রেবতী দমটা বন্ধ করে এক লাফে ট্রেনে উঠলো,তারপর বড় করে একটা শ্বাস নিল।একটা শান্তির নিঃশ্বাস।ট্রেনে চাপতে ওর ভীষণ ভয় করে।সেই যখন থেকে ট্রেনটাকে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে দেখেছে,তখন থেকেই পেটের ভিতর,বুকের ভিতর কেমন যেন করছিল। চাকায় ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা গতি নিতেই রেবতী গিয়ে পড়ল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক বছর চল্লিশের লোকের গায়ে। অফিস যাত্রী মনে হয়। - --‘উফ্! মাসিমা, করছেনটা কি? —একটু ধরে দাঁড়ান! এই বয়সে কেউ একা একা রাস্তায় বেরোয়? ---আর বাড়ির লোকেদের ও আক্কেল বটে!’ পাশে দাঁড়ানো লোকটিও ফোড়ন কাটার সুযোগটাকে হাতছাড়া না করে একটা দেঁতো হাসি হেসে বলল—‘তা যা বলেছেন’।
ব্রতীন ব্যাগটা বাঙ্কে তুলে বিরক্তি মেশানো মুখে মার দিকে তাকিয়ে বলল—‘দিন দিন তুমি যেন কেমন বোকা হয়ে যাচ্ছ মা! —তোমাকে নিয়ে রাস্তায় বেরোনোও মুশকিল,সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়’। অসহায় মুখে রেবতী তাকিয়ে থাকে ছেলের দিকে।
দাদা, একটু চাপুন তো— বলেই ব্রতীন পকেট থেকে রুমালটা নিয়ে সিটের উপর রেখে দেয়। ভিড় ঠেলে দু’পা এগিয়ে হাত বাড়ায় মায়ের দিকে। রেবতী বাধ্য মেয়ের মত ব্রতীনের হাতটা ধরে এসে বসে লোকাল ট্রেনের সিটের চতুর্থ স্থানে অর্ধঝুলন্ত অবস্থায়। বারবার গেটের সামনে দাঁড়ানো লোকটার কথা গুলো তোলপাড় তোলে রেবতীর মনে। সত্যিই কি ওর এত বয়স হয়ে গেছে যে, একা একা আর বাইরে বেরোনো চলে না! ছেলের সাথে বেরোলেও একটা অতিরিক্ত বোঝার মত চলতে থাকে। এইসব কারনেই আজকাল ওর আর ঘর থেকে বেরোতে ইচ্ছা করে না। ব্রতীনের বাবা,সুবিমল মারা যাওয়ার পর থেকেই ঘরকুনো হয়ে গেছে। সারা দিন ঐ টিভির পর্দায় চোখ রেখে বসে থাকা।এক সময় গল্পের বইয়ের পোকা ছিল,এখন ঐ সবও আর ভালো লাগে না।হাল্কা রঙের শাড়ি আর সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন সঙ্গে বিধবার পালনীয় আচার-আচরণ—এই এক সরল জীবনাবর্তের মাঝে পাক খেতে খেতে কাটিয়ে দিয়েছে বিগত পাঁচ বছর।সুবিমল থাকতে তাও মাঝে মাঝে ঘুরতে যেত। এখন একা একা বাইরে বেরোলে কেমন যেন আড়ষ্ঠ হয়ে যায়। সুবিমল তখন সদ্য মারা গেছে,পেনশনের টাকাটা কিভাবে তুলবে সেটা ব্যাঙ্কের এক কর্মচারি কে জিজ্ঞাসা করতেই এমন ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল যে,অসহায়ের মত রেবতীর দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ছিল। সেই থেকে রেবতী আর ব্যাঙ্কে যায় নি। যদি কোনো দরকার পড়েছে ব্রতীনকে সঙ্গে নিয়ে তবে গেছে। মাসের শেষে ব্রতীন এসে পেনশনের টাকাটা তুলে দিয়ে যায়।আর কাছেই এক তথ্যমিত্র কেন্দ্রে ইলেকট্রিকের বিলটা জমা দিয়ে দেয় রেবতী,এর জন্য দু’টাকা বেশি দিতে হয় ওকে।
পাশের লোকটা উঠে যেতেই রেবতী একটু আরাম করে বসল,মাথাটা সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে।চোখটা বন্ধ করে মনে মনে নিজের বয়সটা হিসাব করল। – আটান্ন বছর পাঁচমাস বাইশ দিন। ফস্ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল—‘তা লোকটা ঠিকই বলেছে। সাড়ে আটান্ন তো আর কম নয়!’ বন্ধ চোখটা খুলে একবার তাকায় সামনের দিকে। দরাজার সামনেটা ভিড়ে ঠাসা।ভিড়ের প্রাচীর ভেদ করে দৃষ্টির ওপারে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তারই মাঝে ওর দৃষ্টি গিয়ে আটকায় একটি লাল শার্টের উপরে। দূর থেকে ভালো বুঝতে পারে না রেবতী,কিন্তু রঙটা এত উজ্বল যে বারবার চোখ ঐ দিকেই চলে যায়। এতটুকু আন্দাজ করে, সে একজন মহিলা। আবার চোখটা বন্ধ করে হারিয়ে যেতে চেষ্টা করে।
‘এই যে ভাই,একটু সরে বসুন তো’। ---এক পরিণত বয়সের মহিলার কন্ঠস্বর শুনে চোখটা সামান্য ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করে রেবতী। কিন্তু চমকে দু’চোখের পাতা খুলে তাকিয়ে দেখতে থাকে ঐ মহিলা কে। –ঠিক ওরই বয়সি হবে।চোখের কোলে বলী রেখার চিহ্ন তবে ওর থেকে কম।ছোটো ছোটো চোখকে ঘিরে কালো কাজলের রেখা।ঠোঁটের রঙ জামার রঙের সাথে মিলে গেছে। চোয়ালের কাছে গালের চামরা ঝুলে মুখে একটা ভারিক্কি এনেছে। রীতিমত পরিচর্যা করা চামড়া,চুল,নখ। পরনে সাদা প্যান্ট আর লাল শার্ট,পায়ে পামসু। রেবতী বেশ কিছুক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করেও বুঝে পেল না মহিলা সদবা না বিধবা না অনূঢ়া। সিটে বসেই লাল নেলপালিশ লাগানো বাহারি তর্জনি দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনটা টাচ্ করে নাম্বার ডায়াল করলো। বাঁ-হাত দিয়ে ঘাড় পর্যন্ত ঝুলে থাকা এলোমেলো চুল গুলিকে কানের পাশে গুঁজে ইংরাজিতে কথা বলে চলেছে। – রেবতীর হঠাৎ মনে পড়ল ব্রতীনের কথা,বছর দুয়েক আগে ল্যান্ডফোনটা কাটিয়ে ব্রতীন একটা কমদামী বোতাম টেপা মোবাইল এনে বলে ছিল—‘তোমার জন্য এই মোবাইলই ঠিক মা,তুমি যা স্মার্ট—তাতে টাচ্স্ক্রিন মোবাইল চালানো তোমার কম্ম নয়’। রেবতী মনে মনে ভাবল,ব্রতীন ঠিকই বলেছিল,এত জটিল বিষয় ওর মাথায় ঢুকতো না। মিশনারী স্কুলে পড়ার সময় ইংরাজিতেই কথা বলত বেশি,অথচ আজ ইংরাজী উচ্চারণ করতেও জিভ কেমন আড়ষ্ঠ হয়ে যায়।
ভাবনার মাঝেই কে যেন বলে উঠলো—‘ মাসিমা,পা টাএকটু ঢুকিয়ে বসুন’। রেবতী দেখলো একটা ছেলে চ্যানেলে ঢুকলো। ব্যাগটা উপরে তুলে প্রথমে রেবতীর দিকেই ফিরে দাড়াঁল,তারপর কায়দা করে ঐ মহিলার দিকে ঘুরে গেল।রেবতীর সামনে ঐ ছেলেটির পশ্চাদ্ভাগ।মুখের সামনে লোকের পাছা দেখলেই রেবতীর রাগে গা জ্বলে যায়।পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়িয়েই ছেলেটি ওই মহিলা কে উদ্দেশ্য করে বলল—‘ম্যাডাম, কাইন্ডলি ব্যাগটা একটু ভিতরের দিকে ঠেলে দেবেন? ---দাঁড়াতে একটু সুবিধা হত’।
মহিলা সামান্য সামনে ঝুঁকে ব্যাগটা পায়ের পিছনে সিটের নিচে ঠেলে দেওয়ার সময় দেখা গেল স্পষ্ট বিভাজিকা–রেবতী শাড়ির আঁচলটা ভালো করে গায়ে টেনে নিল।
[২]
প্রায় একমাস হতে চলল রেবতী ছেলের সঙ্গে ছেলের ফ্ল্যাটে আছে। সকাল সকাল ব্রতীন আর রীনা অফিস বেড়িয়ে গেছে। ছেলে,ছেলের বৌ এর ব্যস্ত জীবন।সপ্তাহের একটা ছুটির দিন রেবতী আর ওদের মাঝে থাকতে চায় না। এই কর্মব্যস্ত শহুরে রাস্তায় একা হাঁটার সাহস ও পায় না রেবতী। জীবনটা যেন শহুরে খাঁচায় বন্দি হয়ে গেছে। সুবিমল চলে যাওয়ার পর থেকেই এই এক ঘেঁয়ে জীবন। টিভি দেখতে ভালো না লাগলে বসে থাকে নিজের ঘরের জানালার প্রসারিত অংশে। উন্মুক্ত আকাশটা হাতছানি দেয়,চেষ্টা করেও পারে না উড়তে, --নাকি ওর চেষ্টার মধ্যেই খামতি আছে ভাবতে ভাবতে এসে বসে খোলা জানালায়। দেখতে থাকে নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানব সমুদ্র। ওর দৃষ্টি ঘুরতে থাকে ওরই বয়সি মানুষের দিকে। কেউ এই বয়সে দু’হাতে ব্যাগ নিয়ে গটগট করে হেঁটে চলেছে।কেউ বা নিজের থেকে কম বয়সি মেয়েদের সাথে ওদের মতই রঙচঙে পোশাক পড়ে পাল্লা দিয়ে ফুচকা খাচ্ছে। ওদের দেখে এমনই একটা জীবন পেতে ইচ্ছা করে,মনে হয় ডানায় নীল রঙ মেখে প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াতে। ছুটে যায় দরজার দিকে।থমকে যায় শহরের জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে। সারা দিন ধরে বাইরের জগৎ কে নিয়ে যেভাবনা তা ভাবনা পর্যন্তই থেকে যায়। এর বেশি সাহস দেখনোর মত সাহস ওর নেই।নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে। ফিরে আসে জানালার ধারে। তাকিয়ে দেখে প্রতিদিনের মত বাড়ির সামনের পার্কে আড্ডা দিচ্ছে বুড়োর দল। রেবতী জানলা দিয়ে ওদের কান্ড দেখে নিজের মনেই হাসতে থাকে। দুজোন বয়স্ক মহিলাও ওদের সঙ্গে জুটেছে। এই বয়সেও কেমন যেন ঢলানিপনা করেছে। দেখে রাগ হয়ে যায় রেবতীর। নিজেকে কেমন যেন খাঁচার পাখি বলে মনে হয়,কেমন যেন ছটফট করতে থাকে যেমন, বনের পাখিকে দেখে খাঁচার পাখির মনে হয়। রেবতী অবশ্য এটাকে হিংসা মনে করে না।ওই মহিলা দুজন ডিপ রঙের চুড়িদার পড়ে এসেছে। ব্রতীন তো কতবার ডিপ রঙের শাড়ি কিনে দিয়েছে। আগে এসব মানাতো এখন আর মানায় না। বয়স্ক বিধবা মহিলাদের জন্য সমাজ এমনটায় নিয়ম তৈরি করেছে।ভাবতে ভাবতে রেবতী উঠে আসে জানালা থেকে। বালিশের তলা থেকে আলমারির চাবিটা বার করে খুলে ফেলে আলমারিটা। থরে থরে সাজানো লাল,সবুজ,নীল রঙের শাড়ি। আলতো করে স্পর্শ করতে থাকে শাড়িগুলো। তারপর মুখটা শাড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে ঘ্রাণ নেই প্রাণ ভরে। সুবিমল চলে যাওয়ার পর এই শাড়ি গুলোর দিকে আর ফিরে তাকায় নি। এগুলো ওর বড় প্রিয় শাড়ি। বেঁছে নেয় একটা সবুজ রঙের শাড়ি,গালে ঠেকায়,তারপর পড়ে ফেলে দাঁড়ায় গিয়ে আয়নার সামনে। নিজের উপর রাগ হয়,খুলে ফেলে দেয় শাড়িটা—মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানাই---সবাই পারে তবু ও কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারেনা এই সংস্কার থেকে---আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে—কেন?—কেন?-কেন? প্রতিবারের মত নিজেকে প্রশ্নবাণে জেরবার করার আগেই যুক্তি সাজিয়ে নেয় নিজেই।
সেদিন ট্রেনের সেই মহিলা যেন ওর মনে তোলপাড় তুলে দিয়ে গেছে।ট্রেন থেকে নামার পরেও রেবতী তাকে দৃষ্টি আড়াল হতে দেয়নি। অবাক হয়েছিল রেবতী। যে বয়সে ও ছেলের হাত ধরে রাস্তা হাঁটে ঐ মহিলা সেই বয়সে কেমন একা একা গটমট করে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড পর্যন্ত গিয়ে টুক করে উঠে পরে ছিল ট্যাক্সিতে। ভাবনার মাঝে ছেদ পড়ে। গোটা বাড়ি জুড়ে নেমে আসে আঁধার। অন্ধকারে রেবতীর ভীষণ ভয় করে। আবার নিজের উপর রাগ হয় ওর,ব্রতীন কতবার শব্দহীন বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্রটা চালানো শেখাতে চেয়েছে। ও ইচ্ছা করেই শেখনি,ভয় পেয়েছে। অন্ধকারে ভীষণ ভয়ে লাগছে,কান্না পাচ্ছে ওর। হাত দুটো কে সামনে রেখে বড় বড় চোখে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে যায় রেবতী। নিজেকে প্রমান করার তাগিদ অনুভব করে। নিজেকে উদীপ্ত করার চেষ্টা করে,দম বন্ধ করে চালিয়ে দেয় যন্ত্রটা। ঘরটা আলোয় ঝলমল করে উঠতেই লাফিয়ে ওঠে রেবতী। - --আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ‘--আমি পারি—আমি পারি—আমিও পারি’। ওর মনে হয় কত সহজ ছিল ব্যাপারটা।
[৩]
রীনা মুখে রুটির টুকরোটা পুরে ব্রতীন কে ঠেস মেরে বলল---‘আগে ওরা এত সাহস দেখাতে পেরেছে কখনও,আজ তিনদিন ধরে কি হয়রানিটাই না হতে হচ্ছে। আমি তো আজ অনেক অনুরোধ করে পাঁচশ টাকায় ট্যাক্সি টা পেলাম,ন্যানি তো দাঁড়িয়ে থাকলো সরকারি বাসের অপেক্ষায়। ---কি করবে! ওর বাড়ি পর্যন্ত যেতে হলে বারোশ থেকে চোদ্দশো টাকা চায়তো। ---এই তো তোমাদের সরকারের হাল’। ব্রতীন রুটিটা ছিঁড়ে সবে মুখে ঢুকাতে যাচ্ছিল,থেমে গেল, রেগে গিয়ে বলল—‘এখানে না ভালো লাগলে অন্য কোথাও চলে গেলেই পারো,যেখানে তোমার পিয়ারের লোক সরকার গড়েছে।তারপর সামান্য হেসে বলল---‘অবশ্য তেমন জায়গা পেতে গেলে খড়ের গাদায় ছুঁচ খুঁজতে হবে—ধুয়ে মুছে তো একেবারে সাফ করে দিয়েছে’। ব্রতীনের কথার ধরনে রীনার গা যেন জ্বলে গেল, হা হা করে চিৎকার করে ব্রতীনের সাথে তর্ক জুড়ে দিল।
রেবতীর সব ওলটপালট হয়ে গেল। সন্ধ্যে থেকে মনে মনে অনেক বার বলে নিয়েছিল কি ভাবে ব্রতীনকে চশমার ফ্রেমটা পালটানোর কথা বলবে। এখন যা পরিস্থিতি তৈরি হলো রেবতীর আর প্রসঙ্গটা উত্থাপন করাই হলনা। মাথা নিচু করে মুখ বুজে খেতে লাগলো। চশমার ফ্রেমটা পাল্টাতে খরচ যা হবে সবই ও দেবে। শুধু একা যেতে ভয় করে তাই,সঙ্গে যাওয়ার কথা বলতো। সেটাও বলতে পারলো না।
ব্রতীন রীনার সঙ্গে তর্কে হেরে গিয়ে সমস্ত রাগ উগরে দিল রেবতীর উপর। রেবতীর দিকে তাকিয়ে বলল---‘আচ্ছা মা,আমরা যে দেশ নিয়ে,রাজনীতি নিয়ে এত কথা বলছি,তোমার কি কিছুই বলার নেই? ---বিকালে হাঁটতে বেরোচ্ছ?’—রেবতী মাথা নেড়ে না বলে। –রীনার দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গের সুরে মাকে বলে—‘তবে আর কি ,সারাদিন ওই সিরিয়ালই দেখ।রাজনীতি বুঝে আর কাজ নেই’। জানো, বিবেক,মোহন এদের মা দের দেখে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি,সব বিষয়ে কথা বলতে পারে,কত স্মার্ট। একা একাই ব্যাঙ্ক-বাজার করছে। দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমাকে দেখলে মনে হয়না এক কালে তুমি মিশনারি স্কুলে পড়েছ’। ন্যাপকিন দিয়ে মুখটা মুছেই উঠে পড়ে ব্রতীন। রীনার দিকে তাকিয়ে বলে –‘আমি মরলে তুমি আবার এসব ন্যাকামি কোরোনা’।
রেবতী ঘরের আলো বন্ধ করে এসে বসে ওর প্রিয় জায়গা ঐ খোলা জানালার উপর। একটা হালকা নীল আলো জ্বলছে। প্যাঁচার মত চেয়ে আছে অন্ধকারের দিকে,যেন কিসের প্রতীক্ষা। প্রতি দিনের মত রাস্তার ওপাশের ফ্ল্যাটটি তে আলো জ্বলে ওঠে আর সঙ্গে সঙ্গে গ্রীলহীন জানালাটা খুলে যায়। জানালার সামনে রাখা সোফাটার উপর ছিটকে পড়তে লাগে কোনো মহিলার পোশাক। ঐ খোলা জানালার সামনে হাল্কা গোলাপী রঙের রাতপোশাক পড়ে এসে দাঁড়ায় সেই মহিলা। ঘার পর্যন্ত ঝুলে থাকা থোকা থোকা চুলে আঙুল চালায় তারপর দু’দিকে হাতটা টানটান করে মেলে দেয়—ক্রমে ক্রমে দুলে ওঠে কোমর-মাথা। মিউজিকের দ্রিম্ দ্রিম্ আওয়াজের সাথে নেচে চলেছে ছাব্বিশ বছরের যুবতির মত। ঠিক প্রতিদিন যেমন করে। রেবতী নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করে,কে ঠিক--- ব্রতীন? —ঐ প্রতিবেশিনী, নাকি ও নিজে।
পায়ের এলোমেলো পদক্ষেপে গোটা ঘর জুড়ে নেচে বেড়াচ্ছে রেবতী। কিন্তু এ কি!একটু আগেই পায়ের নিচে ছিল ব্রতীনের ঘরের সুন্দর কার্পেট, হঠাৎ কি করে যেন সেটা ট্রেনের কামড়া হয়ে গেল! চারিদিকের জনরবের মাঝে রেবতী স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে গমগমে সুরে বেজে চলা গানের শব্দ।রেবতী নেচেই চলেছে।
অদ্ভূত এক গোঁ গোঁ শব্দ শুনে ব্রতীন ছুটে এসেছে মা’র ঘরে।রেবতী বিছানায় শুয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাত-পা নাড়ছে। ব্রতীন মায়ের গায়ে আলতো ভাবে হাত ছোঁয়ায়, হুড়মুড় করে উঠে বসে রেবতী। কিছুক্ষণ সময় নেই স্বপ্নের ঘোর কাটাতে। কখন যেন প্রতিবেশিনীকে নকল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ছিল।
ব্রতীন জিজ্ঞাসা করে---‘কি হয়েছিল মা? —তুমি অমন করছিলে কেন?
রেবতী ছেলের মাথায় আলতো হাত ছুঁইয়ে বলে---‘ কিছু না বাবা,বোধ হয় স্বপ্ন দেখছিলাম’।
ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে ব্রতীন পিছন ফিরতেই দেখে রেবতী মোবাইলে সময় দেখছে। মাথাটা খাটে হেলানো। রেবতী থেমে যাওয়া সময়ের হিসাব কষতে থাকে।ঠিক হিসাব, নাকি নিজের কাছেই কৈফিয়ৎ চায় বয়ে যাওয়া সময়টার।আবার যুক্তি গুলো ভিড় করে আসে মাথায়। রেবতী ঠেলে সরিয়ে দিতে চাই,এভাবেই তো কত দিন ধরে চেষ্টা করছে।কিন্তু পারছে না। আবার নিজেকে কাঠ গড়ায় দাঁড় করায়—সত্যিই কি চেষ্টা করছে? —নাকি চেষ্টার নামে ভন্ডামি।মানষিক যুদ্ধে পরাজিত রেবতী বেরিয়ে আসে বাইরে। ব্রতীন-রীনা অনেকক্ষণ আগেই অফিস বেরিয়ে গেছে। টেবিলে ঢাকা দেওয়া দুপুরের খাবার।আজ রেবতীর একাদশী,সামান্য ফলাহার। আজ পাঁচ বছর ধরে রেবতী একাদশীতে দিনে একবার আহার গ্রহণ করে। ঘড়ির দিকে তাকায় এগারোটা বাজে। ঢাকা খুলে ফলের প্লেটটা টেনে নেয় নিজের সামনে। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগে ঐ প্রতিবেশিনী কি বিধবা?---চোখের সামনে ভাসতে থাকে বিমল,মিহিরদের মায়ের কল্পিত ছবি।ওরা সব পারে---শুধু পারেনা রেবতী। কানে বাজে ‘মাসিমা, পা টা সরান’।কানে ভাসে ট্রেনের সেই অপরিচিত লোকটার সমালোচনা,ব্রতীনের ভৎসনা। ঘড়িটা টিক টিক করে বাজতে থাকে। হঠাৎ রেবতীর মনে হয় সময়টা বুঝি পালিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভূত এক ব্যাকুলতা অনুভব করে,যেন ডুবন্ত মানুষ খড়-কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে। নিজের অজান্তেই টেবিলের কভারটা কখন কুঁচকে হাতের মুঠোয় চলে আসে। ছুটে চলে যায় নিজের ঘরে। বালিশের নিচ থেকে বের করে নেয় আলমারির চাবিটা। বেঁছে নেয় মেরুণ রঙের শাড়িটা যেটা, অঙ্গে ঠেকানোর ইচ্ছা টা সুবিমলের সাথেই হারিয়ে গিয়ে ছিল। কপালে একটা মেরুণ টিপ। গ্যারাজ থেকে বের করে আনে রীনার স্কুটিটা। সেই ব্রতীন ছোটো থাকতে শিখেছিল ওটা চালাতে। হাতটা সামান্য কেঁপে গেল। স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে,কিন্তু রেবতীর নিঃশ্বাস স্থির। লাফিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল।সবুজ রঙের আঁচলটা হাওয়ায় উড়ছে,সঙ্গে রেবতীর কাঁচা-পাকা চুল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার লাল-কালো চশমার ফ্রেমটা আড় চোখে বারবার দেখছে। উদ্বেগ হীন স্বচ্ছ দৃষ্টি ...
---খাবার টেবিলের উপর পড়ে আছে মাছের কাঁটা আর পুরানো বোতাম টেপা মোবাইলটা চাপা দেওয়া একটা দু’লাইনের চিঠি।
![]() |
| পরিচিতি |
রুমকি রায় দত্ত
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ১৫, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ১৫, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন