তাপসকিরণ রায়




অন্ধ থেকে অন্ধকার হলে, গন্ধ থেকে গন্ধকার হতে পারে না কি ? রমাকান্ত কম কথা বলার লোক। যারা কম কথা বলেন, তাঁরা মনে মনে নাকি বেশী কথা বলেন। শুদ্ধ অশুদ্ধ যাচাই করতে গিয়ে অযথা কোন্দল বাড়িয়ে লাভ কি ? তার চে তর্কবাজের সাথে তর্ক না করে তাকে মনে মনে কিছু গালি গিয়ে ক্ষান্ত হওয়াই যুক্তিবাদ। এক পণ্ডিত ব্যক্তি ফুলের সঙ্গে মানুষের তুলনা করতে গিয়ে সে কি তুমুল তর্ক বিতর্ক বাধালেন। মাঝখানে পড়ে রমাকান্ত বলে ছিলেন, হ্যাঁ, ফুলের সাথে মানুষের তুলনা করা যেতেই পারে। ব্যাস, সেই কোন্দল সৃষ্টি, কথা না বাড়িয়ে মানে মানে কেটে পড়ে ছিলেন রমাকান্ত। 

আসলে ফুলের সঙ্গে নারীর তুলনা হতেই পারে, ঘরে এসে রমাকান্ত সেটাই মনে মনে বিশ্লেষণ করছিলেন। ফুলের সৌন্দর্য আছে, নারী সুন্দর। ফুলের গন্ধ আছে, নারীর প্রসাধনী গন্ধ। ফুলের মধ্যে কেউ বেশী সুন্দর, নারীর মধ্যেও এই বেশী কমের মাত্রা বর্তমান।   

আহা, লোকে ফুল কেন ভালোবাসে ? রঙ্গিন ফুল তো আছেই এছাড়া--রাত কি রানী, বলে একটা ফুল আছে, রাতে ফোটে আর উগ্র ও মিষ্টি গন্ধ বিলায়। ম ম গন্ধে মাতোয়ারা করে তোলে সমস্ত মহল্লা ! রাতের অন্ধকারে সে ফুল তো দেখা নাও যেতে পারে, তার মানে অদৃশ্য গন্ধও ভালবাসার ইন্ধন যোগাতে পারে ? পাখি দির কথা মনে পড়ল রমাকান্তর। মেয়ে মানেই সুশ্রী এমনটা নয়, পাখি দিকে বিশ্রী না বললেও সুশ্রী  বলা যাবে না। বয়সে রমাকান্তর চে অন্তত বছর পনের বড় ছিল। চেহারা বেশ কালো। ফুলের সঙ্গে তুলনা না হলেও মেয়ে বলে কথা। শাড়ি পরা লম্বা চুলের ধরন ধারণ মেয়েলী সাজ সজ্জা বুঝিয়ে দিত পাখি দি একটা মেয়ে--স্ত্রী জাতির অন্তর্গত। 

রমাকান্ত বোধের চোখ খুলেই দেখলেন, রঙ্গিন ফুল, রং পোশাকের মেয়েদের। তখনও তাঁর কৈশোর ছাড়ায় নি, যৌবন সীমারেখার উথলপাথল টগবগে ভালবাসার ভাণ্ড ভরে ওঠে নি। মেয়েদের দেখলে মন চনমন করে উঠত না—আকাঙ্ক্ষার গভীরতা ছিল না, নিরপেক্ষ ভাবনা ছিল, কিন্তু মন্থন ছিল না। ঠিক এমনি দিনে পাখি দির সাথে রমাকান্তর আলাপ। 
--খোকা, তোমার নাম কি?
তখন ভালবাসার চোখ ফোটে নি রমাকান্তর। নাক ছুঁইয়ে গোলাপের গন্ধ নিতে শেখেন নি। আহা, কি সুন্দর এই ফুলদল ! তবু তিনি আবিষ্কার করলেন, মেয়েদেরও ফুলের মত সুন্দর লাগে। অনেকটা কোমল গোলাপের মত তুলতুলে, আর গন্ধ ওদের সাজগোজ থেকেও তো পাওয়া যায়। কিন্তু পাখি দি? তাকে কোন পর্যায়ে ফেলা যাবে? মেয়ে তো বটেই কিন্তু ফুল ? ফুল বলা যাবে কি ? খানিকটা গবেষণার বিষয় বটে। তারপর অনেক ভেবে চিনতে রমাকান্ত দেখলেন, মেয়েদের মত পাখি দি শাড়ি পরে। তার চুল কালো ও লম্বা। তাতে রঙ্গের ফিতে বাঁধা থাকে। চোখগুলি দেখতে মন্দ নয়, তাকাবার ঢং মেয়েলি। চেহারায় তৈলাক্ত ভাব আছে। সর্বোপরি চলন বলনও মেয়েলি। অতএব পাখি দি মেয়ে। একবার রমাকান্ত বাগানের একটা গোলাপ কড়া রোদে ঝলসে যেতে দেখেছেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে ছিলেন, ফুল যদি এমনটা হতে পারে তবে পাখি দি মেয়ে হবে না কেন ? আর গন্ধ সেটাও তো তার শরীরে পাওয়া যায়!  
--খোকা তোমার নাম কি ? পাখি দির রমাকান্তর প্রতি প্রথম পরিচয়ের প্রশ্ন ছিল। 
তের বছরের রমাকান্ত সংযমের সঙ্গে বলে ছিল, রমাকান্ত-- 
--বাবা, খুব লম্বা চওড়া নাম তো?
কিছু বলার ছিল না রমাকান্তর। 
--তোমায় যদি রামু, বলে ডাকি, চলবে ?
--রামু ? কুলি মুটেদের মত নাম, মনে মনে বললেও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে ছিলেন তিনি। পাখি দির আনাগোনা চলত রমাকান্তদের বাড়ি। রমাকান্তর বাবার প্রাক্তন ছাত্রী ছিল পাখি। দিদি ডাকলেও দিদির চেও বড় লাগত, রমাকান্তর মনে হত, পিসি মাসি ডাকলে যেন ভালো হত! 
--এই রামু, শোন ?  সেদিনও ডেকে ছিল পাখি দি। 
রামু এগিয়ে গিয়েছিল পাখির কাছে। পাখি রমাকান্তর থুতনি তুলে তাঁর মুখের দিয়ে তাকিয়ে থেকে বলে উঠেছিল, তুই চোখে কাজল দিস নাকি ?
--কৈ না তো! রমাকান্ত সংকোচ নিয়ে বলে ছিল। 
--তবু এত সুন্দর তোর চোখ! অপলক তাকিয়ে ছিল পাখি রমাকান্তর দিকে। তখন রমাকান্তও খুব কাছ থেকে পাখি দিকে দেখে ছিলেন। তাঁর লেগে ছিল কালো হলেও লাবণ্য ছোঁয়া বয়স্ক একটা মেয়ে। চোখে কাজল টানা, মুখে পাউডার পলিস। শরীরে পারফিউম গন্ধ--সব মিলিয়ে গোলাপ বলা চলে--অন্তত সেই ঝলসানো গোলাপটা ?
রমাকান্তর বয়সটা এমনি ছিল—দেখতে দেখতে বার থেকে সতেরতে পৌঁছে গিয়ে ছিল। ইতিমধ্যে পাখি দির সাথে দস্তুর মত ভাব জমে গিয়ে ছিল। তাঁর মনে হয়েছিল, পাখি দি একটা কালো মেয়ে হলেও তার ললিত কলার মত হাত দুটোর ছোঁয়া কিন্তু মন্দ লাগে না !  পাখি দি কি রমাকান্তর মনের কথা বুঝত, বলে ছিল রামু, আজকাল তুই কিন্তু খুব দুষ্টু হয়ে গেছিস !
--দুষ্টু নয়, এখন আমি দুষ্ট হয়ে গেছি, বল?
নির্জন দুপুরের অবকাশে পাখি সে দিন রমাকান্তর দিকে এগিয়ে এসে ছিল। রমার সঙ্গে চোখে চোখ মিলিয়ে বলে ছিল, দেখি রামু কত বড় হয়ে গেছিস ? সম্পর্কটা এ ক’বছরে অনেকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়ে ছিল। হাসি, খুনসুটি, ঠাট্টা, ছোঁয়াছুঁয়ির আমেজ লাগা থাকত ওদের মাঝে। কিন্তু সে দিন রমাকান্তর কেন যেন খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, পাখি দির আরও কাছ ঘেঁষতে। তিনি আরও একটু কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে ছিলেন, দেখো তো আমি কতটা দুষ্ট হয়ে গেছি?
পাখি দেখছিল রমাকান্তকে, বয়সের তারতম্য ছিল, তবু স্থিতি পরিস্থিতি, নরনারীর অবস্থান ক্ষেত্রে লৌহ-চুম্বকের ধর্ম মত কাজ করবে এটাই তো স্বাভাবিক। রমাকান্ত সেদিন চুক করে পাখি দির গালে এক চুমু দিয়ে বসে ছিলেন। 
--ওরে ছেলে, তলে তলে--পাখি দি যেন রমাকান্তকে ছুটে ধরতে চাইল আর রমাকান্ত যেন কিছুতেই পালাতে পারছেন না, এমনি একটা ভাব। শেষে পেছনে দেওয়াল বন্দি হলেন তিনি। পাখি মুখে হাসি নিয়ে হাতে থাপ্পড় তুলে ধরে ছিল। সে থাপ্পড়ের গতি খুব কমে গিয়ে রমাকান্তর গাল ছুঁয়ে ছিল মাত্র। হাসতে হাসতে রমাকান্ত পাখি দির গালে আবার দ্রুত তালে দু, তিনটে চুমু জড়িয়ে দিল। রাগের ভান নিয়ে সেদিন পাখি দি রমাকান্তর দিকে তাকিয়ে ছিল, জানিস আমি তোর চে কত বড়? সে দিনের পর্ব ওখানেই শেষ হয়ে ছিল। 

রমাকান্তর মনে হয়ে ছিল, ভালবাসা আসলে তত গুরুত্ব পূর্ণ নয়। তিনি দেখেছেন সুন্দরী মেয়েদের। কিন্তু সাহস ভরে এগিয়ে যেতে পারেন নি। একমাত্র পাখি দি ছিল তাঁর এক্তিয়ার ভুক্ত, তাঁর বশে। আর কিছু না হোক যৌবনের প্রেম ভালবাসার অভ্যাসগত ব্যবহারগুলি তিনি পাখি দির কাছ থেকে জেনে নিয়ে ছিলেন। পাখি দিকে তখন তিনি অনায়াসেই চুমু দিতে পারেন। ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে সময় ব্যতীত করতে পারেন। কিন্তু ইচ্ছের পরিধি থেমে থাকার নয়--বিশেষ করে এই প্রেম খেলার ইচ্ছেগুলি গুটিসুটি মেরে অবলীলাক্রমে সুখের ছিদ্র অন্বেষণ করতে থাকে। 

এরপর একদিন তাই হল, চুম্বনের পর রমাকান্ত বেড় দিলেন পাখিকে। পাখি চেহারায় একটু মোটা বটে। তবু যুবক রমাকান্ত তখন মত্ত নেশায় বিভোর, শৃঙ্গার রসসিক্ত। তাঁর বাহুডোরে পাখি ক্রমশ এঁটে আসছিল। পাখিরও তো ভাল লাগা, মন্দ লাগা বলে কিছু আছে? শরীর রসায়নে সেও তো  সামান্য হলেও আপ্লুত হতে পারে? কিছু সময় নিয়ে পাখিও তাই চোখ বুজে ছিল। রমাকান্ত তখন তাপিত, শরীর উত্তাপ তাঁর এক জাগায় এসে কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন লক্ষ্য বিন্দুর দিশায়। এক সময় হঠাৎ পাখি নিষ্ক্রিয় হয়ে উঠল। আর এক সূত দূরত্বের পরিধিতে পাখি হঠাৎ তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলো, রমাকান্তর দিকে কঠোর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলে উঠলো, এটা কি হচ্ছে রামু ? শত হলেও এটা জানবি যে আমি একটা মেয়ে। আর মেয়েরা এক জাগায় এসে জন্মভ্রষ্ট হয়ে যায়! এরপর সামান্য সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে পাখি দি ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ছিল। 

রমাকান্ত পরিণত বয়সে এসে পাখি দির ওই জন্মভ্রষ্ট, কথাটা মনে মনে বহুবার বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর কাছে ওই জন্ম ভ্রষ্ট শব্দটাকে বহু মূল্যবান বলে মনে হয়েছে, এত মূল্যবান শব্দ পাখি দির মুখ থেকে কি ভাবে বেরিয়ে এসে ছিল ! বস্তুত নারী জাতি নিজেকে নিয়েই বড় ফেসাদ ত্রস্ত। তাদের নিজস্ব দেহেই লুক্কায়িত থাকে সম্পদ কক্ষ। এ সম্পদ নিঃসন্দেহে অমূল্য, বিশেষ ভাবনার পরাকাষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত। যখন তখন যত্রতত্র নির্জনতায় এর তস্করি  প্রহরায় নারীকে সদা তটস্থ থাকতে হয়। আবার অন্য দিকে তিনি এও দেখেছেন, সংসারের প্রেম খেলায় শরীর উচ্চাটনের ব্যাপারটাও একেবারে কম প্রধান নয়। দেহ সুখে অঙ্কুরিত হয়ে কত মেয়েরাই তো আজকাল স্বেচ্ছায় জন্মভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে ! সেখানে প্রেম বা ভালবাসা শব্দটা প্রলাপ মাত্র বলে মনে হয়। 
   
পরিচিতি 
তাপসকিরণ রায় তাপসকিরণ রায় Reviewed by Pd on ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.