সময়টা ১৯৭০ এর পূজোর পর। সেবার বর্ষাটা একটু বেশি হয়েছিল। পূজোর পর থেকেই দেখতাম প্রচুর মানুষ আমাদের এই ছোট্ট শহরের আনাচে কানাচে অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন জায়গাতেও কোনরকম মাথা গোঁজার ঠাই গড়ে নিতে শুরু করল। এর মধ্যে একদিন আমাদের পাড়ার ছেলেদের কাছে বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা বীরেশ্বর রায় অনুরোধ করলেন – “ জে, এল , পি ‘’ বিদ্যালয়ে পূর্ব পাকিস্থানের কিছু মানুষ তাদের পরিবার নিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে , তাদের খাবারের ব্যাবস্থা করতে হবে। চাল – ডাল – তরকারী সব ব্যবসায়ী সমিতি যোগাড় করে দেবে। তোমাদের দায়িত্ব বণ্টনের। আমাদের পাড়ার বেশ কিছু ছেলের সাথে আমিও স্বেচ্ছাসেবক হয়ে সেখানে গেলাম। মোটামুটি ষাট - সত্তর জনের খাবার দিয়ে বাড়ী এলাম।
রাত আট’টায় আবার যেতে হবে। গেলাম । রাতে খাবার পরিবেশনের সময় দেখলাম আরও প্রায় জনা কুড়ি পথক্লান্ত- অভুক্ত মানুষ এসে হাজির। সেদিন আগে যারা এসেছিল তারাও আধপেটা খেয়ে আমাদের সাহায্য করল মানুষ গুলোকে খাবার দিতে। পরদিন থেকে নিরাশ্রয় হয়ে বহু মানুষ প্রাণ নিয়ে পূর্ব পাকিস্থান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বালুরঘাট সহ সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে আসতে লাগল সব কিছু হারিয়ে। পথে কিছু মানুষ যেমন পাকসেনা ও রাজাকার বাহিনীর হাতে মারা পড়ল , তেমনি অসংখ্য মানুষ হারিয়ে গেল চিরতরে।
কেন্দ্রীয় সরকার তাদের দায়িত্ব নিয়ে অসংখ্য শরণার্থী শিবির গড়ে তুলে ভরণ – পোষণের দায়িত্ব নিল। কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচাবার জন্য প্রধানমন্ত্রী সমগ্র পৃথিবীর রাস্ট্র প্রধানদের কাছে আবেদন করলেন। এর মধ্যে সরকার পরিচালিত শরণার্থী শিবির গুলিতে প্রচুর যুবক নিয়োগ করল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। আমিও ক্যাম্প অ্যাসিন্টেট পদে যোগ দিলাম ঠাকুরপুরা ও সেতাই ক্যাম্পে। পতিরাম থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে প্রায় আট কিলোমিটার হেঁটে যেতে হতো। কৃষ্ণ চন্দ্র রায় নামে একজন অবসর প্রাপ্ত লেফ্টানেন্ট কর্নেল আমাদের ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। কাঁচড়াপারা তার বাড়ি। তিনি আমাদের প্রাণিত করেছিলেন – ‘ মানুষকে সেবা করতে পারাটা ভগবানের আশীর্বাদ ’। এ সুযোগ তোমাদের কাছে এসেছে । অবর্ণনীয় কষ্ট এ সব মানুষের। তাদের মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসে সেবা করো।
আমরা সকাল সাতটায় রেশন দেওয়া শুরু করতাম। যদিও তার আগে তাদের রেশন পাবার জন্য রেশন কার্ড তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল , পরিবারের লোক সংখ্যা দেখে প্রত্যেক'কে।
বিশাল বিশাল খড়ের ছাউনি ও দরমার বেড়া দিয়ে অনেক গুলো ঘর তৈরি করে শরণার্থীদের থাকার জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। আমরা মুলতঃ রেশন কার্ড দেখে দেখে ডাল – চাল , গম , খড়ি ইত্যাদির স্লিপ কেটে দিতাম। শরণার্থীরা ডিলারের কাছ থেকে টা সংগ্রহ করত। এই স্লিপ নেবার জন্য বিশাল লাইন পড়ে যেত। সমস্ত লোককে রেশন দিতে দিতে কখনো কখনো সন্ধ্যাও হয়ে যেত। চিৎকার , চেঁচামেচি , গালাগাল এসব নিয়েই আমরা কাজ করে যেতাম। পরিবার পিছু যে রেশন দেওয়া হতো সেটা অনেকের কাছেই অপ্রতুল ছিল বলে – অনেক সময়ই অভিযোগ আসত। আবার একই ঘরের মধ্যে থাকা অন্যের রেশন চুরি করে নিত কোন কোন মানুশ। সেই সব নিয়ে বিস্তর গোলমাল হতো কোন কোন সময়। এক একটি ঘরে গাদাগাদি করে মানুষ থাকত বাধ্য হয়ে।
একদিনের কথা মনে পড়ে। দেখছি সতের – আঠেরো বছর বয়সী দুটি মেয়ে খুব কান্নাকাটি করছে। চোখে যন্ত্রণা। আমি জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওদের মা – বাবাকে ঘাতক বাহিনী ধরে নিয়ে গেছিল , তাদের কোন খোঁজ নেই। ওরা গ্রামের একজনের সাথে এই শিবিরে আশ্রয় পেয়েছে। ওদের সাপ্তাহিক রেশনটা চুরি হয়ে গেছে। আমরা আমাদের ডিলার মানু ঘোষকে বলে চাল ডাল দেবার ব্যবস্থা করলাম , অবশ্যই ঘুরপথে। মানুষের ন্যায় , নীতিবোধ সবই চলে যায় মানুষের জীবনে হটাৎ আসা দুর্দশার হাত ধরে।
নগদ পয়সা পাবার লোভে কেউ কেউ অন্যের রেশন বিক্রি করে দিত চুরি করে। আবার কম বয়সী সদ্য যুবতী’ কে দেখেছি কাঁচা পয়সার লোভে দেহ বিক্রি করতে। এমন একজনকে জানি সে গর্ভবতী হয়ে পড়ায় ফাঁসি দিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন।
আবার এমনও দেখেছি আধপাগল একাকী একটি ছেলেকে অন্য একটি পরিবারকে অতি যত্নে আশ্রয় দিতে। এর মধ্যে নভেম্বর মাসের কোন একদিন বালুরঘাটে পাক সেনা শেলিং শুরু করল – তারপর মুহুর্মুহ। আমাদের পরিবারকে সরিয়ে দেওয়া হল। রাতে ট্যাঙ্ক , সাঁজোয়া গাড়ি , ভারতীয় সৈন্যদের বুটের শব্দ , ব্ল্যাক আউট এই সব নিয়ে ভোর হতো।
এক অবর্ণনীয় সময়কে উপলব্ধি যেমন করেছি - মনুষ্যত্বের প্রকাশও ঘটতে দেখেছি নানা ঘটনায়। অভুক্ত মানুষকে দেখেছি , অন্যজন খাবার ভাগ করে দিয়েছে। সঞ্চিত সামান্য সোনা বিক্রি করতে দেখেছি কম পয়সায়।
কৈশোর উর্ত্তিন্ন আমাকে শিখিয়েছে – মানুষ’ ই সব – মানুষ’ ই ঈশ্বর। অবশেষে ১৬’ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ – ভারতবর্ষ প্রথম স্বীকৃত দিল এক নতুন দেশকে – ‘ বাংলাদেশ ‘ ।
![]() |
| পরিচিতি |
কমল দাস
Reviewed by Pd
on
ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪
Rating:


কৈশোর উর্ত্তিন্ন আমাকে শিখিয়েছে – মানুষ’ ই সব – মানুষ’ ই ঈশ্বর। Etai sotti karer bijoy .. porsho korlen otit.
উত্তরমুছুন