আমি তখন সবে মাত্র উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে,উচ্চশিক্ষার জন্য এসেছি বহরমপুরে। কৃষ্ণনাথ কলেজে ফিজিওলজি অনার্স পড়ি। থাকি গোরাবাজার এলাকায় একটি বেসরকারি হোস্টেলের দোতলায়, রাস্তার ধারে টু-সিটের রুমে। আমি আর সুস্মিতা। আমরা প্রতিদিনই টিউশন পড়ে সাড়ে সাতটা মধ্যে হোস্টেলে ফিরতাম,তারপর টিফিনের বাটি হাতে নিয়ে কাকিমার ঘরে খবর শুনতে শুনতে খেতাম। সেদিনও আমরা খবর শুনতে শুনতে খাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা খবর আমাদের স্তম্ভিত করে দিল। একটি স্থানীয় সংবাদ চ্যানেল,এক তরুন সাংবাদিক লাউডস্পিকার মুখের কাছে ধরে বলছে------“এই যে, ঠিক এই জায়গায়,কিছুক্ষন আগেই উদ্ধার হয়েছে এক মহিলার মৃতদেহ”। সাংবাদিকের কথা শেষ হতেই ক্যামেরা আরও ক্লোজ করে স্থানটি দেখানো হলো। এবার ফোকাস তরুন সাংবাদিকের মুখে,সে বলছে,-----‘এই সেই ভাঙা পাচিঁল,সুতির মাঠের এই পাঁচিলের পিছনেই পরেছিল ঐ মহিলার মৃতদেহ। স্থানীয় কিছু বাচ্চা খেলতে খেলতে এখানে এসে পরলে,তারাই প্রথম মৃতদেহটি দেখতে পায়।এ রপর পুলিশ এসে মৃতদেহটি উদ্ধার করে। মৃতদেহের শরীরে কোনো আচ্ছাদন ছিল না।প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে মৃত মহিলা ধর্ষনের শিকার হয়েছিল। ধর্ষনই যে মৃত্যুর কারণ সে বিষয়ে পুলিশ এখনও নিশ্চিত নয়। ময়না তদন্তের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত পুলিশ এ বিষয়ে কিছু বলতে নারাজ’।
খবরটা গোটা হোস্টেলে ছড়াতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। সব ঘরেই মেয়েদের জটলা শুরু হয়ে গেল। একটা ঘটনার দৌলতে যার ঝুলিতে যত ভয়ানক ঘটানা ছিল,সব একে একে বেরিয়ে আসতে লাগলো রঙের প্রলেপ মেখে। আমি আর সুস্মিতা শুধু চুপ করে রইলাম। আমরা দুজনেই বুঝতে পারছিলাম তখন আমাদের মনের আবস্থা,একটু আগেই আমরা ঐ পথ দিয়েই ফিরেছি। আমাদের অত কাছে একটা মৃতদেহ ছিল সেটা ভাবতেই শিরদাঁড়া বেয়ে গরম ঘাম গড়িয়ে পরতে লাগলো। কেমন একটা ঘোরের মধ্যেই রাতটা কাটালাম।
পরদিন খবরের কাগজে ঘটনাটা আরও বিস্তারিত ভাবে প্রকাশিত হয়েছে দেখলাম।মূল ঘটনা একই,কিছু নতুন তথ্য সংযোজন করা হয়েছে।ঘটনা স্থল থেকে পুলিশ নাকি খালি দেশালাই বাক্স আর আনেক পোড়া কাঠি ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পেয়েছে। মৃতদেহের গায়ে ও অন্যান্য অংশে পোড়া চিহ্ন পাওয়া গেছে। ঘটনার নৃসংশতায় আমরা দুজন মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পরলাম।কিছুদিনের জন্য বাড়ি ফিরে এলাম।
কিন্তু এখানেই ঘটনার শেষ হলনা বরং সূচনা হল গল্পের। এর ঠিক দু’সপ্তাহ পরে আমরা দুজনে ফিরে এলাম হোস্টেলে। এরপর কেটে গেল পাঁচ বছর। এম-এস-সি পরীক্ষা শেষ হতেই সুস্মিতা বাড়ি ফিরে গেল,আমি রয়ে গেলাম। আমার তখন কম্পিউটারের সেমিস্টার চলছে।পরীক্ষার পর বাড়ি ফিরে বিয়ের পিঁড়িতে বসবো না বলে, হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছি। কলেজ জীবনে যাকে ভালোবেসে ছিলাম সে, গতি পরিবর্তন করে অন্য নদীর সাথে মিশে যাওয়ায় মনটা তখন অস্থির। স্থানীয় এক ইংরাজী মাধ্যম স্কুলের বিজ্ঞাপন দেখে জীবন বিজ্ঞান শিক্ষিকার পদে আবেদন করেছিলাম। চাকরিটা হয়ে গেল। পাঁচ বছর একই জায়গায় থাকাতে পরিচিতিটা ভালই ছিল। একদিন স্কুল থেকে ফিরছি,মৃণাল দা আমাকে ডাকলো। মৃণাল দা বুথমালিক,ওখান থেকেই আমি বাড়িতে ফোন করতাম। সঙ্গে একটা মুদির দোকানও আছে।আমাকে ডেকে বললো, “মোহনা, আমার মেয়েটা সিক্সে পড়ে, ওর জন্য একটা টিচার খুঁজছিলাম,তুমি কি ওকে পড়াতে পারবে?” আমি রাজি হয়ে গেলাম। পরদিন আমাকে নিয়ে গেল বাড়িতে। সেই প্রথম পরিচয় হল বৌদির সাথে আমার। মিশুকে স্বভাবের একমুখ হাসি মাখা।পাছা ছাড়িয়ে একঢাল চুল।পাকা গমের সোনালী বর্ণের মত গায়ের রং। চোখের মনির রঙ খয়েরী। দুর্নিবার আকর্ষনে আমিই চোখ ফিরাতে পারছিলাম না। নিটোল পিটানো শরীরের প্রতিটি খাঁজ সুস্পষ্ট। মেয়েটি ও সুন্দরী তবে,বয়সের তুলনায় বেশি পরিণত। বৌদি একমুখ হেসে বলল, “মোহনা,এই তোমার ছাত্রী। আজ থেকে আমি দায় মুক্ত,সব দায়িত্ব তোমার”। সেদিন দুপুরে ওখানেই খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যে বেলায় হোস্টেলে ফিরে এলাম। তার পর থেকেই মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘোরা-ফেরা করতে লাগল। বৌদির বয়স খুব বেশি হলে সাতাশ হবে। মৃণাল দা কে দেখে বুঝতেই পারিনি বৌদির বয়স এত কম হতে পারে! কম করে হলেও মৃণাল দা চল্লিশ-বিয়াল্লিশ তো হবেই। এত পার্থক্য? আমি যেন হিসাবটা মিলাতেই পারছলাম না।
[২]
প্রায় মাস খানেক ধরে তুতানকে পড়াচ্ছি। নন্দনা বৌদি কে দেখে ভীষণ একা মনে হতো আমার। যেন অনেক কথা বলতে চায়। আমি ওর ব্যক্তিগত গল্প শোনার আগ্রহ দেখেইনি কোনোদিন। ওকে কেমন যেন দুখী মনে হয়। প্রায় একমাস হল যাওয়া- আসা করছি,কখনও কারোর সাথে গল্প করতে দেখিনি। এখানেই শ্বশুর বাড়ি তবে সেখানে থাকে না। একদিন বৌদির মাকে দেখেছিলাম,তখনই শুনেছিলাম বৌদির বাপের বাড়ি ও এখানে। তুতানের পরীক্ষার পর একদিন রবিবার দেখে ওদের বাড়ি গেলাম। সেদিন আমি হঠাৎই গিয়েছি। দরজায় টোকা মারতেই একটা উজ্জ্বল বর্ণ,লম্বা লোক,মুখের সাথে মানিয়ে গোঁফ রয়েছে,এসে দরজা খুলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বৌদি দরজার কাছে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। বৌদিকে বেশ প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। আমি ভাবলাম বৌদির বাপের বাড়ির কেউ হবে বোধ হয়। মেয়েদের এমন হাসি তো বাপের বাড়ির লোক দেখলেই দেখা যায়।
লোকটা চলে যেতেই বৌদি বলল, ‘মোহনা,আজ হাতে সময় আছে তো? একটু বোসো না,গল্প করি’। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ বৌদি আমি হাতে সময় নিয়েই এসেছি’। বৌদি দু’কাপ চা নিয়ে এলো, আমরা খাটের উপর বসে আয়েশ করে চা খেতে খেতে গল্প করতে লাগলাম। ভাবছি কি ভাবে প্রসঙ্গে আসবো। অদ্ভূত ব্যাপার বৌদি কি করে আমার মনের কথাটা টের পেয়ে গেল যেন। বলল, ‘মৃণালদার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য দেখে অবাক হয়ে গেছো না? শুধু তুমি না,সবাই হয়। আমি ছাব্বিশ আর ও বিয়াল্লিশ’। আমি বললাম, ‘কি বলছো বৌদি ?এও সম্ভব?’ বৌদি বলল, ‘সম্ভব। জানো মোহনা,আমি বঞ্চিত,আমার এই বয়সেই আমি সব কিছু থেকে বঞ্চিত’। আমি কিছুক্ষণ নিরুত্তর থেকে বললাম---‘তোমার বাবা-মা ,তারা তোমার এমন বিয়ে দিলেন কেন? তুমি এত সুন্দরী তোমার তো আরও ভালো বিয়ে হত!’ বৌদি বলল,’ ‘এ দায় তো আমার নিজের। জানো এক সময় আমাকে তোমার দাদা কোলে নিয়ে ঘুরেছে,আজ আমি ওর স্ত্রী। বৌদি বলতে লাগল সে ইতিহাস-------
“তখন আমি চোদ্দ,সবে ঋতুমতী হয়েছি। শরীরে নারীত্বের লক্ষণ দেখে কেও বিশ্বাস করবে না আমার বয়স চোদ্দ বছর। শরীর যে কথাই বলুক মন তো অপরিণত। তোমার দাদার তখন তিরিশ বছর হবে। সবে ও মুদির দোকান টা খুলেছে। লেখাপড়া বেশিদূর করেনি। আমরা তখন একই পাড়ায় থাকতাম। আমি প্রায় ওর দোকানে এটা-ওটা কিনতে যেতাম। আমার বাবা ভালো একটা সরকারি চাকরি করতেন তখন।আমাকে ওর দোকানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলে ভীষণ রেগে যেতেন। সবে তখন যৌবনে পা দিচ্ছি,দোকানে গেলেই ও আমার দিকে এমন ভাবে তাকাতো যে আমার বুকটা কেমন যেন করত—মনটা ভালোলাগায় ভরে যেত। এক অমোঘ টানে ছুটে যেতাম। একদিন ও আমাকে বলল,দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে আমি যেন ওর সাথে দেখা করি। আমাকে ওর কিছু বলার আছে,যেটা শুনলে আমারও নাকি ভাল লাগবে। আমিও কথা মত কাজ করলাম। গ্রীষ্মের জ্বলন্ত দুপুরে রাস্তা-ঘাট শুন্য,চারিদিক খাঁ-খাঁ করছে। আমি এসে ওর দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। দোকানের এক দিকের শাটার নামানো ছিল। আমাকে দোকানের ভিতর ডেকে নিল। দুইহাত দিয়ে আমার মুখটা ধরে আমার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল—‘আমি তোকে খুব ভালবাসি,তোকে বিয়ে করে আমার বৌ করতে চায়’। কথাটা শুনে আমার কান,তারপর গোটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গরম হয়ে উঠল। আমি ওর হাত ছাড়িয়ে ছুটে পালালাম। সেই দিনই শেষ বারের মত ও আমাকে তুই বলেছিল। আমাদের সম্পর্কটা এইভাবে আরও ছ’মাস গেল। একদিন বাবার কাছে ধরা পরলাম। আমার বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল। আমি তখন প্রেমের জোয়ারে ভাসছি। বাড়ির সবাইকে আমার শত্রু মনে হত। নাবালিকা তাই,পালিয়ে বিয়ে করার উপায় নেই। ওর সাথে সম্পর্ক রাখবো না এই শর্তে আবার স্কুল যাওয়া শুরু করলাম।একদিন স্কুলে টিফিন টাইমে ও এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল ওদের ক্লাব ঘরে। বলল, ‘এমন একটা প্ল্যান বানিয়েছি যে,তোমার বাবা কেন,ঠাকুরদা ও বিয়ে দিতে বাধ্য হবে’। আমি বললাম, ‘কি করবো আমরা’? ও বলল, ‘আমরা দুজনে একটা খেলা খেলব’। সেইদিন ওই ক্লাব ঘরেই আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয়ে গেল আমার প্রথম পুরুষ সঙ্গ। বলতে পারো ভালোবাসার মানুষের কাছে আমি ধর্ষিত হলাম। ব্যাপারটা ওর বন্ধু-বান্ধব সবার সহায়তায় হয়েছিল। ওদেরই একজন চিঠি লিখে আমার বাবাকে সব জানিয়ে দিল। চিঠি পেয়ে বাড়ির সবাই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সবই ওদের প্ল্যান অনুযায়ী ঘটেছিল। ডাক্তারি পরীক্ষায় ঘটনার সত্যতা প্রমানিত হল। পাড়া-প্রতিবেশী,আত্মীয়-স্বজন সবার মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল। আমার বিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকল না।প রিস্থিতির চাপে কছুটা আমাকে শাস্তি দিতেই বাবা আমাদের বিয়েটা দিয়ে দিলেন। তবে কালিবাড়িতে।
আমি বললাম, ‘আর তোমার স্কুল’?
বৌদি বলল, ‘তখনকার মত বন্ধ’।আমার মনে তখন রঙীন স্বপ্ন। শ্বশুর বাড়িতে আমাকে কেউ ভালো চোখে দেখতনা। যেন যা ঘটেছে সবই আমি ঘটিয়েছি। সকলের বিতৃষ্ণায় জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল। আবার ফেলে আসা জীবনে ফিরে যেতে চাইছিলাম।স কলের অমতে আবার পড়া শুরু করলাম তবে শ্বশুর বাড়ি ছাড়তে হলো। মাধ্যমিকের রেজাল্টের আগেই তুতান হয়ে গেল।পড়া আর হলনা। প্রথমে ভাড়া বাড়ি,পরে বাবা এই বাড়িটা বানিয়ে দিল। এই বলেই বৌদি চুপ করে গেল,যেন আর এগোতে চায়লো না। আমার মনে হল এখন কিছু বাকি আছে।
[৩]
এরপর থেকে বৌদির সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা অনেক বেড়ে গেল। প্রতিদিনের ছোটো-খাটো ঘটনা,হাসি-ঠাট্টা সবই চলেতে লাগল। মাস ছয়েক পড়ানোর মাঝে আমি সেই লোকটাকে আরও কয়েক বার দেখেছিলাম। আমি এলেই সে বেরিয়ে যেত। কখন আসতো? কেন আসতো?—সে ব্যাপারে বৌদিও কখনও বলেনি,আমিও জিজ্ঞাসা করিনি। আমিও ভালোই ছিলাম কারণ,সুস্মিতা চলে যাওয়ার পর আমার কথা বলার লোকের অভাবটা বৌদি অনেকটা পূরণ করে ছিল। এরপর পূজোর ছুটিতে বাড়ি গেলাম,ফিরে এসে পড়াতে গেলাম তুতানকে।দেখলাম বৌদির চোখের তলায় ঘন কালো ছাপ,যেন চাঁদের গায়ে কলঙ্ক। সাতদিনে কারোর এমন চেহারা ভাবতেই পারছিলাম না। মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি মারতে লাগল। বৌদিকে এমনিতে বাড়িতে নাইটি বা চুরিদার পরতেই দেখেছি। সেদিন দেখালাম বৌদি একটা শাড়ি পড়েছে,আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে আমাকে চা দিতে এলো। ওদের একটাই ঘর। রান্না ঘরের সামনে সিঁড়ির নিচে একটা চৌকি পাতা ,সেখানেই আমি তুতানকে পড়াতাম। বৌদি বেশ চুপচাপ আমাকে চা দিয়েই রান্না ঘরে ঢুকে গেলো। আমার বসার জায়গা থেকে রান্না ঘরের ভিতরটা ভালই দেখা যায়। রান্না ঘরের কাজের মাঝে বৌদির আঁচলটা সরে গিয়ে পিঠের খোলা অংশটা দেখা যাচ্ছিল। সেদিকে চোখ যেতেই আমি চমকে উঠলাম,দেখলাম সাদা চামড়ার উপর মোটা মোটা কালো কালশিটের দাগ। বলেই ফেললাম, ‘এ মা!---বৌদি,কি হয়েছে তোমার? কাছে গিয়ে দেখলাম শুধু পিঠে নয়,গোটা গায়েই এমন দাগ রয়েছে। –বুঝতে পারলাম সব,মনে মনে ভাবলাম,এমন সুন্দর আদরের জিনিসকে কেউ এইভাবে মারতে পারে? বৌদির চোখের দিকে চেয়ে দেখলাম,পদ্মপাতায় জমা জলের মত স্বচ্ছ জলের ধারা চোখ থেকে গাল বেয়ে নেমে এসে বৌদির গোলাপী ঠোঁটের মাঝ মিশে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম, বললাম, ‘দাদা তোমাকে মেরেছে?---সুস্থ মস্তিস্কে?—নাকি তরলের প্রভাব?
বৌদি বলল, ‘রোজই খেয়ে বাড়ি আসে,রাতের খাবার গেলে আর শুয়ে পরে’। বৌদির কথার সুরে কেমন যেন একটা ঘৃণার সুর মিশে ছিল।আমি বৌদিকে নিয়ে ঘরে গিয়ে বসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম তুতান তখন কোথায় ছিল?
বোউদি বলল, ‘ঘুমাচ্ছিল’। কিছুক্ষন নিঃস্তব্ধতার পর বৌদি বলে উঠল “ মোহনা, আমি বলেছিলাম না আমি বঞ্চিত!---তোমার জানতে ইচ্ছা করছে না কি সেই বঞ্চনা? কেন আমার এই পরিণতি?
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ বৌদি ,আমি সব শুনবো’।
বৌদি শুরু করলো আরেক ইতিহাস-----‘ তুমি ত জানো মোহনা,মাধ্যমিকের পর আমি আর পড়িনি। আসলে তোমার দাদা আমাকে আর পড়তে দেয়নি,নিজের ইগো বুঝলে মোহনা। ওর পরিবারে আমিই একমাত্র মাধ্যমিক পাশ। কথায় কথায় শুধু বলতো,মেয়েছেলে বেশি পড়ে কি করবে? কাজ তো দুটো—সংসার সামলানো আর স্বামীকে বিছানায় সঙ্গ দেওয়া’।
আমি বললাম, ছি! এত নিচ?
বৌদি বলল, ‘ওর এমনি চিন্তাধারা,বিয়ের পর প্রথম ক’মাস বুঝতেই পারিনি কি ভুল করেছি। তখন সব সুন্দর। ওর কদর্য রূপটা প্রকাশ পেল তুতান যখন পেটে। ডাক্তারের নির্দেশে আমাদের সংযত জীবন যাপন করতে হত তখন। ও সে নিষেধ মানতে চায়তো না। তিরিশের যুবক। শরীরের উথাল-পাথাল নিয়ন্ত্রন করার মত শিক্ষা ও মানসিকতা কোনোটায় ওর ছিলনা। তখনই প্রথম আমার ভুল ভাঙলো,বুঝলাম ও আমার মন নয়,শরীরটাকে ভালোবেসেছে। সব সময় সন্দেহ,আমাকে কারোর সাথে মিশতে দিতে চায়তো না। কখনও আমাকে নিয়ে রাস্তায় বেরোয়নি। সারাদিন বাইরে। আমাকে শুধু ওর দরকার পড়তো রাতে বিছানায়। সামান্য কারনেই মারতো,জামা-কাপড় টেনে-ছিঁড়ে খুলে দিত। এখনও সে স্বভাব যায়নি। ওর যত বয়স বারতে লাগল,আমার প্রতি ওর আকর্ষন ও কমতে লাগল আর বেড়ে চললো সন্দেহ প্রবনতা।আমার তখন যৌবনের তাড়না,প্রতি রাতের উপেক্ষা,অতৃপ্তি যেন আমাকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। আমি শুকনো খড়-কুটোর মতো অপেক্ষা করছিলাম,জ্বলন্ত আগুনের গোলার জন্য।একদিন পেয়েও গেলাম।
আমি বৌদিকে থামিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, ঐ কি সে,আমি এলেই যে বেরিয়ে যেত? বৌদি উত্তর দিল ‘ হ্যাঁ’। একদিন পাড়ার এক বিয়ে বাড়িতে ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়,ও আমাকে চিনতো।এতক্ষণে বৌদির মুখটা বেশ চকচকে হয়ে উঠলো বলল, জানতো মোহনা,আমাদের দুজনের জীবনের মধ্যে অনেক মিল আছে। বাড়িতে ওর বৌ আর একটা ছোট্ট ছেলে আছে। আমি চমকে উঠে বললাম, ‘সে কি! তবুও লোকটা তোমার কাছে আসে’?
বৌদি বলল,ওর জীবনটাও সুখের নয় জানো। ওদেরও লাভ ম্যারেজ,বিয়ের আগে কি করে জানবে বলো ওর বৌ বিছানায় এত ঠান্ডা? তুহিনার আবার তোমার দাদার মত সন্দেহ বাতিক আছে। সুনয়ের পিছনে লোক লাগিয়েছে। জানো,ও সবসময় বলে ওর সব শান্তি নাকি আমার কাছে এসে।
আমি বললাম, ‘বৌদি ,তুমি যা করছো ভেবেচিন্তে করছতো?
বৌদি বলল, ‘আমার আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই মোহনা,আমি ওকে বিয়ে করেছি। আমরা প্রথমবার মিলিত হওয়ার আগে কালি ঘাটে গিয়ে বিয়ে করেছি’।
আমি বললাম, ‘যদি ধরা পরে যাও’?
বৌদি বলল, ‘সে ভয় যে নেই তা নয়,তবে সুনয় বলেছে,তেমন কিছু হলে ও আমাকে আর তুতানকে ওর ইন্দ্রপ্রস্থের বাড়িতে রাখবে। মাঝে মাঝে ভাবি ও না থাকলে আমি এতদিনে পাগোল হয়ে যেতাম’। এত দিন কিছু না কিরেই মার খেয়েছি,এবার না হয় করেই খেলাম। দু’বছর ধরে তো এমন ভাবেই চলছে’।
[৪]
কারণটা যতই করুণ হোক বৌদির এই পরকীয়া আমি মন থেকে মানতে পারলাম না। আগের থেকে মেলামেশাটা অনেক কমিয়ে দিলাম,অবশ্য বৌদির ও সময় ছিল না। আমি পড়াতে গেলেই বোউদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত পরকীয়া করতে। কখন ফিরত জানি না ,আমার পড়ানো হয়ে গেলে ,তুতান দরজা আটকে দিলে আমি চলে আসতাম। একদিন তুতান বলল। ‘জানো মোহনা পিসি,আমার নতুন বাবা না ভীষণ দুষ্টু লোক,যে দিন মা বাড়িতে না থাকার সময় আসে, সেদিন আমাকে খালি জোড়িয়ে ধরে আর আমার গায়ের যেখানে সেখানে হাত দেয়’।আমি বললাম, ‘মা কে বলেছো’?
তুতান মাথা নেড়ে বলে, ‘ না, মা যদি বকে’? পরের দিন আমি সুযোগে ছিলাম, বৌদি কে তুতানের কথাটা জানাবো। সেইদিন বৌদির কাছে ঐ লোকটির সম্পর্কে একটি হতচকিত হওয়ার মত গল্প শুনলাম। লোকটি নাকি বৌদির কাছে স্বীকার করেছে সে একজন “রেপিস্ট”। সে নাকি তার ধর্ষনের বিবরণও দিয়েছে। এ কাজে তার আরও সহযোগিও নাকি আছে। বর্ণণা শুনে আমার স্মৃতির গোড়ায় নাড়া লাগলো। মনে পরে গেল পাঁচ-ছয় বছর আগের সেই ঘটনার কথা,যে ঘটনা আজও ফাইল বন্দী,কোনো অপরাধীই ধরা পরেনি।
আমি ভীষণ বিতৃষ্ণা নিয়ে বললাম, ‘এত কিছু জানার পর ও তুমি লোকটাকে ধরিয়ে না দিয়ে,ওর সাথে মিশছো’?
বৌদি বলল, ‘আমি নিরুপায়,এত চেষ্টা করেও বেরিয়ে আসতে পারছিনা’। আমি জোড় দিয়ে বললাম, ‘আসতেই হবে বৌদি,তা না হলে তোমার মেয়েও রক্ষা পাবে না’ বলেই তুতানের কথা গুলো বলে দিলাম। সামনেই তুতানের পরীক্ষা ছিল। ওর পরীক্ষার পরই আমি পড়ানো ছেড়ে দিলাম। বৌদি কারণটা বুঝতে পেরেছিল হয়ত,কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। মাঝে মাঝে তুতানের জন্য মন খারাপ করলে দেখা করতে যেতাম।এর মাঝে একদিন তুতানের জন্মদিনে গিয়ে দেখলাম বৌদির মুখটা কেমন যেন শুকনো। মেয়েলি কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি অভিসার কেমন চলছে’?
বৌদি বলল, ‘তোমার কথায় ঠিক মোহনা,আমার মেয়ের দিকেও ওর দৃষ্টি পড়েছিল। আমি প্রায় একমাস হল ওর সাথে কোনো যোগাযোগ রাখছি না’।
এরমধ্যে আমারও এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হল,আমার ঘরের রাস্তার দিকের জানালাটার সামনে একটা গাছ ছিল,রোজ রাত দশটা বাজলেই একটা লোক এসে ওখানে দাঁড়িয়ে ‘মধুমিতা’ বলে চিৎকার করে কাকে যেন ডাকতো। সব থেকে আশ্চর্য্যের ব্যাপার হল আমাদের হোস্টেলে মধুমিতা নামের কেউ ছিল না।এ মনি একদিন,বোধহয় নভেম্বরের শেষ হবে,দেখলাম লোকটা বাইক চালিয়ে এসে গাছটার নিচে দাঁড়ালো,তারপর আমার জানালার দিকে তাকিয়ে মধুমিতা বলে ইশারায় হাত নেড়ে আমাকে ডাকলো। আমি ভয় পেয়ে ধপাস করে জানালাটা লাগিয়ে দিলাম। মিনিট দশেক পর আমাদের ভিজিটার্স রুম থাকে আমাকে ডাকা হলো গেস্ট এসেছে বলে। এতগুলো বছর এখানে আছি কখনও আমার গেস্ট আসেনি,আমি অবাক হলাম। এত রাতে আমাদের হোস্টেলে গেস্টের সাথে দেখা করতে দেয় না। আমি ভয়ে ভয়ে নিচে নেমে এলাম,দেখলাম ভিতরে কেউ নেই। ম্যানেজার কাকু বললেন, ‘তাড়াতাড়ি কথা বলে নাও,বেশি সময় দিতে পারবনা এত রাতে’।আমি গেটের কাছে এসে দেখলাম,এক দীর্ঘাকায় ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে চিনতে না পেরে বললাম, ‘আপনি কি আমাকে খুঁজছেন’?লোকটার পিছনের দিকে রাস্তার আলোটা জ্বলছিল তাই মুখটা দেখতে পারছিলাম না। লোকটা এগিয়ে এসে খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরে বলল, ‘হ্যাঁ মধুমিতা’।
আমি চমকে উঠে বললাম, ‘আপনি ভুল করছেন,আমি মধুমিতা নই। আমার নাম বলতেই লোকাটা আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারলো।আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে ধাক্কা মারলাম লোকটার গায়ে।লোকটা সরে যেতেই আলোটা ওর মুখে পরলো,আমি আঁতকে উঠলাম।বললাম, ‘আপনি সুনয় বাবু না? আপনি এখানে এসেছেন কেন?---দেখলাম লোকটা আকন্ঠ মদ্যপান করে এসেছে। ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। লোকটা আবার খপ করে আমার হাতটা ধরলো। আমি ভাবতেই পারছিনা যে,আমি তখন একটা ধর্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে ।এই লোকটা তাদের মধ্যে একজন যারা প্রায় বছর ছয়েক আগে সুতির মাঠের ওখানে বৌটাকে পশুর মত অত্যাচার করে মেরে ফেলেছিল। ঘৃণায় হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা চালাতে লাগলাম,সে বলল, ‘প্লি-ই-ই-জ মধুমিতা আমার একটা কথা শোনো,আমাকে নন্দনা ছেড়ে দিয়েছে’। আমি টান মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। সে আবার বলল, ‘মধুমিতা,তুমি কিছু করো প্লি-ই-জ’।
আমি বললাম, ‘বেরিয়ে যান বলছি,আর কখনও এত সাহস দেখাবেন না’। বলেই ছুটে ঘরে ফিরে এলাম। ক্ষণিকের বিভীষিকায় সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। হাত দুটোকে বার বার সাবান দিয়ে ধুয়েও শান্তি হচ্ছিলো না। বারবার মনে হচ্ছিলো একটা ধর্ষক আমার হাত দুটো ছুঁয়েছে। আমার মনের এই যন্ত্রাণা আমি কাউকে বলতে পারছিলাম না। একটা দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে আমার যা করা উচিত ছিল আমি তা করতে পারছিলাম না। নিজের চোখেই নিজে ছোটো হয়ে যাচ্ছিলাম। একটা ধর্ষক—নরকের কিট আমার চোখের সামনে ঘুরে বেরাচ্ছে অথচ আমি কিছু করতে পারছিনা। আসলে আমার করারই বা কি ছিল? তখন সমাজ এত জাগরিত ছিল না। একেই আমি বাইরে থেকে আসা একা একটা মেয়ে তার উপর সে যে ধর্ষক এমন কোনো বলিষ্ঠ প্রমান ও আমার হাতে ছিল না। ছয় বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ধর্ষন কান্ডের নায়ক প্রমানের অভাবে এভাবে দর্পে ঘুরে বেরাবে সেটা অসহনীয় হলেও সহ্য করা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না আমার কাছে।কোনো এক ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে নন্দনা বৌদির কাছে করা স্বীকারক্তীর কোনো মূল্য নেই আইনের চোখে। বহরমপুরে আর মন টিকছিল না,স্কুলের পরীক্ষা হয়ে গেলে ইস্থফা দিয়ে বাড়ি ফিরে যাব ভাবছি।এমনি এক দিনে এক রাজনৈতিক দল নিজেদের দাবি পূরণের জন্য বারো ঘন্টার বন্ধ ডাকলো। স্কুল ছুটি,দেরী করে ঘুম থেকে উঠলাম,ভাবছি চা টা খেয়ে একবার নন্দনা বৌদির বাড়ি যাব,সেদিন রাতের ঘটনাটা জানিয়ে সাবধান করে আসবো।এ মন সময় পেপার কাকু এসে পেপার দিয়ে গেলো। প্রথম পাতায় চোখ বোলাচ্ছি।ঠিক একেবারে নিচের ডান দিকে গিয়ে চোখটা স্থির হয়ে গেল।
নিজস্ব সংবাদদাতা,১৯শে ডিসেম্বর,বহরমপুরঃ আবার একটি নারকীয় ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল বহরমপুর শহর। প্রায় বছর ছয় আগে সুতির মাঠে ঘটে যাওয়া ধর্ষনের ঘটনাকে উসকে দিল এই ঘটনা। প্রাথমিক তদন্তে মনে করা হচ্ছে এটিও গনধর্ষন কান্ড।এক্ষেত্রও মহিলাকে ধর্ষন করে খুন করা হয়। মৃত দেহের চারপাশে ছড়ানো পোড়া কাঠি,খালি দেশলাই বাক্স। মৃতদেহের শরীরে পোড়া চিহ্ন রয়েছে। বারবার একই ঘটনা ঘটায় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।পূ র্বের ঘটনার আসামীরা এখনও অধরা ।মহিলার স্বামী ও কণ্যা দেহ সনাক্ত করেছে।মহিলার বাড়ি গোরাবাজার,নিমতলা।এতদূর পঞ্চাননতলায় মহিলা কেন এবং কার সাথে এসেছিল,পুলিশ সে ব্যাপারে এখনো অন্ধকারে।
খবরটা পড়ে আমি চমকে উঠলাম। চায়ের কাপটা রেখেই বেরিয়ে পড়লাম নন্দনা বৌদির সাথে দেখা করতে। গিয়ে দেখলাম বাড়ির দরজায় তালা ঝুলছে। আমকে দেখেই তুতান কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। পাশের বাড়ির বৌদির কাছে শুনলাম মৃণালদা থানায় গিয়েছে। দেহ শনাক্ত করার পর থানার কাজ মিটিয়ে , ওখান থেকেই শ্মশানে যাবে।

পরিচিতি
রুমকি রায় দত্ত
Reviewed by Pd
on
মার্চ ২৬, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
মার্চ ২৬, ২০১৫
Rating:

অসাধারন এক লেখা। সমাজের অবক্ষয়ের একটা দিক খুব সুন্দরভাবে প্রকাশিত মর্মস্পর্শী এই লেখার মাধ্যমে। ঘটনার বর্ণনা ও তার চিত্রায়ন খুব ভালো লেগেছে।
উত্তরমুছুন