দোলনচাঁপা ধর



প্রায় দেড়শর উপর মড়া পুড়িয়েছিলেন সেকালে,তা সে পাড়াতেই হোক বা আশেপাশে,মৃত্যু সংবাদ পেলেই হল,সেই বাড়িতে হাজির। কাঁধ দেওয়া সমাজে তখন পুণ্যের কাজ ছিল তবে তিনি বোধহয় সে লোভে করতেন না কারণ যে কোন কাজের বাড়িতে গিয়েও দেখতাম একটা গামছা জোগাড় করে কোমরে বেঁধে পরিবেশনে নেমে পড়েছেন।আমরা চিন্তিত হতাম,আমাদের প্রিয় পদটি যেন উনি পরিবেশন না করেন,তা হলেই আর বরাদ্দর বেশী পাওয়া যাবে না অথচ অন্যেরা চাইলে দেবেন।

বাড়ির ছাদে ছিল প্রচুর গাছ, সব সন্তানস্নেহে পালিত, তাদের পরিচর্চা করার লোভ ছিল আমার ষোলআনা আর সেই লোভেই একদিন খুরপি নিয়ে গোড়ার মাটি আলগা করতে গিয়ে (তাঁর অনুকরনে) দিলাম তাঁর সখের ক্রিসেন্থামাম টা উপড়ে। জোয়ান ছেলের মত সেই ভূপতিত গাছটিকে অতি যত্নে দাঁড় করিয়ে আমায় একটা পাথরকুচি গাছ দিয়ে বলেছিলেন এই গাছটা ঐ গাছটার মত দুর্বল নয় আর পাতা থেকেই নতুন গাছ হয়,আবার ফুল ফুটলে সে দেখতেও ভারী সুন্দর, আজ থেকে এই গাছটায় ফুল ফোটানোর ভার তোমার।

ঘোষ মাসীমার ছেলে মেয়ে ছিল না,মেসমশাই যাবার পর তিনি একেবারে একা হয়ে গেলেন,তার ওপর চোখের অসুখে উনি প্রায় অন্ধ।আমাকে প্রায়ই বাজার ,ওষুধ দিতে যেতে হত ওনার বাড়ি,আর গেলে ঘণ্টা খানেকের আগে ছাড়া পেতাম না।একা মানুষ সঙ্গী পেলে ছাড়তে চাইতেন না। যখন উঁচু ক্লাসে উঠলাম, পড়ার চাপ বাড়ল, যেতে চাইতাম না কিন্তু অলঙ্ঘনীয় আদেশ যেতেই হবে,অমান্য করার উপায় নেই।

সারা বছরই বাড়িতে অতিথ-কুটুম লেগে থাকত। কেউ চিকিৎসা করাবে তো কেউ চাকরীর পরীক্ষা দেবে। কারো হয়ত কলকাতায় থাকার জায়গা নেই,বাসা খুঁজতে সময় লাগবে,তা থাকো তুমিএখানে,ধীরে সুস্থে খুঁজে নাও বাসা,এমন হাজারো রকম।একজন আমাদের বাড়িতে থেকে পুরো একটা কোর্স শেষ করেছিল মনে আছে তার চাকরীতে সুবিধা হবে বলে,আজ অনেকদিন হল তার খবর জানি না।

মহারাজ কাকু এক অ্যাংলো ডিভোর্সি মহিলাকে বিয়ে করে তখন বাড়ি থেকে বিতাড়িত,কাঠবেকার। লালার মুদির দোকানে তখন দুটো মাসকাবারি বাজার হত,একটা আমাদের আর একটা মহারাজ কাকুদের।ওনারা তখন দানেশ সেখ লেনের দিকে ভাড়া থাকতেন কোথায়,বাজার সেখানেই পৌঁছতে হত কারণ কাকু পাড়ায় ঢুকতে পারতেন না।এখন কাকুর এ পক্ষের দুই মেয়েই বিদেশে থাকে মা বাবাকে নিয়মিত টাকা পাঠায়,কাকু অবশ্য আমাদের ভোলেন নি,বাবার মারা যাওয়ার খবর শুনে ফোন করেছিলেন তিন মাস পর।

শেষের দিকে যখন বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম ...।।
--কি লাভ হল এসব করে? এত লোকের জন্য এত কিছু করলে কেউ খোঁজ করে? তোমার ছেলে মেয়ের জন্য কেউ কিছু করল?
অদ্ভুত হেসে বলতেন ...
--আমার ছেলে মেয়ের জন্য কিছু করার দরকারই হবে না। তিনি পরম করুণাময়, এ ভৃত্যকে সে সুযোগটুকু দিয়েছেন।
বুঝলেন তো পরোপকারের নেশাটা কেমন? 

        
পরিচিতি  
দোলনচাঁপা ধর দোলনচাঁপা ধর Reviewed by Pd on জানুয়ারি ২৬, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.