দোলনচাঁপা ধর




তাঁরা দুজনেই পাঠক মনের মুকুটহীন সম্রাট তাই বাঙ্গালিকে যে কোন একজনকে বেছে নেওয়ার অগ্নিপরীক্ষায় না দাঁড় করিয়েই আমরা দুটি বিজয় মাল্য গাঁথতে পারি। বলতে দ্বিধা নেই প্রথমে এসে  প্রথমেই চলে গেলেন যিনি তাঁর কথাই আমরা তুলনায় বেশী চর্চা করেছি আজীবন, তাঁর জীবন না জানেন এমন বাঙালি কষ্টে মেলে, অপরপক্ষে দ্বিতীয়জন পরম আদরণীয় হয়েও বেশী বেঁচে আছেন তাঁর কাজের মধ্যে অর্থাৎ জীবনীর চেয়ে বেশী জীবনে। এ ক্ষেত্রে এও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই কর্ম দিয়ে জন্মকে জয় করার প্রতিযোগিতায় তিনিই প্রথম জনের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে। একজন মাটিতে নেমে এসেছেন ‘প্রাণের মানুষ’ হয়ে আর একজন ‘ধূমকেতু’ র গতিতে মাটি থেকে উঠে এলেন প্রাণে। দুজনের জীবনেই শিক্ষা শুরু হয়েছিল প্রথাগত নিয়মের বাইরে, দুজনেই জীবনকে বুঝেছেন তার সাথে গায়ে গা লাগিয়ে। প্রিয়জন হারানোর বেদনা নীল করেছে দুজনেরই হৃৎপিণ্ড, আর দুজনেই আরও বলিয়ান হয়ে তাঁদের সমস্ত দুঃখ আনন্দ ঢেলে দিয়েছেন লেখার খাতায়। ধর্মীয় আবহে বড় হয়ে উঠেও ধর্ম তাঁদের অন্ধ করে নি, সাধারণ মানুষ ও তাদের জীবন বার বার ফিরে এসেছে তাঁদের সৃষ্টিতে। দেশ ও দেশবাসীর প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম ভালবাসা, সম্মান গান, কবিতা হয়ে আজও আমাদের মুখে মুখে ফেরে। যে কোন উৎসবে কিংবা শোকে আমরা অনিবার্য ভাবেই তাঁদের সৃষ্টির কাছে হাত পেতে দাঁড়াই।

একজন জন্ম নিলেন বৈভব ও সংস্কৃতির সিদ্ধপিঠে আর একজন অতি দরিদ্র একটি পরিবারে যেখানে মাত্র দশ বছর বয়সেই পিতৃহীন হয়ে পরিবার পালনের দায় কাঁধে নিতে গিয়ে পা রাখতে হয় এক বৈচিত্রপূর্ণ জীবন সংগ্রামে। যেখানে একটি শিশু জমিদার সন্তান হয়েও পরিচারকের তত্বাবধানে এক দমবন্ধ অন্দরমহলে সাজিয়ে নিল তার মনোজগৎ আর একজন অভাবের সমুদ্রে ছিপ নৌকা বেয়ে সারা পৃথিবীকে ছুঁয়ে দেখল আপন করে। একজন অভিজাত লালিত্যে, ছন্দে বিছিয়ে দিলেন তাঁর সৃষ্টি আর একজন উদ্ধত কালবৈশাখীর মত উড়িয়ে দিলেন তাঁর বিজয় নিশান, দুজনেই জয় করলেন পৃথিবীকে। কোন দুঃখ, আনন্দ, সম্মান থামাতে পারেনি সে বিজয়রথ, মানব জীবনের প্রতি বাঁকে গিয়ে তাঁরা ছুঁয়ে দিলেন বীণার তার। মানসিক দুর্যোগের অপ্রতুলতা ছিল না তবে তুলনায় আর্থিক দুর্যোগ কম থাকায় সাহিত্য সৃষ্টিতে থেমে থাকেন নি প্রথম জন, শিক্ষা জগতে, সমাজ তথা পল্লী কল্যাণে তাঁর অবদান আজকেও প্রাসঙ্গিক। সমকালীন রাজনৈতিক মত প্রকাশেও নির্ভীকতার পরিচয় দিয়েছেন উভয়েই, এবং প্রয়োজনে কারাবরণ করতেও অস্বীকার করেন নি দ্বিতীয় জন।

বাংলা দেশে কবি-সাহিত্যিকের অভাব কোনোদিন ছিল না, তা সত্বেও এনারা দুইজন কবে কিভাবে যেন বঙ্গীয় সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে উঠলেন আর এতদিন পরেও অশরীরে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন কত তরুণ লিখিয়েদের তাঁদের অফুরান সৃষ্টির নির্ঝরে। আজও বাংলার আকাশ বাতাস তাঁদের আবির্ভাব-তিরোধান দিবসগুলিতে মুখর হয়ে ওঠে তাঁদেরই কথায় সুরে। আরও আরও সুগন্ধের আশায় আমরা বহুচর্চিত তাঁদের জীবনকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি চন্দন কাঠের মত। সে কাঠও অক্ষয় আর সুগন্ধের তো কথাই নেই।                  

দুই সূর্য মুখোমুখি হলেও বিস্ফোরণের কারণ ঘটে নি। প্রবীণ যিনি, নবীন কে নিলেন সাদরে, বৈশাখ অবধারিত ভাবে মিলল জ্যৈষ্ঠে আর বাঙালি উষ্ণ সন্ধ্যায় বেলি জুঁইয়ের সাথে পেল রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী।



দোলনচাঁপা ধর দোলনচাঁপা ধর Reviewed by Pd on মে ০৯, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.