জয়া চৌধুরী

jaya



তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জিথাঃ
এই বাক্যটি বিন্দু বিসর্গ উপনিষদ না পড়েই একটু ইতিউতি টুকে লিখে ফেলা যায়।  এই যেমন আমি করলাম।  ঈশোপনিষদের প্রথম শ্লোকই এটি।  কি অসম্ভব উদ্ভট কথা এটি একবার ভেবে দেখুন পাঠক? আমার দেবভাষার পুঁজি এতই করুণ আর এই কথাটিও এমন গোলমেলে যে এটি পড়েই আর এগোতে পারলাম না।  বাপ রে...কী নিদারুণ গভীর বাক্য এটি।

আমরা ভোগ মানে কি বুঝি ? যখন থেকে মাতৃ গর্ভ ছেড়ে বের হই ভব সমুদ্রে নিরন্তর আমরা চাইতে থাকি ।  সেই যে ওঁয়া ওঁয়া করে খাবার চাইতে শুরু করি, ব্যস আমাদের চাওয়া চলতে থাকে বলহরি হরিবোল পর্যন্ত।  এ ব্যাপারটা কে না স্বীকার করবেন? হ্যাঁ যাহারা অতিশয় পক্ক বুদ্ধি তাহারা ইহা মানিবেন না এটা ঠিক।  লাও এখন ভাষার গুরুচণ্ডালী দোষ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আসল কথায় আসুন দেখি।  ব্যাপারটা হল বাঁচতে গেলে চাইতেই হয়- ঠিক কি না? অথচ উপনিষদ যে বললেন ত্যাগ করে ভোগ করো! আরে বাবা ত্যাগ ই যদি করব তাহলে ভোগ করব কি? প্রাথমিক দরকারগুলোর কথা বাদ দিন।  আমরা বলছি তার পরে অতিরিক্ত কিছু চাওয়া প্রসঙ্গে।  ধরুন আমাদের এই পরিমাণ ধন থাকলে খাবার পোশাক ক্রয় ক্ষমতা ইত্যাদি পোষণ করা যায়।  অতএব আর আমি চাইব না।  এমন বর্ণ পরিচয়ের সুবোধ বালক হতে পারি কি আমরা?

আবার দেখুন বাজার অর্থনীতি বলে আমরা চাই বলেই চাহিদা পূর্ণ  করার জন্য দ্রব্য উৎপাদন হয় ।  আর দ্রব্য উৎপাদনে বেশি সংখ্যায় কর্ম সংস্থান হয় ...এবং বেকারী কিছুটা কমে। এখন বেকারী একটি বিশ্বজনীন সমস্যা।  এখানে যারা বেকার তাদের জীবন ধারণের জন্য চাকরিটি দরকার।  আবার যারা ভোগ্যপণ্য কিনতে চান তারা ভোগ না করলে উৎপাদনের প্রয়োজন কমে যায়।  তাহলে এত সব বাস্তব ব্যাপার স্যাপারের মধ্যে ত্যাগ বেচারী মাথা তুলে দাঁড়াবে কি করে?

তবে কি শাস্ত্র মিথ্যা?  তবে যে ছোট থেকে শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেল পরের ধনে লোভ করো না...মানে “মা গৃধঃ”। সেসব তাহলে ভুল?  তাহলে যে নিত্যই দেখি এই কেলেঙ্কারি ওই কেলেঙ্কারি সবই তো সেই অর্থ আত্মসাতের গল্প।  এতে ভোগ ছাড়া আর কিছুই তো দেখি না।  এতে তো শুধু প্রয়োজন মেটার পরেও বেশি ধনের লোভ করাকে নিন্দা করছি আমরা অহরহ।  অথচ ত্যাগ করতে বললেই...আমরা ভাবি ত্যাগ মানেই সন্ন্যাসীরা করেন।  ওসব গৃহীদের কাম নয়।  তাই কি? গৃহী হলেই কি কামড়াকামড়ি করতে হবে? বেশি লোভ যে গোটা বিশ্বকে দু পক্ষীয় পৃথিবীতে পরিণত করছে তা কি আমরা দেখছি না? কাল যারা হ্যাভ নটস থাকে আজ তারাই হ্যাভ হয়ে সুখী হয়।

...হ্যাঁ সুখী হয় ।  ঠিক।  শান্তি পায় না।  তার মানে শান্তি পেতে গেলে লোভ বর্জন করতেই হয়।  শান্তি র যে কী ভীষণ অভাব চারদিকে আমরা রোজ দেখি রোজ।  একই অশান্তি আমরা বইয়ে সিনেমায় নাটকে অফিসে বাড়িতে সব জায়গায় দেখি।  দেখি উপায় হাতড়াই, কান্নাকাটি করি, চিকিৎসা করি...।  আবার লোভ করি।  সেই কবে শাস্ত্র বললেন ‘নাল্পে সুখমস্তি”।  তাই তো দেখি সর্বত্র।

তাই লোভ করাটাকে ত্যাগ করতেই হবে আমাদের।  এখন এই বিপজ্জনক সীমারেখাটি ঠিক করবেন কে? কতটা চাইলে তাকে লোভ বলা যায় না? চাওয়া না থাকলে কি পৃথিবীটাই চলে? আমরা ছোটবেলায় দেখতাম আমাদের মা দিদিমারা বাড়ির সবাইকে খাইয়ে নিজেরা খেতেন, বাবা জ্যেঠুরা সবাইকে পুজোর পোশাক কিনে দেবার পরে হয়ত নিজের হলই না কিছু ।  কুছ পরোয়া নেহি...তবু সবাই হাসিমুখে থাকতেন। তাহলে কোন কিছুর প্রতি অন্যায় চাওয়া ত্যাগ করাটাই শান্তির চাবিকাঠি। আর একটু যোগ করি এর সঙ্গে... আমাদের দেশের প্রাচীন কাল থেকেই “অতিথি দেবো ভব” খুব আদৃত একটি কথা।  আমাদের দেশের গরীবদের বাড়িতে হটাত গিয়ে পড়লেও তাঁরা নিজের খাবার থেকেও খাবার দেন এ গল্প আমাদের ইতিহাসে পুরাণে রূপকথায় ছড়িয়ে আছে। আদতেই যে ত্যাগ মানুষকে শান্তি দেয় এ বিষয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষ দের কোন সংশয় ছিল না।  তাই বলে কি প্রয়োজনীয় চাওয়া ছিল না? ছিল তো।  জ্ঞানের স্পৃহা না থাকলে আমরা আজও পাথর ছুঁড়ে শিকার করে খেতাম।  তার বেশি এগোন হতো না।  মুশকিল হলো আমরা সভ্য হয়ে ওঠার পরে আবারও চূড়ান্ত লোভ করে ভোগের দিকে নিজেদের ঠেলে দিচ্ছি।  তাই আমেরিকায় আজকাল শিশুরা বন্ধুদের মারতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে অহরহ, কিংবা সুখী পৃথিবীর মানুষেরা দৌড়ে আসছেন ভারতে এতটুকু শান্তির খোঁজে।  একটু নজর রাখলেই দেখবেন গত পাঁচ বছরে ভারতে বিদেশীদের আগমন ও এদেশী কাউকে বিবাহ করার অভ্যাস কি ভীষণ বেড়ে গেছে। সবটাই ইকোনমি নয় হে পাঠক,  শান্তির ও এতে ভূমিকা আছে।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে যে আজও আমাদের সাধারণ মানুষের ভেতরে ত্যাগের প্রবণতা বেশি বলেই শান্তি টিকে আছে। আর তার লোভেই বিদেশীদের এত ছুটে আসা।  এইসব চিন্তা ভাগ করে নিলাম আপনাদের সামনে।  একবার ভেবে দেখবেন প্রিয় পাঠক। ত্যাগ আসলেই স্বস্তি ও মুক্তির উপায়।

অলমিতি।

jaya
পরিচিতি




জয়া চৌধুরী জয়া চৌধুরী Reviewed by Pd on অক্টোবর ০৬, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.