মৌসুমী মিত্র (বৈদ্য)



অকাল বৃষ্টির রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় এনাক্ষীর  অর্থাৎ এনা-র ৷ কাঁচের জানালায় বিদ্যুতের ঝলকানি ৷  মেঘের গুরুগুরু শব্দ ৷ জানালাটাও মাঝে মাঝে বেশ কেঁপে উঠছে ৷ বেশ ভয় পায় এনা ৷ বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে  বালিশে মুখ গুঁজে ফেলে ৷ বরাবরই এনার বাজের শব্দে ভয় ৷ সেই ছোট্টবেলা থেকে ৷ অথচ এই এনার ডানপিটে মেয়ে বলে নামডাকও ছিল বেশ ৷ 
     
বালিশে মুখ গুঁজেই এনা হাত বাড়িয়ে পাশে কাকে যেন ছুঁতে যায় ৷ কিন্তু কাকে ছোঁবে এনা ? কেউ তো নেই পাশে ৷ বিছানায় সে একা ৷ শুধু বিছানা কেন , সারাটা বাড়িতেই সে একা ৷ সারা দুনিয়াতেই সে একা ৷ কেউ নেই যাকে সে আঁকড়ে ধরে বাকী জীবন বাঁচার স্বপ্ন দেখবে ৷ তবু তাকে বেঁচে থাকতে হবে , বয়ে চলতে হবে সবে চল্লিশ পার করা অর্থহীন জীবনের ভার ৷ অথচ একদিন সবাই ছিল ৷ পাঁচ দাদার একমাত্র আদুরে বোন এনা ৷ বাবা মাকে খুব ছোট বয়সেই হারিয়েছিল ঠিকই , কিন্তু তাঁদের না থাকার অভাব তাকে বুঝতে দেয়নি দাদারা ৷ তাই হেসে
খেলে পাড়া মাতিয়ে দিন কাটিয়েছে ৷ থাকত মফস্বলে ৷ গাছগাছালির অভাব ছিল না , বলতে গেলে গাছেগাছেই দিন কাটত ৷ পাড়া প্রতিবেশী ভাবত এইরকম ডানপিটে মেয়েটার বিয়ে হবে কি করে ! তাই আঠেরো পূর্ণ হতেই দাদারা সিদ্ধান্ত নিল এনার বিয়ে দেওয়ার ৷ 

খোঁজ শুরু হল পাত্রের ৷ পাঁচ দাদাই উঠে পড়ে লাগল  পাত্র খুঁজতে ৷ এনা যে খুব সুন্দরী ছিল তা তো নয় , তার  ওপর পড়াশোনাতে মন ছিল না ৷ তাই পাত্র যারা আসে  তাদের ঠিক এনাকে পছন্দ হয়না ৷ আবার যাদের এনাকে  পছন্দ হয় তাদেরকে কোন না কোন ছুতোয় এনা বাতিল করে দেয় ৷ একবার তো এক পাত্রপক্ষ খবর না দিয়েই চলে আসে দেখতে এনাকে ৷ এনা তখন একদল ছেলেমেয়ের  সাথে কিৎকিৎ খেলছিল গলির মুখে ৷ ওদের কথাবার্তায় এনা বুঝে যায় ওরা কারা এবং কি কারণে ওরা এসেছে ৷

এনা দেখে ওদের মধ্যে একটিই অল্পবয়সী ছেলে আছে ,  বেশ কালো তার গায়ের রং ৷ এনা টুক করে হাতের গুটি ছেলেটার দিকে ছুঁড়ে আসতে করে বলে "কেল্টুর খুব বিয়ে করার শখ হয়েছে "৷ যদিও ছেলেটি বা তার দলের অন্য কেউ ঘুরেও তাকায়নি ৷ তাতে এনা বুঝে নেয় যে ওরা কিছু শোনেনি ৷ সে যাত্রায় অন্য কোন অজানা কারনে বিয়েটা হয়নি ৷ যথারীতি এইভাবেই দিন এগোতে থাকে ৷ এনার বয়সও বেড়ে চলে ৷ একের পর এক পাত্র কোন না কোন কারণে ফিরে যায় ৷ এনাও অবিবাহিতা রয়ে যায় ৷

দাদারাও একে একে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন ৷ ভাইপো ভাইঝিরা বড়ো হয়ে উঠেছে ৷ ওদের হাতে তাই সংসারের চাবিকাঠি ৷ পিসি অবিবাহিতা থাকায় ওরাও বিয়ে করতে পারছে না ৷ এনার ওপর বেশ অসন্তুষ্ট ওরা বোঝাই যায় ৷ এনাই বা কি করে ! দেখতে দেখতে তারও
তো প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই ৷ রূপ যেটুকু ছিল সেটুকুও যাই যাই করছে ৷ 

একদিন সকালে বড়ো ভাইপো বেঁকে বসল ৷ বলে , "ঢের হল , আর নয় ৷ এবার যেই পাত্র পাব , পিসিকে বিয়ে দেব ৷ পিসি যদি আপত্তি করে তো একদম বেনারসে পাঠিয়ে দেব ৷" এনা স্থির করল সেও তাইই করবে ৷ যে আসবে তাকেই বিয়ে করবে ৷ যথাসময় উপস্থিত ৷ পাত্র 
এল , কথাবার্তা পাকা হল ৷ বিয়েও হয়ে গেল ৷ এনা কোন শব্দটি করল না ৷ বাসররাতে প্রথম কথা বলেছিল তার স্বামীর সাথে ৷ অবশ্য এনা নয় , প্রথম কথাটি এনার স্বামী বলেছিল ৷ এমন একটি কথা বলেছিলেন তিনি যা মনে পড়লে আজও শিউরে ওঠে এনা ৷ ভাবে , "এমনও হয় !"

মাত্র তিনটি মাস ৷ খুব সুখে ছিল এনা ৷ ভীষণ ভালো স্বামী পেয়ে এনা তার ফেলে আসা অতীত ভুলে গেছিল ৷ তাছাড়া পিসিকে ঘাড় থেকে নামাতে পেরে ভাইপো ও ভাইঝিরা আর কোন যোগাযোগ রাখেনি ৷ অপমানিত এনাও আর ফিরে তাকায়নি ওদিকে ৷ কিন্তু এত সুখ সইবে কেন ? তিনমাসের মাথায় এনার স্বামীর লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ল ৷ ডাক্তার জানিয়ে দিলেন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই ৷ টাকাপয়সার কোন অভাব না থাকা সত্ত্বেও তিন মাসের মাথায় শেষ হয়ে গেল এনার সুখের সংসার ৷ 

এনা আজ একা ৷ স্বামীর তৈরী বাড়িতেই আজ সে কাশীবাসি হয়ে দিন কাটাচ্ছে ৷ দমবন্ধ এই জীবন আরও কতদিন এই ভাবে কাটবে এনা জানে না ৷ সঙ্গী বলতে তার ছয় মাসের স্মৃতি ৷ চোখ বন্ধ করলে আজও কানে বাজে বাসরঘরে সেই রাতে এনার স্বামীর বলা সেই কথা , " চিনতে পারছ এনাক্ষী , বাইশ বছর আগের তোমার সেই ঢিল মারা কেল্টুকে ? যে সেদিন ফিরে গিয়েও আজ কিন্তু আবার ফিরে এসেছে "৷ এনাক্ষী লজ্জায় স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে বলেছিল ,"এমনও হয় ?" ৷ মনে মনে বলল , "শুধু জীবন থেকে হারিয়ে গেল মাঝের কুড়িটি বছর" ৷

পরিচিতি 
মৌসুমী মিত্র (বৈদ্য) মৌসুমী মিত্র (বৈদ্য) Reviewed by Pd on মার্চ ২৬, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.