‘‘মাহিদুল, ঠিক আজ থেকেই আমাকে তোমার ভুলে যেতে হবে; আমি চাইনা আমাদের সম্পর্কটি আর এগোক । অনাকাঙ্ক্ষিত, অযাচিত অথচ দীর্ঘ বিষাদে তুমি আমি গড়াগড়ি খাওয়ার চাইতে বরং এখন এই সাময়িক বিষাদকে এসো আলিঙ্গন করি আমরা । এতে তোমার যেমন ভাল, ভাল আমার জন্যও । আমাদের মিলন যেখানে নিশ্চিত নয়; চলার যে পথ মসৃণ নয়, যে পথ কেবলই ধুলো কাদামাখা, পদে পদে কাঁটা বিছানো সে পথে হেঁটে যাওয়া ঠিক নয় । সম্পর্কটি টেনে নিয়ে যাওয়া বোকামি ব’লেই মনে হয় । তোমার সাথে আমার কোনদিনই বিয়ে হবেনা । আমাদের সম্পর্কটি আর কেউ মেনে নিলেও আমার মা কোনোদিন মেনে নেবে না । শুধু শুধু কষ্ট পেয়ে কি লাভ বলতো ? তাছাড়া আমি এখন অন্যদিকে ব্যস্ত আছি । আমার এখন উঠতি ক্যারিয়ার; আমি চাইনা আমার কারিয়ারে আমাদের সম্পর্কটি কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়াক । তোমার সাথে এতদিন আমার যা যা হয়েছে তা আমি ভুলে যাব; তুমিও ভুলে যাও । আমি এখন আসি; একটি বিজ্ঞাপনের শুটিং আছে উত্তরায়’’ । কথা গুলো ব’লেই ওঠে দাঁড়ায় রাইমা ।
মাহিদুল কি বলবে ঠিক বুঝে ওঠতে পারেনা । তবুও বলে-‘এমনতো কথা ছিলোনা রাই । তোমার কিছু কথাতেই কী এতদিনের সম্পর্কটি এক মুহূর্তেই শেষ হয়ে যেতে পারে ? আর কিছু না হোক মূল্যবোধ বলেতো অন্তত একটি কথা আছে । তোমার মা মেনে নেবেনা সেটা ঠিক, কিন্তু আমাদের সম্পর্কটির জন্যে তোমার ক্যারিয়ার নষ্ট হবে সেটা মানতে পারছিনা । হাঁ এটাও সত্যি যে আমি এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারিনি তবে এমন দিনতো বহুদিন থাকবেনা তাইনা’ ? কথা গুলো শুনে রাইমার কোন প্রতিক্রিয়া হয়না । শুধু বলে-‘‘তোমার মানতে পারা না পারাতে আমার কিছু যায় আসেনা । আমি এখন কেবল মাত্র আমার ক্যারিয়ার নিয়েই ভাবছি ।
তোমার কী আছে যে, আমাকে সুখী করে তুলবে ? কী আছে যে, তোমার সাথে প’ড়ে থেকে অনিশ্চিত পথে পা বাড়াতে হবেনা ? স্তব্ধ হয়ে যায় মাহি ! বুকের ভেতর যেন মুহুর্মুহু কেউ তির ছুঁড়ে মারছে । রাইমার প্রতিটি কথাতেই অবাক হয় মাহি । নিজেকে রক্তাক্ত, বিপন্ন মনে হচ্ছে । ভাবে- ‘ভালোবাসা এতো মূল্যহীন ! কোন মূল্য নেই স্পর্শের, অনুভবের, অনুভূতির ? হৃদয়ের আত্মীয়তা এতো সহজে ভেঙে ফেলা যায় ? ভেতরে ভেতরে ভেঙে প’ড়ে মাহি । এক মুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু ।
রেস্টুরেন্ট থেকে তুমুল বৃষ্টির মাঝেও একটা গাড়ি এসে উঠিয়ে নিয়ে যায় রাইমাকে । একা বসে থাকে মাহি । রাগ,দুঃখ অপমান একসঙ্গে ঘিরে ধরে মাহিকে । জীবনে কোন ঝড়ই বলে আসেনা । হুটহাট ক’রে এসে হুটহাট করে থেমে যায় ! শুধু থেমে যাবার পর পরিমাপ করা যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণটুকু । এতে যা হবার তা হয়ে যায় । ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থেকে জীবনের এমন পরিহাস নীরবে নিবৃতে উপভোগ করা ছাড়া মানুষের আর কিছুই করার থাকেনা ।
‘কিছুকিছু বিষয় মানুষের হাতে থাকেনা মাহি’ । তাছাড়া জীবনের সব ক্ষেত্রেই সফল হ’তে নেই । ব্যর্থতারও দরকার আছে জীবনে ।না হলে বুঝবি কেমন ক’রে জীবনের রঙ এক নয় একাধিক ? জীবন রঙবেরঙের । রঙের পালাবদলে জীবন হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ক্যানভাস । আমরা সেই ক্যানভাসে আঁকি আমাদেরই প্রতিচ্ছবি, দুঃখ ব্যথা, বেদনা । আয়নার সামনে দাঁড়ালে যার সবটা ধরা পড়ে তার আগে নয় । এই প্রতিচ্ছবি আঁকতে গিয়ে কেউ বেছে নিই সঠিক রঙ, কেউ ভুল রঙ ! আসলে কী জানিস রঙ চিনতে চিনতেই আমাদের সময় পেরিয়ে যায় । যদিও সময় পাই তখন রঙ গুলো ফিকে হয়ে আসে । আঁচড় দিতে তখন আর ইচ্ছা করেনা । কারণ, পরিত্যক্ত ক্যানভাস !
মুকুল দা’র কথা গুলো তীব্র ভাবে নাড়া দিয়ে যায় মাহিকে । একটা খুব বাজে সময় পেরিয়ে এসে মুকুল দা এখন বাকি জীবনের সামনে দায়বদ্ধতার যোগ আর বিয়োগ ফল নামাতেই ব্যতিব্যস্ত ! মুকুল দা’র কথায় ঘায়ে প্রলেপ লাগে কিছুটা ।
মাহি ধীরে ধীরে নিজেকে ঠিক করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । এতদিন যা করেনি তাই করে । যে এবং যার পেছনে ছুটেনি, সে এবং তার কাছে ছুটে যায় সময়-অসময়ে । বুকে ভার নিয়ে চলে । মন খারাপ নিয়ে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যায় । কোন কোন বন্ধু ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে । ইমনতো ওকে বলে ব্যাকডেটেড; অন্তত প্রেম ভালোবাসার ক্ষেত্রে ! দেখা হ’লেই বলে-‘বস, তুমি যুগ চিনলানা যুগের পোলাপাইন হইয়া । গেইম খেলবা ওয়ান টু ওয়ান পাসে, টি-টুয়েন্টি’র মতো । টেস্ট ম্যাচ স্টাইলে খেললে তো ধরা খাইবাই’ ।
একমাত্র রনক ওকে ঠিক বুঝতে পারে মুকুল দা’র মতো ক’রে । একদিন আড্ডায় বিষ্ণু বলে বসে- ‘রাই কে আজকাল ড্যান্স ক্লাবে দেখা যায় স্বল্প বসনে’ । একদিন গিয়েছিলাম এক বড়লোক বন্ধুর সাথে ওখানে । আমিতো দেখে অবাক ! রানা, ইমন, তৌফিক শুনে হতবাক । সমস্বরে বলে ওঠে- বলিস কিরে । সবচেয়ে বড় বোমাটা ফাটায় কায়েস । বলে-‘সেদিন দেখলাম রাইমাকে মেরি স্টপ ক্লিনিকে ঢুকতে’ । আড্ডায় এই মুহূর্তে পিনপতন নীরবতা । শুনে সবাই বড় বড় চোখ ক’রে তাকায় একে অপরের দিকে । রনক বুঝতে পারে আগুনে ঘি ঢালা হচ্ছে । পোড়া ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে । রনক বলে- ‘আচ্ছা তোদের কী কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই ? কই মাহিকে বুঝাবি; তা না ক’রে আজেবাজে বলে যাচ্ছিস ।
আগুনে শেষমেশ জল ঢেলে দেয় মাহিদুল নিজেই । রনককে বলে- ‘‘কথা গুলো'তো মিথ্যে নয় । সত্য কোনোদিন চাপা থাকেনা রনক; আজো থাকেনি’’ । বলেই হাঁটা দেয় মাহি । বন্ধুরা তা দেখে অবাক ! তবে ওকে কেউ আটকানোর চেষ্টা করেনা । একটু একা থাকলে মনে হয় ভালোই হবে । তবুও রনক পিছু পিছু ছুটে যায় ।
পথ আটকে দাঁড়ায় রনক । মাহিকে জিজ্ঞেস করে-‘কী হয়েছে খুলে বলত’ ।মাহির চোখে জল । এই জলই বলে দেয় অনেক কিছু । তবুও মুখ খোলে মাহি-‘‘মিলি বলল অর্থের হাতলে চাপতে গিয়ে রাইমা আজ আমার থেকে বহুদূরে । মডেলিং জগতের রঙিন আয়নায় নিজেকে দেখতে গিয়ে একদিন রাইমা নিজেকে আবিষ্কার করে অন্ধকারে । যেখানে কোন আলো নেই, আয়না নেই, আছে শুধুই নানা রঙ আর পাশা বদলের খেলা । ওখানে টিকে থাকবার জন্যে ও এ্যাবরশন পর্যন্ত করিয়েছে; যার ফলাফল ওই মেরি স্টপ ক্লিনিক । মাহি বলে যায়- ‘‘খবর গুলো প্রিন্ট মিডিয়াতে এসেছে যদিও কিন্তু ওদেরকে বিশ্বাস করা যায়না । বানোয়াট সংবাদ ছাপিয়ে পয়সা কামায় ওরা সবাই জানে । তবুও আমার মন মানছিল না, খবরের সত্যতা জানার জন্য মিলিকে ফোন দিয়েছিলাম । ওই বলল-এসব সত্যি ।
রনক কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হ’য়ে যায় ।
বেশকিছু দিন পর একটি অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে যায় মাহি আর রাইমার । রাইমাকে নিঃসঙ্গ দেখায় । ওর সমস্ত চোখে মুখে বিষাদের ছাপ । উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় যেন নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধ করছে । এগিয়ে যায় মাহি । জিজ্ঞেস করে- ‘কেমন আছো’ ? প্রশ্নটি অবান্তর জেনেও করে । রাইমার চোখ ছলছল করে ওঠে । এমন করে আর কেউ কোনোদিন জিজ্ঞেস করেনি । করেছে অন্য প্রশ্ন, অন্য ইঙ্গিতে । প্রশ্নে ছিল দেনা পাওনার হিসেব নিকেশ, ছিল অন্য অনেক কিছুই ।
‘‘কেমন থাকতে পারি ধারণাও নেই তোমার ? তবুও বলি-রঙবেরঙের জীবন পেরিয়ে এইতো আছি বেশ; আছি রঙহীন জীবন আলোয়’’ । এই জীবনই কী ভাল নয় রাই ? যে জীবনে দ্বন্দ্ব নেই, সংঘাত নেই, দ্বিধা নেই । আছে তার সম্মিলিত ফলাফল, সম্মিলিত প্রয়াস ।
অনুষ্ঠানের রঙবেরঙের আলো নিভে যায় একসময় । মধ্যরাতের আকাশে একমাত্র চাঁদ আলো হয়ে জেগে থাকে মাথার উপর । বিদায় পর্বে সব আলো নিভে গিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে বিষাদের ছায়া ! বিষাদমাখা আকাশের দিকে চেয়ে মাহি বলে ওঠে-‘রাই, বুঝে নাও আলোর সূর্যের চেয়ে চাঁদের আলো মানুষের এতো প্রিয় কেন !’’
![]() |
| পরিচিতি |
ইফতেখারুল হক
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ১৫, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ১৫, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন