সংস্কৃত ব্যকরণে মধ্যমপুরুষ একবচনের এই ‘ত্বম’ সর্বনাম আমাদের জ্ঞান উন্মোচনের পর থেকেই জানা হয়ে যায়। শিশুটি যখন মাতৃ গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয় এবং তারস্বরে কাঁদতে থাকে সম্ভবত তখনই সে কারো কাছ থেকে কিছু চায় বা কাউকে তার অনুযোগ জানায়। অর্থাৎ গর্ভে থাকার সময় সে নিশ্চিত ছিল কারণ তার সত্ত্বা মায়ের সত্ত্বার সঙ্গে এক হয়েছিল। তাই তার প্রয়োজন অপ্রয়োজন নিয়ে তার ভাবতে হয় নি। একা পড়ে যাবার পর থেকেই সে টের পায় সে এক আর অন্য কেউ আর এক... অর্থাৎ তুমি। এর পর শুরু হয় জীবন ব্যপী সেই তুমি র সঙ্গে সম্পর্ক। জীবনের কোন পর্যায়েই না আমরা তুমি কে আঁকড়ে ধরি? শুধু এই ‘তুমি’টির শরীর বদলে যায় বয়স বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে। ছোট্ট শিশুর কাছে খিদে পেলে ‘মা’ হয়ে যায় ‘তুমি’। মা তুমি আমায় খেতে দাও। মা আমার কষ্ট হচ্ছে তুমি আমার ব্যথা দূর করে দাও। মা আজ ইস্কুলে আন্টি আমায় ভেরি গুড দিয়েছে। মা এই হোম ওয়ার্কটা বলে দাও না। মা আমার পেট ব্যথা করছে, আজ স্কুলে যাবো না।
একটু বড় হলে বাবা-ও ‘তুমি’ –র তালিকায় যোগ হয়ে যায়। তখন সামার ভেকেশনে দিঘা না গিয়ে কুলু কাশ্মীর যাবার বায়নাটা ওনার কাছেই করতে হয় কি না! তবে এই সময় সীমায়ও মা নামক ‘তুমি’ কে ছাড়া যায় না। তখন সুবিধা বিশেষে তুমি শিফট হতে থাকে ঘনঘন। বিশেষ করে পরীক্ষার দিনগুলি বিপজ্জনক। অনেকটা সোয়াইন ফ্লু-র জীবানুর মত কঠিন। মানে ভয় আছে আর সেটি অন্যে পাচ্ছে এবং কখন সেটি আমাকেও আক্রমণ করে বসে সেই আশঙ্কায় ভয়ে থাকা আর কি। তখন রাত জাগলে হরলিক্সের গ্লাসে মা তুমি এখনো জেগে? আর পরীক্ষার হলে যাবার স্কুটারে বাবাকে আঁকড়ে ধরে বাবা তুমি তাড়াতাড়ি চালাও আমার দেরী হয়ে যাবে তো। আসলে তুমি-র কাছে চাওয়া আমাদের জীবনভোর চেনা অভ্যাস।
কিছুটা ছবি আলাদা হতে থাকে আমাদের যৌবন এলে। ওরম তাকিয়ো না আমি ক্যাবলা হয়ে যাই কেস দিয়ে শুরু। তখন তুমি কী সুন্দর। তোমাকে না দেখে মন কেমন করে। কিংবা তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর। তারপর তো টক মিষ্টি ঝাল কম্বিনেশনে জীবন চানাচুরের মত তুমি ময়। কেবল আমি তুমি র যৌথ উদ্যোগে যে সন্তান নামক বস্তুটি লাভ হয় তুমি ঠাকরুন তখনো কেস ডিফারেন্ট। আমার চোট্ট ছোনা তুমি কাল মতো দেখতে বাপী না মামনি? আর এরপর বেশ কিছুদিন তুমির জিরিয়ে নেওয়া। তখন আমি আমার কাল। আমার মত দেখতে। বড় হলে আমার মত ডাক্তার মোক্তার হবে। হবে না এত ইন্টেলিজেন্ট? কার ছেলে দেখতে হবে তো!...আমার। কিন্তু অপত্য যখন মন্দ কাজ মন্দ রেজাল্ট করে? তাহলেই আবার তুমি-র আগমন। তুমি ছেলে কে দেখবে না তো ছেলে অমন ই করবে পরীক্ষায়। তুই আমার নাম ডোবালি। যেমন মা তেমনি মেয়ে। তুমি যদি মেয়ের জন্য একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরতে এই অবস্থা হতো না ওর।
ছেলেমেয়ে ঝঞ্ঝাট কি না জানা নেই কিন্তু পরীক্ষার আসর তো বটেই। তারা কথায় কথায় খোঁটা দেবে তুমি র সঙ্গে আমি র গন্ডগোল লাগলেই। তখন সে এক চিত্তির। তুমি ওকে একটা ঠিকঠাক কেরিয়ার গড়ে দিতে পারছ না? তুমি বাপ হয়ে কি করলে? তুমি পারোও। এই ছেলেটিকে অ্যালাও করলে মেয়ের জামাই হিসেবে? কী করব? তোমার গোঁয়ার মেয়েটি কি আমার কথা শুনবার পাত্রী? ইত্যাদি তুমি অভিযোগে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। এই সব তুমি আমি র কথা কাটাকাটি কিন্তু নতুন করে আরও তুমি-তে গড়ায় পুত্রকন্যার বিবাহ চাকরি ইত্যাদি নির্ণীত হলে। তখন একলা প্রৌঢ় জীবনে তুমি কে আরও নতুন করে পাবার চেষ্টা। তোমার মনে আছে অমুক সালে আমরা পুরী তে যাবার পরে কী কান্ডই না হয়েছিল? তুমি এখনো কিন্তু এক রকম অ্যাট্রাকটিভ আছো। দেখো বুড়ো বয়সে দুম করে কেউ প্রেম এ না পড়ে যায়। শোনো বুড়িয়ে যাওয়াটা কাজের কথা না। চলো তোমার বহুদিনের সাধ ফরেন ট্রিপ করবে। যা টাকা জমিয়েছি তার থেকে নিয়ে তোমায় ব্যাংকক পাট্টায়া কিংবা ঘরের কাছে ভূটান ঘোরানো যাবে। কি বললে? বাংলাদেশ? আরে ছোঃ ওটা যেতে আবার ডলার লাগে না কি? তোমায় ডলার খরচ করে বেড়াতে নেবো আমার সারা জীবনের সাধ। তুমি র শেষ বেলার আতিশয্যে শান্তিপুর ডুবুডুবু নদে ভেসে যায় আর কি!
অতঃপর সেই অমোঘ সময় যখন মানুষ হিসাব মেলাতে বসে জীবনের কজনার সেই বুকের পাটা থাকে যে বলবে কী পাইনি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি। সেই খানে তার প্রথম ইচ্ছে হয় মেঘের আড়ালে থাকা মেঘনাদের মত ঠাকুর দেবতাকে ভজনা করা। হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো / পার করো আমারে...। যথা সময়ে কোনো গুরু ধরে তার থেকে দীক্ষা গ্রহণ করে হে ঠাকুর আমায় বাঁচাও। ঠাকুর সবাইকে ভালো রেখো তুমি। হে মধুসূদন হে মা কালী আমায় রক্ষা করো মাগো। মা তুমি শেষের কালে সঙ্গে থেকো...। হে মরণ তুমিই আমার শ্যামের মতন। শারীরিক তুমি থেকে তুমি-র পরিবর্তন হয় অ্যাবস্ট্রাক্ট বিষয়- ‘মৃত্যু’ তে।
একমাত্র প্রাণবায়ু বের হলে পরে আমার আত্মা তোমার আত্মা সেই পরমাত্মার সাথে যুক্ত হলে তুমি মুছে যায় অবশেষে। শ্রীরামকৃষ্ণের সেই গল্পের ধুনুরীর মত। যতক্ষণ না সংসার জালে রগড়ানি খাচ্ছি ততক্ষণ শিং খাড়া। আর সংসার চাপে ত্রাহি ত্রাহি রব হলেই ধুনুরির পেঁজা তুলোর মত টঙ কার ধ্বনি ওঠে – নাহং নাহং তুঁহু তুঁহু।
তুমি নিয়ে এতক্ষণ ঢের কথা হলো। এরপর পাঠক না ক্ষেপে উঠে বলে – এবার থামো। নইলে আমরা গান গাইব তুমি রবে নীরবে ... । তাই তার আগেই ভালোয় ভালোয় এ তল্লাট ছেড়ে শর্মা- র বিদায় হওয়াই ভালো। ভালো থাকবেন গো বাবুসকল তুমরা... আজ আসি? পেন্নাম।।
![]() |
| পরিচিতি |
জয়া চৌধুরী
Reviewed by Pd
on
মার্চ ২৬, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
মার্চ ২৬, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন