প্রজাতন্ত্র দিবসের ছুটির সকাল, ঘুম ভেঙে গেছে অনেক সকালে ৷ কুয়াশাস্নাত সূর্য সবে আড়মোড়া ভেঙে চেয়েছে পুব আকাশের এক কোণে ৷ বিছানায় শুয়ে থাকতে আর মন চাইল না ৷ উঠে পড়ল সূপর্ণা ৷ গায়ে একটা হালকা চাদর জড়িয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল সে ৷ চোখ গেল ব্যালকনি ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সামনের ছাতিম গাছটায় ৷
পাতার আড়ালে জমিয়ে সংসার পেতেছে কত রকমের নাম না জানা পাখি ৷ রাতের আঁধার কাটতেই দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা সংসার জুড়ে ৷ বেড়িয়ে পড়েছে আধারের সন্ধানে ৷ কখনও এ ডালে তো কখনওবা ও ডালে , লাফিয়ে চলেছে ফুরুৎ ফুরুৎ করে ৷ তার মধ্যেই সেরে ফেলছে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সংগ্রাম ৷ পুকুরের জলে কালো কালো ছায়া, মাছেরাও বেড়িয়েছে প্রাতঃভ্রমণে ৷ উন্মুক্ত আকাশকে সাক্ষী রেখে যদি কিছু বিশুদ্ধ অক্সিজেন পাওয়া যায় এই আশা ! তাই দেখে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ওড়াউড়ি শুরু হয়ে গিয়েছে মাছরাঙা, পানকৌড়ি ও কালিবকের দলের ৷ একটি চিলও উপস্থিত ৷
সকলেরই যে প্রাতরাশ সারতে হবে ৷ খালি পেটে তো আর জীবনধারণ হয় না ৷ পশ্চিম দিক বলেই সূর্যের আলো সোজাসুজি পুকুরে এসে পড়তে দেরী আছে ৷ আনন্দ সহকারে চলবে তাই জীবনধারণের এই সংগ্রামটি বেশ কিছুক্ষণ ৷
পুকুরের ঠিক ওপারেই মুখার্জী বাবুদের বাড়ি ৷ মুখার্জী বাবুর একমাত্র ছেলেও এই সময়টি হাতছাড়া করতে চায় না বলেই বোধহয় ঘাটে বসে গিয়েছে ছিপ হাতে ৷ পুকুরটা যদিও ওনাদের নয়, কিন্তু সুবিধাটি ভোগ করেন ওনারাই বেশি ৷ তাই বাড়ির পেছনদিকে ঘাট বাঁধিয়ে রেখেছেন ৷ ঘাটটির শ্যাওলাধরা ও জরাজীর্ণ চেহারাটি বলে দেয় যে ওটি বেশ পুরোনো ৷ এমনকি ওনাদের দালানওয়ালা বাড়িটির যা দৈন্যদশা , তাই দেখেও যে কেউ বুঝতে পারবে ঐ বাড়ির ভেতর যারা বসবাস করে অর্থনৈতিক অবস্থা তাদের এই মুহুর্তে ঠিক কিরকম ৷ সূপর্ণা বৌ হয়ে এই পাড়াতেই আসে ৷ তখন থেকেই ঐ বাড়িটি একই রকম দেখছে ৷ ঐ বাড়িরই মেয়ে মিনু সেই সময়ে প্রায় দিনই আসত সূপর্ণাদের বাড়িতে ৷ কারণ মিনু সূপর্ণার ছোট ননদের বান্ধবী ছিল , একসাথে পড়ত ওরা ৷ নবম শ্রেণীতে ওঠার পর মিনু নাকী আর স্কুলের পথ মাড়ায়নি ৷ তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর ৷ সূপর্ণার ননদও ইকনমিক্স-এ মাস্টার্স করার জন্য দিল্লী চলে গেল ৷ ওখানেই একটি কলেজে চাকরি নিয়ে দিল্লীবাসী ছেলেকে বিয়ে করে ঘোরতরভাবে সংসারী ৷ সূপর্ণাদের একতলা বাড়িটি ভেঙে সেখানেও চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে ৷ যার চারতলায় সূপর্ণা পেয়েছে এই ফ্ল্যাটটি আর সাথে বেশ অনেক নগদ টাকা ৷
সূপর্ণা একবার তার বর প্রদীপের কাছে জানতে পেরেছিল মুখার্জী বাবুদের বাড়িও নাকী প্রোমোটার নিতে চেয়েছিল, কিন্তু এই বাড়িটির অনেক অংশীদার যারা সবাই বাইরে থাকে ৷ একমাত্র এই বাড়ির বড় ছেলে মানে মিনুর বাবা এখানে থাকেন ৷ পেশায় ছিলেন পুরোহিত ৷ হাঁপানি রুগী ছিলেন বলে ভারী কাজ বিশেষ একটা তিনি করতে পারতেন না ৷ বয়স যত বেড়েছে, হাঁপানির প্রভাবটাও ততই বেড়েছে ৷ এখন আর কিছুই করতে পারেন না ৷ তার ওপর শীত পড়তে শুরু করলে প্রতি বছরই যায় যায় অবস্থা হয় ৷
মিনুর যে দাদাটি আছে, কিচ্ছুটি করে না ৷ কিছু যে করে না তার প্রমাণ তো জলজ্যান্ত পুকুরঘাটে ৷ সূপর্ণার মনটা ভীষণ খারাপ লাগায় ভরে গেল ৷ সুন্দর এই সকালের যে আমেজটা নিচ্ছিল, মিনুর দাদাকে দেখে সব নষ্ট হয়ে গেল ৷ শুধু ভাবল ওদের চলে কি করে ! মিনুটাকেও তো আজকাল দেখা যায় না ৷ এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সূপর্ণা ঘুরে দাঁড়ায় ৷ মনে মনেই বলে ফেলে "নাঃ , আমি যাই এবার আমার সংসারের জীবনধারণের ব্যবস্থা করতে রান্নাঘরে ৷ "
হঠাৎ চমকে যায় একটা শব্দে ৷ বড়ো রাস্তার মোড়ে একখানি গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে ৷ বেশ বড়ো , দামী গাড়ি ৷ চিন্তিত মুখে ঐ দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, "এত সকালে কে এল আর কার বাড়িতেই বা এল!" ভাবতে ভাবতেই গাড়ির দরজা খুলে যায় ৷ নেমে আসে মিনু ৷ পরণে দামী শাড়ী, গলায় দামী নেকলেস, হাতে চামড়ার দামী ব্যাগ , চোখে দামী রোদচশমা ৷ যদিও রোদ তখনও কড়া হয়ে ওঠেনি ৷ এক সেকেন্ডও সময় লাগেনা সূপর্ণার বুঝতে , রোদচশমায় লজ্জা ঢেকে মিনু ফিরল বাড়ি জীবন ধারণের উপার্জিত অর্থ নিয়ে প্রজাতন্ত্র দিবসের ছুটির সকালে ৷৷
মৌসুমী মিত্র ( বৈদ্য )
Reviewed by Pd
on
জানুয়ারি ২৬, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
জানুয়ারি ২৬, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন