রিয়া চক্রবর্তী

riya


প্লুটো, যাকে নিয়ে এখন তোলপাড় সারা বিশ্ব। যেই প্লুটোকে গ্রহর তালিকে থেকে বাদ দিয়েও আবার বিজ্ঞানীরা নিজেদের ভুল সংশোধন করে গ্রহের ঘিরেই ফিরিয়ে এনেছেন।  হার্ভার্ড অরিজিনস অব লাইফ ইনিশিয়েটিভের পরিচালক ডিমিটার স্যাসেলভ বলেন, সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণনই সৌরজগতের গ্রহের বৈশিষ্ট্য। আরেক জ্যোতির্বিদ ওয়েন জিঞ্জারিকের মতে, গ্রহ নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ধারণা রয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তিতও হয়েছে।  তার দাবি, প্লুটো গ্রহ হওয়ার সব শর্তই পূরণ করে।১৮৪৬ সালে সৌরজগতের অষ্টম গ্রহ নেপচুন আবিষ্কারের পর সন্ধান শুরু হয় নবম গ্রহের।  প্ল্যানেট এক্স নাম দিয়েই শুরু হয় এ সন্ধান। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি, যুক্তরাষ্ট্রের, অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের ফ্ল্যাগস্টাফে অবস্থিত লওয়েল অবযারভেটরিতে (Lowell Observatory) যোগদান করলেন ক্লাইড টমবাউকে (Clyde William Tombaugh)। প্রথম দিনই তিনি সেখানকার ১৩ ইঞ্চি পলক-তুলক (Blink comparator)দূরবীক্ষণ যন্ত্রটা তাক করলেন মিথুন নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে, তারা এক্স নামক একটা সম্ভাব্য গ্রহ খুঁজছেন ঐ অংশে।  জানুয়ারির ২৯ তারিখে তিনি ঐ অংশের আরো একটি ছবি নিলেন, কিন্তু ল্যাপটানো আলোময় ছবিগুলোতে তাঁর বস তেমন কিছুই দেখলেন না আসলে।  পরের মাসের ১৮ তারিখ, জানুয়ারিতে নেয়া দুটো ছবি তুলনা করে দেখেন কি, একটা অনুজ্জ্বল আলো স্থান পরিবর্তন করছে।  স্থান পরিবর্তন কথাটা যতটা বড় বোঝায় বিষয়টা মোটেও তা ছিল না, ১ ইঞ্চির মাত্র আট ভাগের মতো স্থান পরিবর্তন করেছে মাত্র।  ঠিক পরের মাসেই, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ তিনি নিশ্চিত হলেন, ওটা একটা গ্রহ হিসেবে।  ক্লাইড ছিলেন সে সময়ের সেরা জ্যোতির্বিদ।এবার শুরু হয়ে গেল নতুন আবিষ্কৃত গ্রহের নামকরণ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। খবরের কাগজের মাধ্যমে সারা দুনিয়া যখন জানতে পারল নতুন গ্রহের খবর, তখন এর নাম কী হবে, তা নিয়ে জনমনে চিন্তার সৃষ্টি করল। অনেকে লোয়াল অবজারভেটরিতে চিঠি দিল নাম প্রস্তাব করে।  এই নাম প্রস্তাবে অনেকেই নিজের নাম, ছেলেমেয়ের নামসহ অনেক নামই প্রস্তাব করেছিল। এখান থেকেই শুরু হয় সাত বছরের এক শিশুর গল্প।

ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে মা আর দাদু ও দিদার সাথে ভেনেসিয়া বার্নি বাস করত।  শিশু বয়সেই সে তার বাবাকে হারিয়েছে।  মেয়েটি ছিল খুব পড়ুয়া।  পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জ্যোতির্বিদ্যা এবং পৌরাণিক কাহিনী ছিল তার পড়ার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়।  ১৯৩০ সালের মার্চ মাসের কোন একদিন সকালে প্রাতরাশ করার সময় তার দাদু নতুন গ্রহ আবিষ্কারের খবরটা জোরে জোরে পড়ে শোনালেন এবং শেষে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘নতুন গ্রহের নাম কী হবে?’

মিনিট খানেক চিন্তা করেই ভেনেসিয়া শান্তভাবে বলল, নতুন গ্রহের নাম হওয়া উচিত প্লুটো। ব্যাখ্যা হিসেবে জানাল, একমাত্র পৃথিবী ছাড়া সব গ্রহের নাম হয়েছে প্রাচীন রোমের দেব-দেবীদের নাম অনুসারে। মার্কারি (বুধ) হচ্ছেন দেবতাদের দূত, ভেনাস (শুক্র) হচ্ছে ভালোবাসা এবং সৌন্দর্য্যের দেবী, মার্স (মঙ্গল) হচ্ছে যুদ্ধের দেবতা, জুপিটার (বৃহস্পতি) সব দেবতাদের রাজা, স্যাটার্ন (শনি) হচ্ছে শস্যের দেবতা, ইউরেনাস (ইউরেনাস) হচ্ছে আকাশ দেবতা, এবং নেপচুন হচ্ছে সমুদ্র দেবতা।  পুরাণে প্লুটো মৃত্যুর দেবতা হিসেবে পরিচিত।  পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, প্লুটো বিষণ্ণ এক জগতের বাসিন্দা।  সে জাদুর শিরস্ত্রাণের সাহায্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারত। একইভাবে নতুন আবিষ্কৃত গ্রহটি শীতল, সৌরজগতের সবচেয়ে দূরের গ্রহ, অনেকদিন তা অজানাই ছিল এবং এর সম্পর্কে এখনো মানুষ খুব বেশি কিছু জানে না। যেহেতু দেবতা প্লুটোর সাথে মিলে যাচ্ছে, তাই গ্রহটির নাম প্লুটোই হওয়া উচিত।

এদিকে  মাসখানেক পেরিয়ে গেছে। ভেনেসিয়া ভুলে গেছে নামকরণের ব্যাপারটা।  কিন্তু ভুলতে পারেননি তার দাদু।  তিনি লোয়েল অবজারভেটরিতে নাতনীর দেয়া নামটা চিঠি লিখে প্রস্তাব করলেন। ততদিনে লোয়ালে এমন অনেক চিঠি এসেই জমা পড়েছে। অগত্যা সদস্যদের ভোটের আয়োজন করা হল।  আর সে ভোটে নতুন গ্রহটির নাম দেয়া হল ‘প্লুটো’, সাত বছরের ভেনেসিয়াও চিরদিনের জন্য জড়িয়ে গেল সৌরজগতের এক গ্রহের ইতিহাসের সাথে।প্লুটো, সূর্যকে ঘোরে  অনুমানিক  ১৬৪ বছরে একবার।অন্যান্য গ্রহের মতো এর কক্ষপথটা সূর্যের চারপাশে বৃত্তাকার না, বরং ডিম্বাকার। এই ডিম্বাকার কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে প্লুটো একসময় সূর্যের বেশ কাছাকাছি চলে আসে, আবার অনেক অনেক দূরে চলে যায়।  ক্যারন হল প্লুটোর বৃহত্তম উপগ্রহ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের সমান বড়।প্লুটো আর ক্যারন এমনভাবে একে অপরকে ঘিরে আবর্তিত হয় যে, আসলে প্লুটোকে ঘিরে ক্যারন ঘুরছে না, ক্যারনকে ঘিরে প্লুটো।  মনেহয় দুজনেই দুজনকে ঘিরে ঘুরছে। এজন্য এরাই হচ্ছে সৌরজগতের প্রথম বাইনারি গ্রহ (যুগল গ্রহ?) (অবশ্য অনেক বিজ্ঞানী আমাদের পৃথিবী আর চাঁদকেও তেমনটা বলতে চান)।বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্লুটো আমাদের ৪.৫৬ বিলিয়ন বছর (বিলিয়নের হিসাব 109 ধরলে ৪,৫৬,০০,০০,০০০ বছর) বয়স্ক সৌরজগতের তুলনায় খুব নতুন একটা গ্রহ, কারণ এখানে দেখা প্রায় ১১,০০০ ফুট উঁচু পর্বতগুলোর বয়স মাত্র ১০০ মিলিয়ন বছর (অর্থাৎ ১০,০০,০০,০০০ বছর)।
 আমরা  বিজ্ঞানের এই জয় যাত্রায় যেমন আপ্লুত, তেমনি আনন্দিত সৌরজগতের দূরবর্তী এই ছোট্ট নতুন  গ্রহটিকে কাছ থেকে দেখতে পেরে, আরো ঘনিষ্ঠভাবে জানতে পেরে।  প্রিয় এই বামন গ্রহটি যে আসলেই এই সৌরজগতের একটা শিশু – এটা নিশ্চিত করে জানানোটা অবশ্যই নিউ হরাইজন্‌স-এর অসাধারণ এক কৃতিত্ব।  প্লুটো বাদ যায়নি মহাকাশ বিজ্ঞান থেকে; ভেনেসিয়াও তাই হারিয়ে যায়নি ইতিহাস থেকে।

riya
পরিচিতি


রিয়া চক্রবর্তী রিয়া চক্রবর্তী Reviewed by Pd on অক্টোবর ০৬, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.