প্রতিবারই সম্বন্ধ এসে ফিরে যায় কিন্তু নার্গিসের বিয়ে আর পাকা হয়না । বয়স ছাব্বিশ, সাতাশ হবে আর দেখতেও এমন অসুন্দর নয় যে পাত্র পক্ষ এককথায় না বলে দিবে । কেউ কিছু বুঝতে পারেনা, কেউ কোন হিসেব মিলাতে পারেনা । নার্গিসের মায়ের চোখে বরাবরের মতোই জল এক অজানা শঙ্কায় ! বাবা মাইনুল ইসলাম বেশ কিছুদিন হলো সরকারী চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন । সময় কাটেনা, তাই প্রায় সারাদিন খবরের কাগজে চোখ রাখে আর বিকেলের দিকে মহল্লার দুটি কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েকে ইংরেজি পড়ায়, তাতে বেশ ভালো একটা সময় চলে যায় । গত সপ্তায় দেখে যাওয়া ছেলে পক্ষ যখন আজকে না করে দিল মাইনুল ইসলাম ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়না; এমনিতেই বাড়িতে একটা শোকাবহ অবস্থা তার উপর খবরটি শুনে নার্গিসটাও কোথায় যে গেলো সেটি নিয়েই বরং খুব চিন্তা করেন তিনি । বড় মেয়েটার বিয়ে হলো ভালো একটি ছেলের সাথে, একমাত্র নাতনী সুরেলাকে নিয়ে সুখের সংসার তাই তাঁকে নিয়ে কোন ভাবনা নেই অনিশ্চয়তা নেই নার্গিসের মা-বাবার ।
আশপাশের ফ্ল্যাটের তিনজন গৃহিণী সন্ধ্যা বেলায় নার্গিসদের বাসায় এসে উপস্থিত । ঘরে ঢুকেই নার্গিসের মাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে । মাইনুল ইসলাম বেশ অবাক হয় আর একমাত্র ছেলে শিহাবকে জিজ্ঞেস করে- ‘কিরে ওরা জানলো কেমন করে, কিছু জানিস’ ? শিহাব না সূচক উত্তর দেয় । পেছন থেকে নার্গিসের খালা এসে বলে- ‘কোথায় থেকে আর জানবে ওই বিলকিসের কাছ থেকে বোধয় । কাজের মহিলা গুলো না এমনই, কিছুই পেটে থাকেনা । যেখানে কাজ করে তার হাঁড়ির খবর অন্যদের কাছে বলে বেড়ায় । এরা খুব বজ্জাত, ছোট লোকের বাচ্চা । ভাগ্যিস ঢাকায় আছেন গ্রামে থাকলেতো পুরো গ্রাম ছড়িয়ে দিত’ ! বেশ ক্ষোভ ঝাড়ে নার্গিসের খালা । এই ঢাকা শহরে থেকেও নার্গিসের বিয়ে হচ্ছেনা কথাটি গোপন নয় যদিও কিন্তু আলোচনার ঝড় ওঠেনি যোগাযোগের অভাবেই । মোবাইল ফোনে আজকাল টাকা খরচ করে কে-ইবা এমন আলোচনা করতে যায় ? তবুও একেবারে যে থেমে আছে তা নয় । আত্মীয় স্বজনদের মাঝে এই অহেতুক বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষা হয়েছে এবং হচ্ছে । কোন কোন কাছের মানুষই বেশ মজা নিচ্ছে ব্যাপারটিতে । কাছে আসলে এমন ভাব, যেন নার্গিসের বিয়ে হচ্ছেনা বলে সেই মানুষটির বুক ফেটে যাচ্ছে । সব অভিনয় আর মুখোশের আড়ালে ঘিনঘিনে রূপ ।
বিলকিস পরেরদিন কাজ করতে এসে ঘরদোর পরিষ্কারের লেগে যায় । কাজের এক ফাঁকে নার্গিসের মাকে বলে- ‘খালাম্মা ছোট মুকে একটা কথা কই কিছু মনে নিয়েন না, আপনার মাইয়ারে পীর ফহির দেহান, যদি কাম অয়’ । বলেই আবার বলে- ‘আমার জানা শুনা একজন পীর আছে, যদি কন তাইলে পানি পড়া ঝাড়ফুঁক দিয়া দিবো; দেখবেন লগে লগে বিয়া হইয়া গেছে । শিন্নি মাত্র পাঁচ হাজার টেকা’ । নার্গিসের মা কিছু বলেনা চুপ করে থাকে । মনে মনে ভাবে- ‘আসলে কি সত্যি বলছে বিলকিস ? পা বাড়বো ওই পথে’ ? মায়ের মন কত কিছুই বিশ্বাস করতে চায় ।
পরদিন বাসায় এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, হইচই পড়ে যায় সমস্ত বাসায় । আজই নার্গিসের কাবিন হয়ে যাবে তাই একদম সময় নেই হাতে । মাইনুল ইসলাম রাতেই খবরটি পেয়ে মোবাইল ফোনে শুকনা বাজারের সব পদ অর্ডার দিয়ে ফেলেন । খুব সকালে উঠেই কাঁচা বাজারটা সেরে নেবার প্রস্তুতি নেয় রাতভর ।
যথারীতি বিলকিসের কাছ থেকে কথাটি শুনে ছুটে আসে পাশের ফ্ল্যাটের মহিলারা । এসেই তাঁদের একজন নার্গিসের মাকে জিজ্ঞেস করে- ‘কেমন করে এত তাড়াতাড়ি আপা’ ? । ‘না, আসলে অনেকদিন আগে একটি পরিবার থেকে দেখতে এসেছিল ওকে মাঝে কোন সংবাদ দেয়নি হঠাৎই গতরাতে জানালো’ । উত্তর দেয় নার্গিসের মা । ছেলে পক্ষ আসে নার্গিসদের বাসায় । অনাড়ম্বর পরিবেশেই কাবিনটা হয়ে যায় । পরে অনুষ্ঠান করা যাবে এই কথা বলে সেদিনই তাঁরা নার্গিসকে সঙ্গে নিয়ে যায় ।
নার্গিসের বাবা, ভাই বাসার সবাই খুব খুশি কিন্তু নার্গিসের মায়ের মুখটি তখনও মলিন । সবাই ভেবেছিল মেয়ের তাৎক্ষণিক বিদায়ে বুঝি এমন অবস্থা তাঁর । কিন্তু মায়ের শঙ্কা অন্য জায়গায় । কিছুদিন আগেই দেশের একজন প্রখ্যাত গাইনির ডাক্তারের কাছে নাম লিখিয়েছিল নার্গিস । মাকে বলেছিল- ‘’মা আমার সমস্যা আছে, ডাক্তার কিছু ঔষধ দিয়েছে আর তিনমাস পর টেস্ট করতে বলেছে । ডাক্তারের পর্বটা আগে শেষ করি, এখন আমার বিয়ের জন্য তাড়াহুড়া করোনা প্লিজ’’ ।
কি সমস্যা মাকে খুলে বলেছিল কিন্তু ওতে তেমন বড় কিছু মনে হয়নি, তাই মা আর এই বিয়েটাতে দেরি করেনি ।
নতুন সংসার বেশ ভালোই কাটছিল নার্গিসের । অসুবিধা যা বিয়ের পর তা প্রতিটি বাঙালী মেয়ের মতোই । অচেনা, অজানা মানুষের ভিড় । তাঁদের মন ও মানসিকতার সাথে খাপ খাওয়ানো,নিজের স্বামীকে বুঝবার আপ্রাণ চেষ্টা । ফেলে আসা বহুদিনের সম্পর্ক গুলোর প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে টান অনুভব করা ইত্যাদি ।
বিয়ের তিন মাস পর, নার্গিস সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায় মায়ের সঙ্গে । সব গুলো রিপোর্ট দেখে ডাক্তার কিছু বলার আগে ভূমিকার আশ্রয় নেয় । কিন্তু নার্গিস ও তাঁর মা অস্থির হয়ে ওঠে । শেষে এসে ডাক্তার বলে- ‘দেখ মা, তোমার একটা অনেক বড় সমস্যা হয়েছে । এখন থেকে মনটাকে শক্ত করো, আমি এখন তোমাকে যা বলবো তা সরাসরি বলাই ঠিক হবে । কারণ লুকিয়ে রাখলে এক অজানা ফলাফলে তুমি আশায় বুক বাঁধবে তাই বলছি । তুমি আর কোনদিনই মা হতে পারবেনা’ । কথাটি শুনে নার্গিসের মনে হচ্ছিলো পৃথিবীটা ভেঙে পড়ছে তাঁর মাথার উপর । বুকের ভেতরটায় মুহূর্তেই শূন্যতা ভর করে ।
ডাক্তারের রুম থেকে বেরিয়েই মাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে নার্গিস । নিশ্চুপ মায়ের চোখে গড় গড় করে জল গড়িয়ে পড়ছে । কিছু মানুষ নার্গিসের কান্না দেখে তাঁর মাকে জিজ্ঞেস করে । কেউ কেউ জেনে সান্ত্বনা দেয়, কিন্তু সেসব বিষের মতো মনে হয় নার্গিসের । নার্গিসের মা পাশে বসা অন্য এক মাকে বলছে- ‘যদি আগে জানতে পারতাম তাহলে মেয়েটিকে বিয়ে দিতাম না’ । বলেই কান্না । চেম্বারের বাইরে যেন মৃত বাড়ির আবহ সৃষ্টি হয় ।
নার্গিস মাকে বলে- ‘’মা এ কথা আমি কেমন করে আমার বরকে বলবো, শ্বশুর বাড়ির লোকদেরকে বলবো ? মা যে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে’’ ।
বাইরে এসে ব্যস্ত সড়কের পাশে এসে দাঁড়ায় তাঁরা রিক্সার জন্য । হঠাৎ বিকট শব্দে একটি মিনিবাস ট্রাকের ধাক্কায় ভেঙে চুড়ে যায় । জানালার কাচ গুলো ঝনঝন শব্দে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে । নার্গিসের বুকটা কেঁপে ওঠে । চোখে মুখে উদ্বেগের রেখা স্পষ্ট; রিক্সা চলছে, মাথার উপরে খোলা আকাশ, এক ঝাঁক পাখি উড়ে যায় আর সূর্যটা আস্তে আস্তে পশ্চিমের দিগন্ত রেখা বরাবর ডুবতে থাকে; রাস্তার সোডিয়াম লাইট গুলো জ্বলে উঠছে একে একে, কিন্তু নার্গিসের ভেতরের আলো যেন একটু একটু ক’রে নিভতে থাকে অজানা, অচেনা ঝড়ের বাতাসে । বিষণ্ণ নার্গিস ও তাঁর মা পাশাপাশি, জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক ধরে এগিয়ে যায় ধীরে ধীরে । নার্গিসের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ।
![]() |
| পরিচিতি |
ইফতেখারুল হক
Reviewed by Pd
on
জানুয়ারি ২৬, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
জানুয়ারি ২৬, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন