দিস ইজ আ
--------------------
মা বাবা তার নাম রাখলো ঔরঙ্গজেব, বড়জনের নাম ছিলো দারাশিকো, ছোটপুত্র হুমায়ুন, এরপরে একমাত্র কন্যা জাহানারা, পুরো মুঘল পরিবার। তাদের পিতা মোঃ বাবর একজন দর্জি, মা মেহেরুন্নেসা গৃহীনি । ঔরঙ্গজেব নাইন পাশ দিয়ে আর পড়লো না, সে ভেবেছিলো কোন ধনী কন্যাকে বিয়ে করবে, আসলে ইচ্ছেটা ষোলআনা থাকলেও পনেরআনাই জলে গেলো, বড়ভাইয়ের বিয়ে হলো, ছোটভাইয়েরও, এরপর একমাত্র বোনের, ঔরঙ্গজেব মাঝখানেই ঝুলে থাকলো। তার আর বিয়ের সম্বন্ধ আসে না, আসবে কি? সে কোন চাকরি করে? করবেই বা কেন? সে সম্রাটপুত্র কিংবা নিজেই সম্রাট, বাপের ঘাড়েই খায় । সেবার চত্রিমাসে এক অবাক কাণ্ড হলো, এক স্কুল মাস্টারনী এলো ঔরঙ্গজেব কে দেখতে, পাত্র পছন্দ হলে রাজি হয়ে যাবে, কালোকুলো মেয়ে, গড়নও সুবিধের নয়, তবু ঔরঙ্গজেব খুশি, পাত্রী চাকরিজীবি । ঘর ঘুরে দেখলো মেয়েটা, তারপর ঢুকলো পাত্রের কামরায়, কি থেকে কি হয়ে গেলো বোঝার আগেই দেখি, মেয়েটা নাক চেপে দৌড় আর বলছে, দিস ইজ পাঠার গন্ধ। ওহ হো, বলাই হয়নি, ঔরঙ্গজেব অতিরিক্ত গিধর, তার কামরায় ঘরের সদস্যরাও ঢোকে না । চ্যাংড়া মফিজ এইসব দৃশ্য দেখছিলো, পরদিন সকালে দেখা গেলো ঔরঙ্গজেবের কাঠের জানালায় কে বা কারা লিখে রেখেছে, দিস ইজ পাঠার গন্ধ ।
ঔরঙ্গজেব ও পিতলের বদনা
---------------------
ঔরঙ্গজেবের কিছু বিষয়ে শুঁচিবাই ছিলো বাড়াবাড়ি ধরনের, এই যেমন ঘরলাগোয়া কোন বাথরুমে সে যাবে না, কাউয়ার দল চোখ মেলার আগে সে আমাদের বৈঠকখানা ঘরের পাশে দোকান কর্মচারীদের যে গণটয়লেট সেখানে যেতো, হাতে থাকতো একটা ঝকঝকে পিতলের বদনা, সেটা প্রতিদিন নিজেই মাজতো, শীত গ্রীষ্ম বারোমাস ব্রজেশ্বর স্টাইলে স্নান করতো পুকুরে, একটা ন্যাকড়া দিয়ে শরীর ডলতো আর স্নান শেষে গামছাটা পড়ে কোনমতে লুঙ্গি ধুয়ে ঘরের দিকে হাঁটা দিতো, আমরা লজ্জায় ওদিকে যেতামই না । এদিকে ছোট কাকিমা কয়েকদিন থেকেই প্রশ্ন করে করে আমায় উত্যক্ত করছেন, হ্যাঁ রে পরী, পাত্রপক্ষ তোকে দেখে যায়, কথা আগায় না ক্যান? তুই তো দেখতে কম সুন্দরী না! এর উত্তর কাকিমা কে দেয়া সম্ভব নয়, প্রত্যেকটা বিয়ের সম্বন্ধ এলেই আমি আর প্রতুল মিলে ভাঙ্গানি দেই । কি করবো? আমার ভালোবাসার মানুষ আছে, এত পাত্র দেখার দরকার কি? কাকিমা একটু চুপ থেকে আবারও বলে ওঠেন, কাল ভোরে দরজা খুলে যার চেহারা দেখবো তার সঙ্গেই তোকে বিয়ে দেবো! হায় কাকিমা, ভোরে তো দুধওয়ালা এসে বেল বাজায়….. কাকা ব্যবসার কাজে বাইরে গেলে কাকিমার কাছে আমাকে রেখে যান । রাতের তামাশা রাতেই শেষ কিন্তু সকালে আমরা দরজা খুলতেই দেখি, ঔরঙ্গজেব পিতলের বদনা নিয়ে গণটয়লেটে যাচ্ছে! আমি হতভম্ব, কাকিমা প্রায়োজ্ঞান ।
ছাত্ররা কেন না বলেছিলো
--------------------
শেষতক বাবর দর্জি ক্ষেপে উঠলো একদিন, এই দামড়া কে আর কতদিন বসিয়ে খাওয়াবো? মেহের, ওকে কাজ করতে বলো, কিছু না পারলে আমার সাথে দর্জিগিরি শিখুক । ঔরঙ্গজেবের খুবই সম্মানে লাগলো, তার পেটে বিদ্যার জোর আছে, সে কিনা করবে দর্জির কাজ! নেভার….. হুংকার ছাড়লো সে, যদিও শব্দটা চি হি হ্রেষার মত শোনালো । মাস্টারী করবো আমি… তা কর বাপু. এই যে আমাদের বৈঠকখানা ঘরের সাথে লজিং হুজুরের ঘর সেখানে বসে পড়া. নয়তো বৈঠকখানা ঘরেই মেহেরুন্নেসা বেগম বললেন । কয়েকজন ছাত্রও জুটে গেলো, শুরুটা মন্দ ছিলো না, ছয় সাতজন ছেলেমেয়ে হেলেদুলে পড়ছে, ঔরঙ্গজেব একটা বেত হাতে বেশ ভাব নিয়ে পড়ায় এবং প্রতিটি লাইন পড়ানো শেষে বাচ্চাদের প্রশ্ন করে ‘বুঝতে পারছিস?’ এটা তার মুদ্রাদোষ, সেটা না হয় মেনে নেয়া গেলো কিন্তু ঔরঙ্গজেব যতটা না বলে তার চাইতে বেশি থুতু ছিটায়, ওর সামনে দাঁড়িয়ে যে কথা বলবে সে থুতু ওয়াশ হয়ে যাবে । যারা জানে তারা ঔরঙ্গজেবের সাথে কথা বলে কোনাকুনি দাঁড়িয়ে, হতভাগা বাচ্চারা এসব কিভাবে জানবে? যখন জানাটা হলো তখন ওরা আর নিশ্চুপ বসে রইলো না, একজন স্যারকে দিলো একটা রুমাল, আর প্রত্যেকে হাতে রাখা শুরু করলো জাপানী পাখা, ঔরঙ্গজেব কথা বলতে শুরু করতেই তারা মুখের সামনে পাখা মেলে ধরে, বিষয়টা আর সহ্য হলো না ঔরঙ্গজেবের, একদিন সঠিক নিয়মে বেতপ্রয়োগ করে সে বেতটাকে ভেঙেই ফেললো । ক্ষেপে গেলো বাচ্চাদের বাবামায়েরা, তিনমাসে দেড়হাজার টাকা কামাইয়ের পর ঔরঙ্গজেবের টিউশনী ব্যবসা লাটে উঠলো ।
সম্বল ওই ছারপোকা ঠাঁসা কম্বল তার বাল্যবন্ধু ছিলো…
-------------------------------------------------
মেহের ফুপু বেশ ভারী মহিলা ছিলেন, তিনি হাঁটাচলা করতেন ধীরে, কথাও বলতেন আস্তে খুব নীচুস্বরে, পান খেতেন, হাসতেন, কখনও ঝগড়া করতেন না, তবে দুই একদিন পরপরই আছাড় খেয়ে পড়ে যেতেন তিনি । কি মুশকিল, সারাবাড়ি তোলপাড়, কি হয়েছে? মেহেরুন্নেসা আছাড় খেয়েছে, অ, এ আর নতুন কি? যা সবাই মিলে তোল ওকে অর্থাত আছাড় না খাওয়াটাই তার জন্য অস্বাভাবিক ঘটনা। সেই বান্দা একদিন টেনেটুনে ঔরঙ্গজেবের কম্বল ফেললেন ঘরের চালে, সাথে তর্জনগর্জন, এই হারামজাদা আমার ছেলে হয় কেমনে? আমি এত ছিকছাক (সাফসুতরো) মানুষ, অরে কি হাসপাতাল থেকে বদলে দিয়েছে? মেহের ফুপুর জন্য কষ্ট হয়, একা একা কম্বল শুকাতে দিচ্ছেন, আমরা কেউ যাইনি, কাজের বুয়ারাও না ,রিনিচিনির মা বুয়া আম্মা কে বললো, ‘ওরে ভাবীছাব’ কোম্বল ভরা উরাস,(ছারপোকা) আর কি গোন্ধ! মেহের আফায় ওয়া টানতেয়াছে কেম্নে? মেহের ফুপু ঔরঙ্গজেবের মা হয়ে ঠেকেছেন, তাই শীত আসার আগেই শুকাতে দিয়েছে কম্বলটা । ঔরঙ্গজেব তখন বাসায় ছিলো না, ফিরে তার কম্বল চালের ওপর দেখেই এক চিৎকার, কে আমার কম্বল ধরেছে? আমি, আর কে তোর পিছামারা জিনিসে হাত দেবে? খবিশ, সারা কম্বলে ছারপোকা। বিছানা বালিশে সব বের কর মর্কট পাঠা…… মেহের ফুপু বলে শেষ করেছেন কি করেন নাই, চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে একখাবলা দিয়ে কম্বল টেনে নামালো ঔরঙ্গজেব, খবরদার আমার কোন জিনিসে কোনদিন হাত দিবেন না। খাটমল, মশা এরা আমার দোস্ত, অরা না কামড়ালে আমার ঘুম ভালো হয় না, বলেই গটগট করে ঘরে চলে সে, মেহের ফুপু বাক্যহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ।
পাড়ায় রটিয়া গেলো একি কারবার? মুখ দেখানোটা বুঝি হয়ে গেলো ভার…
---------------------------------------------------
সাত সকালে তিনটা কুকুর, আর ছয়টা ছানা মিলে শোরগোল । একটা বাড়ি বটে, এতগুলা কুকুর থাকার দরকার কি? কোথায় ঘুরছে, কাকে তাঁড়া করছে, কে কামড় খেলো, অতিষ্ঠ হবার উপক্রম । ঔরঙ্গজেবের একটা চাকরি হয়েছে, খাদ্যগুদামের রাত্রি পাহারাদার । আমরা বেঁচেছি, ঘাটে কিংবা উঠানে বা পিতলের বদনা হাতে তাকে যখনতখন দেখা যায় না, সে সারারাত পাহারা দেয়, পাখি ডাকার আগে বাসায় এসে ঘুমায়, দুপুরে খেয়ে আবার ঘুমায়, বিকেলে সত্তর দশকের নায়কদের মত একটা বেলবটম প্যান্ট এবং সাদাকালো কোমর চিপা স্ট্রাইপ শার্ট পরে বের হয়ে যায় । মেহের ফুপুর গজরগজর প্রায়ই শুনি, ‘শুয়োরটার জামা কাপড় দিয়েও তেলা পোকার গুয়ের গন্ধ, এ কি পয়দা করেছি আমি এলাহী!’ তবে রবিবার ঔরঙ্গজেবের ছুটির দিন, ওই দিন আমরা ওনাদের বাসার ধারেকাছেও ঘেঁষি না । ঔরঙ্গজেবের স্বভাব চরিত্র খুবই ভালো কিন্তু তার আধামাইল দুর থেকে পাঠার গন্ধ, হয়তো একটু বাড়াবাড়ি ধরণের বর্ণনা হয়ে গেলো, হোক গে। তার ওপর শয়তানটা খালিগায়ে বাইরের বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কান চুলকায়, তারপর কাঠিটা মুছে আঙুল শুঁকে আবার চুলকায়, ওয়াক, ওয়াক… এমনি এক রবিবাবের ঘটনা, সেজ কাকিমা প্রতি রবিবার একজন ফকির খাওয়ান, সেদিন দুপুরে একপিস কালবোশ মাছ, আগের দিনের মাংস, আট মিশালী শাক আর ঘন ডাল দিয়ে একপ্লেট ভাত দিয়ে ফকির কে বিদায় করেছেন কাকিমা, আধাঘন্টা পরে তুমুল হৈ চৈ, গালিগালাজ আর অভিসম্পাত। সবাই দৌড়ে আসে, গেটের কাছে ঔরঙ্গজেবের হাতে ভাতের প্লেট এবং তখনও সে খাচ্ছে, ফকিরটা বিবিধ উচ্চারণে চীৎকার করে যাচ্ছে । হলোটা কি? কি আবার, ফকিরের মেনু চেক করতে গিয়ে সে ফকিরের খাবারটাই খেয়ে নিয়েছে! মেহের ফুপু আর ক্রোধ দমন করতে পারলেন না, একটা চেলাকাঠ নিয়ে ধাই করে বসিয়ে দিলেন ঔরঙ্গজেবের পিঠে । সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়লো খবর, আমাদের কোথাও মুখ দেখানোর আর উপায় রইলো না….
![]() |
| পরিচিতি |
সাঈদা মিমি
Reviewed by Pd
on
জানুয়ারি ২৬, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
জানুয়ারি ২৬, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন