার সব ঔৎসুক্য যেন সীমা ছাড়াচ্ছিল। বললাম, ‘ বল, কেমন আছিস? কেমন চলছে সংসার? আজ তোর গল্প শুনবো’।

ও কেমন সরলতা মাখানো মুখে সামান্য বিষন্ন হেসে বলল,--‘দূর আমার আবার গল্প,না রে আমার কোনো গল্পই নেই’।

আমি বললাম, ‘আছে,তোর মনে আছে? শেষ যে দিন তোর সঙ্গে আমার দেখা হয়,তুই এসেছিলি আমাদের বাড়ি,সঙ্গে তোর একটা বন্ধু,বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল বাইক নিয়ে। সেই তো শেষ দেখা। এম-এ ফাইনাল পরীক্ষার সময় তোকে একদিনও দেখলাম না। কেউ তোর কথা বলতেও পারলো না। পরীক্ষাটা দিলি না কেন আরিশেলী’? ও মাথা নিচু করে কি যেন ভাবতে থাকলো,আমি বুঝলাম সময় লাগবে,তাই ড্রাইভার কে সাইড করে গাড়ি দাঁড় করাতে বললাম। বাইরে এসে ডিকিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা ঠান্ডা পানীয়র বোতল জোড় করে ওর হাতে গুঁজে দিলাম,তৃষ্ণার্তের মত এক নিমেষে সবটা পান করলো।একটা গাছের দিকে কেমন যেন শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে শুরু করলো ওর কথা।

বলল, “জাগরী, তুই তো জানিস আমি হেমন্তকে বিয়ে করে ঘর ছেড়ে ছিলাম। কিন্তু সুখ আমার কপালে ছিলো না। দিনের পর দিন না বলে কোথায় চলে যেত! যখন ফিরতো আমার সাথে বাজে আচরণ,শারিরীক-মানসিক নির্যাতন করতো।ওর এই আচরণের কারনে বারে বারে বাড়ি পাল্টাতে হতো। আমার টাকায় সংসার,বাড়িভাড়া সব চলতো।অথচ ওকে কিছু বললে, বলতো,আমার জন্যই নাকি বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে—আমি নাকি ওর অনুপস্থিতিতে বাড়িতে ফূর্তি করি আর ঐ জন্যই নাকি গর্ভনিরোধক ওষুধ খাই।কিন্তু জাগরী তুই বিশ্বাস কর আমার এই দোলাচালের জীবনে কাউকে আনবো না বলেই আমি ওষুধ খেতাম”।

আমি বললাম, “তারপর”? ও বলল, “ঘর,সমাজ—সব তো ছেড়েছিলাম,যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। হেমন্তর অত্যাচারও দিনে দিনে বাড়ছিল।অদ্ভুত কষ্টের জীবনের মাঝে প্রভু যীশুর দূতের মত উত্তম আমার জীবনে এলো।ওকে পাশে পেয়ে মুক্তির স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। হেমন্তর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে একদিন ওর সাথে উকিলের কাছে গেলাম বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করতে। এরপর অপেক্ষা শুধু সময়ের।কিন্তু এক আশ্চর্য্য ঘটনা ঘটল,এর ঠিক সপ্তা খানেক পর থেকেই হঠাৎ হেমন্তর মধ্যে অদ্ভূত এক পরিবর্তন দেখলাম। যে মানুষ বাড়িতেই থাকতো না সে হঠাৎ বাড়ি থেকেই বেরানো বন্ধ করে দিল। স্কুল থেকে বেশ কিছুদিনের ছুটি নিল।আমার সাথে উত্তমের যোগাযোগের আর কোনো পথ থাকলো না।ওর ব্যবহার,ওর আচরণ সব বদলে গেল।আমি উত্তমের সাথে যোগাযোগ না করতে পেরে হাঁপিয়ে উঠতে লাগলাম।হেমন্তকে আগের মত হতে দেখে নিজের অজান্তেই কখন যেন ওর তিক্ত ব্যবহার গুলো হঠাৎ করে ভুলে যেতে চাইতাম।উত্তমের সাথে সম্পর্কটা শুধু যে মুক্তির পথছিল সেটা অনুভব করলাম,আর অনুভব করলাম আমি হেমন্তকে কোনো দিনও হারাতেই চাই নি।আমাদের জীবন ঠিক আগের মতই হয়ে উঠল—একসাথে খাওয়া,এক বিছানায় শোয়া, মাঝের দিন গুলো দুঃস্বপ্নের মত হারিয়ে গেলো।আরিশেলী আবার একটু থামলো। আমি বললাম, ‘এরপর’?---ও বলল, “এরপর,--আমি একদিন টের পেলাম আমি মা হতে চলেছি। কিন্তু মনের দ্বিধা কিছুতেই কাটছিল না।ক’দিন মনের সাথে যুদ্ধ করে হেমন্ত কে জানালাম।প্রথমবার ডাক্তার দেখানোর সময় ও আমার সঙ্গেও গেলো।মনে হতে লাগলো কোনো জাদু কাঠির ছোঁয়ায় আমার সব দুঃখগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল।বেশ নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ একদিন হেমন্ত স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলো না,দু’রাত,কোনো খবর নেই। দু’দিন অস্থিরতায় কেটে গেলো।ভোরের দিকে দরজায় শব্দ হতে,দরজা খুলে দেখালাম,হেমন্ত। আমি জানতে চাইলাম ‘কোথায় ছিলে?’ —ও কোনো কথা না বলে,চেয়ারে বসে জুতোর ফিঁতে গুলো টেনে টেনে খুলতে লাগলো। অজানা আশঙ্কায় আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। কাছে এসে দুই আঙুলে আমার চোয়ালটা চেপে ধরল,দাঁতে দাঁত ঘষে আমাকে এক ধাক্কা মেরে সড়িয়ে দিল।আর কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম এতদিন ও যা করেছে সবই উত্তমের সাথে আমার সম্পর্কটা নষ্ট করার জন্য।এখন আমি ওর সন্তানের মা হতে চলেছি,ও অনেক নিশ্চিন্ত। তাই আবার আগের মত। আবার শুরু হলো আমার মনের সাথে লড়াই। রাতের পর রাত জেগে শুধু ভাবতে লাগলাম আমি কি করবো। অবশেষে আমি ঠিক করলাম আমার এই জীবনে সন্তানের জন্ম দেব না। একদিন ওর অনুপস্থিতিতে ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরে আমার মাতৃত্বকে বিসর্জন দিয়ে এলাম। উত্তমের সাথে নতুন করে যোগাযোগের আর কোনো উপায় ছিল না। অনিয়মিত উপস্থিতির কারণে চাকরিটাও চলে গেছে তখন।হেমন্ত আমার ফোনটা ও সড়িয়ে ফেলেছিল।ভাবছি লড়াইটা আবার কোথা থেকে শুরু করবো,হেমন্ত আমার গর্ভপাতের কথা জানে না। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে—হঠাৎ সুজাতার সঙ্গে দেখা। ওর সাহায্যে আবার উত্তমের সাথে যোগাযোগ হল।

সামান্য থেমে জিজ্ঞাসা করলো--‘জাগরী, তোর কটা বাচ্চা রে?’ 

আমি বললাম—‘আমার একটাই মেয়ে রে’।আমার কথা শুনে ওর মুখটা কেমন একটা করুণ আর্তিতে ভরে গেল। দেখলাম বাঁ-হাতের তর্জনি দিয়ে ঝেড়ে ফেলছে চোখের কোনে জমা জল। আমি বুঝলাম যন্ত্রণা অনেক গভীর।আমি বললাম, ‘থামলি কেন আরিশেলী?’

[২]

ও বলল, “ হেমন্ত তখন একই রকম রাতে বাড়ি ফেরেনা,আমি সেটারই সুযোগ নিলাম,ব্যাঙ্কে জমানো হাজার দশেক টাকা আর আমার সার্টিফিকেট সম্বল করে বেরিয়ে পড়লাম উত্তমের সাথে।প্রথমে উকিলের বাড়ি তারপর উত্তমের নতুন ভাড়া বাড়িতে। দিন সাতেক ভালই ছিলাম।একদিন সন্ধ্যেবেলায় বারান্দায় বসে আছি,হঠাৎ বৃদ্ধ বাড়িওয়ালা তার নাতিকে নিয়ে হাজির হল।কোনো কিছু বলার সু্যোগ না দিয়েই বলল---‘ দেখে তো ভদ্দর ঘরের বৌ বলে মনে হয়,তা কতদিন ধরে এসব চলছে? যা ইচ্ছা হয় করো, তবে আমার বাড়িতে নয়। চব্বিশ ঘন্টা সময় দিলাম---তোমার ইয়ে কে বলো অন্য বাড়ি দেখতে’। আমি হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলাম,বৃদ্ধ খ্যাক—খ্যাক করে হাসতে হাসতে চলে গেলো। এরপর শুরু হলো বাসা বদল---ঝুপরী বস্তি থেকে বড় বাড়ি---শহরের মধ্যে আর আশ্রয় হলো না। উত্তমকে কখনও বিরক্ত হতে দেখলাম না।ওদিকে আমাদের বিচ্ছেদের মামলা শুরু হয়েছে। হেমন্তর হাত ছেড়ে পালিয়ে এসেছি,ও হিংস্র জন্তুর মত আমাকে খুঁজছে।আদালতে প্রথম দিন ওর সামনা-সামনি হতেই দেখলাম ওর আস্ফালন। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে একটা বাড়ি ভাড়া পেলাম শহরের থেকে অনেক দূরে নির্জন জায়গায়,যেখানে এদিক-ওদিক দু’একটা বাড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেখানে আমরা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে,স্বামী-স্ত্রীর জীবন যাপন করতে লাগলাম। আমি তখন আমার শেষ অবলম্বন হিসাবে উত্তমকে আঁকড়ে ধরেছি।গৃহবন্দী জীবন,উত্তম কাজে যাওয়ার আগে বাইরে থেকে দরজায় তালা ঝুলিয়ে যেত,যাতে বাইরে থেকে বাড়িতে কেউ নেই বলে মনে হয়।

একদিন,সন্ধ্যের পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি,সামান্য দূরে একটা বাড়ি থেকে একটি শিশুর খিল খিল হাসির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমার অতৃপ্ত মনের সুপ্ত বাসনা জেগে উঠল। আমি উত্তমের অজান্তেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করলাম। কিছুদিনের মধ্যেই টের পেলাম আমি আবার মা হতে চলেছি।আমার আনন্দের আর সীমা রইল না।খবরটা মাস খানেক লুকিয়ে রাখলাম উত্তমের কাছ থেকে।মন থেকে ভ্রূণ হত্যার পাপ বোধটাও চলে গেলো।উত্তমকে জানানোর আগে বারবার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।একদিন সুযোগ বুঝে বলে দিলাম।কিন্তু ওর মনের গতিটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।সকালে অফিস যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেল বিকালে এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি কেটে গেল উত্তম বাড়ি এলো না। আমার কাছে ফোন ছিলনা কোনো খবর নিতে পারছি না।আস্থিরতায় সারা রাত কেটে গেল।ঘরে রসদও বিশেষ ছিলো না।সামান্য চাল আলু যা ছিল তা দিয়ে দু’দিন চালালাম।এরপর চিড়ে-মুড়ি।প্রায় চার দিন কেটে গেল।আমার অনাগত সন্তানের অনিষ্ট আশঙ্কায় শুধু প্রভু যীশুকে ডাকতে লাগলাম।নির্জন জায়গা,চিৎকার করে গলা ফাটিয়েও কেউ শুনতেই পেল না। দুঃশ্চিন্তা-অর্ধ্বাহার---শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল।পঞ্চমদিন সকালে কোনো রকমে কলতলা পর্যন্ত গেলাম,জল তুলতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেল।জানি না কতক্ষন বা কতদিন ওখানেই পড়ে ছিলাম।জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম আমি উপুর হয়ে পড়ে আছি।আর আমার---বলেই আরিশেলী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।আমিও চোখের জল আটকে রাখতে পারলাম না। বুঝালাম—এবারও আরিশেলীর মা হওয়া হল না।

আরিশেলী বলল,--‘জানিস আমি তখন দিশে হারা,একবার মনে হচ্ছে নিজেকে হত্যা করি।আবার মনে হচ্ছে আমার এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের গলা টিপে মারি।পাগলের  মত ভাবতে লাগলাম,এই বন্ধঘর থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে লাগলাম। দেখলাম নতুন একটা সূর্যদয় হচ্ছে। সূর্যের প্রথম আলোয় শপথ নিলাম জীবনের যুদ্ধটাকে জয় করবার। মনের শক্তি ফিরে পেতেই বাইরে বেরোনোর পথও পেলাম।পিছনের বারান্দার গ্রীল দিয়ে ছাদে উঠে সামনের বারান্দার সেডটাতে নামলাম,তারপর তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পাশ বইটা হাতে নিয়ে বেরিয়া পরলাম জীবনের যুদ্ধ জিততে।সারাদিন ঘুরে বেড়ালাম।এরপর শুধু বাঁচার লড়াই সঙ্গে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি।জায়গাটা ছেড়ে নতুন করে বাঁচার আশায় পূর্বাঞ্চল থেকে স্কুল সার্ভিস পরীক্ষার আবেদন জানিয়ে ছিলাম।প্রভু যীশুও আমাকে দুঃখ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন,তাই স্কুল শিক্ষিকার চাকরিটা আমার হয়ে গেল।এত সবের মাঝে এম-এ ফাইনাল পরীক্ষাটা আর দেওয়া হল না।অতীতের ভয়ানক জীবনটা কে পিছনে ফেলে চলে এলাম এখানে।

এরপর মৌন আমি,আদ্র চোখে তাকালাম ওর দিকে,দেখলাম সিঁথিতে জেগে আছে এক চিলতে সিঁদুর।জানি না কার নামে সে আজও মাথায় সিঁদুর দেয়,জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছাই হলো না।শুধু অনুভব করলাম,যে আরিশেলী আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল তার তো অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে।আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়,জীবন যুদ্ধে জয়ী এক লড়াকু মহিলা যার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ারও যোগ্যতা আমার নেই।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ